দেশ হারানোর দু:খ করার মত লোকও একদিন থাকবে না।

কালকের লেখার পর অনেকের অনুরোধ আরেকটু খোলশা করে লিখুন। লিখব যখন ভাবছি তখন দেখছি গতকাল ১৫ আগস্ট উপলক্ষ্যে বহুজন লিখেছেন, আশ্চর্যজনক হলো গতকাল বহুজন দেশভাগ, দাঙ্গা ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠিয়েছেন। ১৯৪৬ সালের কোলকাতা দাঙ্গার প্রসঙ্গ এসেছে। এই দাঙ্গার জন্য হিন্দু নাকি মুসলমানরা দায়ী সেই বিতর্ক উঠানো হয়েছে। যথারীতি আহমদ ছফার শিষ্যরা কোলকাতা দাঙ্গার জন্য হিন্দুদের দায়ী করেছেন।

হিন্দুদের দায়ী করলে আমার জ্বলে না। সত্যিকারের দায়ী হলে সেটা স্বীকার করতে আমার সমস্যা নেই। যদিও সবাই নিজ সম্প্রদায় গোত্রের উর্ধে উঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ হতে পারেন না। সলিমুল্লাহ খান বা জাকির তালুকদাররা মুসলমান বলেই এই বিষয়গুলোতে নিরপেক্ষ হতে পারেন না। হিন্দু ভাষ্যকারদের অনেকের নামই করা যায় যারাও আপনা পাতে ঝোল টানেন। তাই পাহাড়ে সমতলে আদিবাসীদের জন্য যখন কথা বলি তখন আমি পাহাড়ী চাকমা মারমা কিনা সেই প্রশ্ন যখন কোন পাহাড়ী ইববক্সে জিজ্ঞেস করেন তখন বুঝি সবাই এটাই ভাবে নিজ সম্প্রদায়ের না হলে তার এত জ্বলে কেন? যেমন বহু ‘হিন্দু’ আমাকে জন্মাষ্টামির শুভেচ্ছা জানান ইনবক্সে! আহমদ ছফার শিষ্যরাও আমাকে সেরকমই ভেবেছিলো। তারপর যখন খোঁজ খবর বের করল, তখন বলল, পয়সার জন্য সে বিজেপির হয়ে লেখে…!

কোলকাতা দাঙ্গার সময় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৬ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীর অংশ হিসেবে মুসলিম লীগ ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করে। এদিন মুসলমানরা তাদের সমস্ত কাজকর্ম স্থগিত রাখার সিন্ধান্ত নেয়। তারা সমস্ত দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখে। এই কর্মসূচী ব্যাপকভাবে পালিত হবার জন্য সোহরাওয়ার্দী সরকার সেদিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করে। 

জয়া চ্যাটার্জী নামটি যে কোন বাংলাদেশী মুসলমানের কাছে জাকির নায়েকের পরই সবচেয়ে প্রিয় কারণ তিনি দেশভাগের জন্য হিন্দুদের প্রবলভাবে দায়ী করায় তাকেই কোট করা হয়। সেই জয়া চ্যাটার্জী সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সম্পর্কে লেখেন, ‘প্রথম কয়েক মাসে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার অপরিণত ও উদ্ধত কার্যকলাপে এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, ভবিষ্যতেও এমন ধারা চলবে- ফলে অনেক হিন্দু এই পরিণতি এড়াবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’কে তাই কোলকাতার হিন্দুরা শুধু নিছকই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও শাসনতন্ত্র পরিষদের ব্যাপারে লেখা সর্ব-ভারতীয় পর্যায়ে নেয়া সুবিস্তৃত ও ভবিষ্যৎ দেনদরবারের একটি কৌশল হিসেবেই দেখেনি, তারা অস্তিত্বের জন্য আসন্ন হুমকি হিসেবে গণ্য করে, আর সে-জন্য তারা আমরণ লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল’।

১৬ তারিখ ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’-তে পরিস্থিতিতে আগুন লাগে যখন অতিউৎসাহী মুসলিম লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা উত্তর কোলকাতার হিন্দুদের দোকানও জোর করে বন্ধ করে দেয়। এতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। হিন্দুরা এর মোক্ষম জবাব দিতে মুসলিম লীগের শোভাযাত্রায় বাধা দিতে শুরু করে। শুরু হয় দাঙ্গার প্রস্তুতি। ভয়ংকর এই দাঙ্গা হিন্দু মুসলমানের মিলিত লাশ পড়ে ৫ হাজার। সরকারী পরিচ্ছিন্ন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ফুটপাথ থেকে ৩১৪৭টি লাশ সংগ্রহ করা হয়েছিলো। এই হত্যাকান্ডের জন্য জয়া চ্যাটার্জী সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করে লিখেন, ‘এই রক্তক্ষরণের দায়িত্বের অনেকটাই বহন করেন সোহরাওয়ার্দী নিজে; কারণ তিনি হিন্দুদের প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জ দেন এবং দাঙ্গা শুরু হওয়া মাত্রই তা দমনে সন্দেহজনক অবহেলার (ইচ্ছাকৃত বা অন্য কারণে) কারণে ব্যর্থ হন’। 

বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদও এই দাঙ্গার জন্য সোহরাওয়ার্দী এবং জিন্নাহ সাহেবকে দায়ী করেছিলেন। তার লেখা ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে তিনি লিখেন, ‘জিন্নার ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে ঘোষণা এবং সোহরাওয়ার্দীর সরকারী ছুটি ঘোষণা সেদিন হিন্দুদের প্রতি উশকানি হিসেবে কাজ করেছিলো। স্বপক্ষীয় কারনে সোহরাওয়ার্দীর ‘সরকারি ছুটির’ ঘোষণা হিন্দুদেরকে যৌক্তিক ও যথাথভাবে এ ধারনা দেয় যে, ‘হিন্দুদেরকে মুসলিমলীগের কর্মসূচী পালনে বাধ্য করা হবে এবং এ জন্যই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, যা সর্বনাশা দিনে প্রতীয়মান হয়েছিল’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)।

মুসলিম লীগের অন্যতম প্রগতিশীল সেক্যুলার নেতা আবুল হাশিম (বদরুদ্দিন উমারের পিতা) স্মৃতিচারণ লিখেন, মুসলিম লীগের র্যালীতে দাঙ্গার আগে খাজা নাজিমুদ্দিন বক্তৃতা করার সময় বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন ভারত সরকারেরর বিরুদ্ধে নয়, বরং তা হিন্দুদের বিরুদ্ধে’। আবুল হাশিম তার মাইক কেড়ে নিয়ে বলেন, মুসলিম লীগের আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়। 

প্রত্যক্ষ এরকম প্রমাণ ও পরিস্থিতি দেখার পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গান্ধীজিকে এক বিবৃতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেন। দাঙ্গার জন্য সমস্ত দোষ হিন্দুদের উপর দিয়ে তিনি গান্ধীকে দাঙ্গায় মুসলিমদের উপর চালানো নৃশসতার ছবি উপহার দেন। এই ছবি দেয়া প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মুজিব নিজেই লেখেন, ‘আমরা মহাত্মাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, তার সম্প্রদায়ের লোকজন কী ধরনের অপরাধ করেছে এবং কিভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

গান্ধি কিন্তু দাঙ্গার থামানোর জন্য কোলকাতার কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে সক্ষম হোন। কিন্তু জিন্না দাঙ্গার সময় কোলকাতা পাটনা নোয়াখালী কোথাও সফর করেননি। উপরস্তু বিহারে দাঙ্গার খবর আসার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিরিহ মুসলমানদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বিশ্ব এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে, ভারতের সমস্যা সমাধানে দেশভাগই একমাত্র সমাধান’। 

শেখ মুজিব জিন্নাহ সাহেবকে কেন দাঙ্গার ছবি উপহার দেন নাই? কেন বলেন নাই দেখেন আপনার ডাইরেক্ট এ্যাকশানের কি পরিণাম…। খাজা নাজিমুদ্দিনের বলা হিন্দুদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও তিনি উশকানি হিসেবে দেখেন নাই। উল্টো আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘তার (গান্ধির) সম্প্রদায়ের লোকজন কী অপরাধ করেছে’। 

ইতিহাসবিদরাও নিজ নিজ সম্প্রদায়ের পাতে ঝোল দিয়েছেন। দাঙ্গার দোষ চাপাতে চেয়েছেন অপরপক্ষকে। তবে কোলকাতা দাঙ্গার দায় যদি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী উপর না বর্তায় তাহলে গুজরাট দাঙ্গার দায়ও নরেন্দ মোদীর উপর বর্তায় কি? ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে-তে সরকারি ছুটি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাজার হাজার নিরহ মানুষকে দাঙ্গায় মরতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। 

দাঙ্গায় মুসলমানরাই বেশি খুন হয়েছে। হিন্দু দাঙ্গাবাজদের ব্যাপক প্রস্তৃতির প্রমাণ পরে পাওয়া গিয়েছিলো। দাঙ্গাটি দুপক্ষের সুপরিকল্পিত ছিলো তার প্রমাণ ছিলো। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা মার্কিন সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছিলো, হিন্দু মালিকানা ফ্যাক্টরি থেকে অস্ত্রপাতি বানানোর রিপোর্ট এসেছিলো যেগুলো দাঙ্গায় ব্যবহার করা হয়েছিলো। তারা এগুলো করেছিলো নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে। জয়া চ্যাটার্জী যেমন বলেছিলেন মুসলিম লীগের মিটিং মিছিলে যে ভাষা ফুটে উঠেছিলো তাতে হিন্দুরা নিজেদের অস্তিত্ব বিলিন ভেবেছিলো। দাঙ্গার এই বেসমরিক ভূমিকার চাইতে অনেক বড় ফ্যাক্ট যখন সরকার নিজেকে দাঙ্গায় বিতর্কিত করে রাখে। অভিযোগ ছিলো মুসলিম লীগের কিছু নেতার নামে বিশেষ কুপনের মাধ্যমে অনেক গ্যালন পেট্রোল তোলা হয়েছিলো। ১০ হাজার লীগ কর্মীর খাবারের ব্যবস্থা করতে এক মাসের খাবারের বরাদ্দ আগেই তুলে আনা হয়। পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সোহরাওয়ার্দী তার নেতাকর্মীদের নিয়ে অনেকটা সময় সেখানে কাটান মুসলিমদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে নেহেরুর দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকার কথা স্বয়ং সোহরাওয়াদী স্বীকার করে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘এটা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর কৃতিত্ব যে, বিহারে বিক্ষুব্ধ হিন্দুদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস তিনি করেছিলেন এবং তাদেরকে সহিংসতা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে (বলেছিলেন); অন্যথায় তিনি তাদেরকে গুলি করবেন’। 

সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে কি এরকম কিছু কেউ বলেছেন যা তার পক্ষে যায়? খাজা নাজিমউদ্দিন সরাসরি হিন্দুদের বিরুদ্ধে ফাইটের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তবু আবুল হাশিম শেষ পর্যন্ত দাঙ্গায় মুসলিম লীগের কোন দোষ দেখেননি। সব দোষ কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবর শ্লোগান দিয়ে মিছিলগুলো মারমুখো হতে কে দিয়েছিলো? সেদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিলো যাতে সবাই তৌহদী জনতার মিটিংয়ে যোগ দিতে পারে?

কালকের লেখায় বলেছিলাম যে ভালই হয়েছে বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ হয়েছে। হিন্দুরা ভারত চলে গেছে আর বাকীরা এক সময় চলে যাবে সেটাই ভালো। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ এমন প্যার্টানে তৈরি যে এখানে ধর্মীয় পরিচয়টা ফ্যাক্ট। এখানে কোন অমুসলিমের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই। বঙ্গবন্ধু আজীবন খেটে মরেছে যাদের জন্য তারা বাঙালী মুসলমান! তাদের নিজস্ব দেশের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এখানে যে ‘বাঙালী মুসলমান’ বলে আলাদা একটা আত্মপরিচয় আহমদ ছফারা বলেন বঙ্গবন্ধু নি:সন্দেহে তার জাতির পিতা। বাংলা ভাগ না হলে এখানে রোজ মাথা ফাটাফাটি হত। সুরেন ব্যানার্জীদের সঙ্গে তরুণ শেখ মুজিবদের মাথা ফাটাফাটি হয়েছিলো। এরকম রোজ হত। হিন্দু মুসলমান দুটোই ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। শরৎ বসু গাঁজাখুরি অখন্ড বাংলার স্বাধীনতার জন্য দৌড়ে ছিলেন। গোটা বাংলা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে আলাদা স্বাধীন হলেও যে পরবর্তীতে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে হতো না তার গ্যারান্টি কে দিত?

তারচেয়ে দেশভাগ হয়েছে ভালই হয়েছে। হিন্দুরা দেশ হারিয়েছে। এটা তো কাউকে না কাউকে হারাতে হতই। দেশ হারানোর দু:খ করার মত লোকও একদিন থাকবে না। নিশ্চয় একদিন কেবল মাত্র অভিন্ন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য বাঙালী হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে আপন ভাববে। সেদিন জাকির তালুকদারদের মত সাম্প্রদায়িক মুসলিম বামপন্থিরা থাকবে না। সেই ভালো। রোজ ঝগড়া দোষারোপ ঘৃণা করার চাইতে দূর থেকে ভালোবাসা আর টান অনুভব করা মন্দ নয়।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted