হিন্দুদের জনসংখ্যা হ্রাসের ধারাবাহিক প্রবণতা ও তার পরিণতি ―

হিন্দুদের জনসংখ্যা হ্রাসের ধারাবাহিক প্রবণতা ও তার পরিণতি ―

১৮৭২ সালে অবিভক্ত ভারতে প্রথম পূর্ণ জনগণনা থেকেই মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে হিন্দু জনসংখ্যার পতন ঘটছে। বহুদিন ধরেই, ভারতেও অনেক স্থানেই হিন্দু জনসংখ্যা হয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে গেছে। এর একটা কারণ হল, স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে, হিন্দুদের এলাকাত্যাগ এবং আরেকটা কারণ হল বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের গণধর্মান্তরকরণ।



হিন্দু বলতে কি বুঝাচ্ছি সেটা প্রথমে আলোচনা করবো। হিন্দু বলে আমরা তাদেরই বুঝিয়েছি যাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিস্থাপন ভারতীয় উপমহাদেশে হয়েছে। যেমন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং বিবিধ আদিবাসী সমাজ। ইহুদি ও জরাথ্রুস্টিয়ানদের এই তালিকায় ধরা হয়নি যদিও তাদের সংখ্যা এতটাই কম যে তাদের এই তালিকাভুক্ত করা বা না করা বাস্তবিক কোন মূল্য নেই। তাদের প্রতিনিধিত্ব মোট জনসংখ্যাকে কোনভাবেই প্রভাবিত করেনা।

১৮৭২ সালে কেবল উত্তর পূর্ব সীমান্ত রাজ্য, জম্মু ও কাশ্মীর, বালুচিস্তান এবং সিন্ধ এলাকায় হিন্দু জনসংখ্যা সংখ্যালঘু ছিল। বাংলা ও পাঞ্জাবে হিন্দু জনসংখ্যাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ১৮৮১ সালে বাংলাতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৫০.১৪% (১) আর পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে সেটা ছিল ৫২% (২)। যদিও ১৯৪১ সালে এই অনুপাতের বিশাল পরিবর্তন দেখা যায়। ১৯৪১ সালের হিসাবানুসারে বাংলার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪৫.২১% এবং পাঞ্জাবের মাত্র ৪৪.৯% হিন্দু জনসংখ্যা ছিল।

ভারতের জাতীয় স্তরেও হিন্দু জনসংখ্যার পতন দেখা যায়। ১৮৭২ সালে যেখানে মোট জনসংখ্যার ৭৯% হিন্দু ছিল সেখানে ১৯৪১ সালে তাদের অংশীদারি ৭৩.২%-এ এবং ২০১১ সালে ৬৬% -এ (৪)(৫) পর্যবাসিত হয়। ১৮৮১ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে আর একই সময়ে মুসলমান ও খ্রীষ্টান জনসংখ্যার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৮১ সালের সাপেক্ষে ১৯৪১ সালে মুসলমানদের সংখ্যা ১৯.৯% থেকে বেড়ে ২৪.৩% আর খ্রীষ্টানদের সংখ্যা ০.৭% থেকে বেড়ে ১.৯% হয়েছে।

#এটা_বোঝা_দরকার_যে_দেশভাগের_অন্যতম_প্রধান_কারণ_ছিল_বাংলা_ও_পাঞ্জাবে_হিন্দু_জনসংখ্যার_পতন। বাংলা ও পাঞ্জাবে, ১৮৭২ সালের মত, হিন্দু জনাধিক্য থাকলে দেশভাগ খুব একটা সহজ হতনা। সিন্ধু, জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত রাজ্য ও বালুচিস্তান নিয়ে যথার্থ কোন দেশ গঠন হতে পারতোনা। তাছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরের হিন্দু ডোগড়া শাসকরা এরকম কোন প্রস্তাবে সম্মতও হতনা। হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার করুণ পরিণতি হল দেশভাগ।

দেশভাগের ফলেই এই দেশে সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। এই বিপর্যয়ের ফলে ১০ লক্ষ লোকের হত্যা হয়েছে এবং ১.৮ কোটি লোক গৃহহারা হয়েছে। পৃ.২৪৩(৪৩)। তাছাড়াও বিপুল সংখ্যার মহিলাদের উপর নির্যাতন হয়েছে। এই মানবিক বিপর্যয়ের মূল কারণ হন্দু জনসংখ্যার পতন।

দেশভাগের পরিণতি হিসাবে পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। ১৯৪১ সালের ১৯.৬৮% হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৮৮ সালে মাত্র ২%-এ নেমে এসেছে (৩)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ১৯৩১ সালের ২৯% (৩) জনসংখ্যা, ২০১১ সালে ৮.৯%-এ নেমে এসেছে (৫)। এমনকি ভারতীয় গণরাজ্যেও ১৯৫১ সাল থেকে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৫১ সালের ৮৭.২% থেকে কমে ২০১১ সালে ৮৩.২%-এ এসে পৌছেছে। কাগজেকলমে খ্রীষ্টান জনসংখ্যা ২.৩% রয়ে গেলেও বিভিন্ন খ্রীষ্টান গোষ্ঠীর দাবী অনুসারে ভারতে খ্রীষ্টান জনসংখ্যা ৬% (৩৬)। যদিও এই দাবীকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক তথ্য ও বর্তমান পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে যে হিন্দু জনসংখ্যার নিয়মিত পতন যথেষ্ট আশঙ্কাজনক বিষয়।

সমগ্র ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু জনসংখ্যার পতন সমহারে হয়নি। যদিও ভারতের প্রায় সর্বত্রই হিন্দু জনসংখ্যার পতন ঘটেছে, কোন কোন জায়গায় পতন এতটাই হয়েছে যে তারা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৫১ সালে ভারতের কেবলমাত্র দুটি রাজ্যে (জম্মু ও কাশ্মীর এবং মিজোরাম) এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে (লাক্ষাদ্বীপ) হিন্দুরা সংখ্যালঘু ছিল। ২০১১ সালে চারটি রাজ্যে (জম্মু ও কাশ্মীর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং মেঘালয়) এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে (লাক্ষাদ্বীপ) হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এছাড়াও, আরও দুটো রাজ্যে (মণিপুর ও কেরালা) হিন্দুদের সংখ্যা ৫০% ও ৬০%-এর মধ্যে। এই প্রবন্ধে আমরা হিন্দু জনসংখ্যার পরিবর্তন ও তার ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা করবো।

এই পর্যালোচনা মূলত দুটি জনগণনার, ২০০১ এবং ২০১১, উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে এটা দেখাতে যে পরিবর্তন কিভাবে ঘটছে। আমরা রাজ্যভিত্তিক, জেলাভিত্তিক ও তহশিলভিত্তিক পর্যালোচনা করবো যাতে বহির্ভাগ ও অন্তর্ভাগ – দুটো পরিবর্তনই বুঝতে পারা যায় এবং পর্যালোচনা করা যায়।

এটা বোঝা যাচ্ছে যে বিপদসীমা ও হিন্দু সংখ্যালঘু এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু জনসংখ্যা এক দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপদসীমা ও সংখ্যালঘু এলাকায় বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা এক দশকে ৩.০৬ কোটি থেকে বেড়ে ৪.০১ কোটি হয়েছে। এই বৃদ্ধির হার বিগত দশকগুলির তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই সংখ্যা বেড়েছে। এটা বলা দরকার যে এমন তহশিল খুব কমই আছে যেখানে হিন্দুদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

উপরের তালিকা থেকে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিপদসীমায় (৫০-৬০%) বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা ২০০১-১১ দশকের মধ্যে ১.৪৫ কোটি থেকে ১.৯১ কোটিতে পৌছেছে। বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৭%। একই সময়কালে হিন্দু সংখ্যালঘু এলাকায় (২০-৫০%) বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা ১.৫১ কোটি থেকে বেড়ে ১.৯৪ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ২৮.৪%। ২০০১ থেকে ২০১১ দশকে ভারতে সামগ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৭.৬% এবং যেসব জায়গায় হিন্দু জনসংখ্যা ৬০%-এর কম, সেখানে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেকটাই কম। যদিও প্রকৃত উদ্বেগের কারণ হল হিন্দু বিলুপ্ত (<২০%) স্থানে হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি যা ৪৯.১১% বেড়ে ১০.৩৬ লাখ থেকে ১৫.৪৭ লাখে পৌছেছে। এই বৃদ্ধির হার এক দশকে জনসংখ্যার জাতীয় গড় বৃদ্ধির প্রায় তিন গুন। এর থেকে বোঝা যায় যে হিন্দু বিলুপ্ত স্থানের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটছে যা উপরের মানচিত্র স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লাল রঙ দ্বারা চিহ্নিত তহশিলের সংখ্যা, এক দশকের মধ্যে ৩৭.৩% বৃদ্ধি পেয়ে, ২০০১ সালের ১৯৩ থেকে ২০১১ সালে ২৬৫ হয়ে গেছে। তহশিল বৃদ্ধির একটা কারণ নতুন তহশিল গঠন হলেও, মানচিত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে হিন্দু বিলুপ্ত তহশিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা পরে দেখাবো যে কোন এলাকায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু (<২০%) হয়ে গেলে সেটা তাদের নিরাপত্তাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে।

এটা স্পষ্ট যে ২০০১-২০১১ দশকের মধ্যেই কিছু রাজ্যে হিন্দু জনসংখ্যা পতনের হার বেশ তীব্র। আসাম, কেরালা ও অরুণাচল প্রদেশের ২০০১ ও ২০১১ সালের জনগণনা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে তিনটি রাজ্যেরই একটা বড় অংশ, যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু বা বিপদগ্রস্থ ছিলনা, সেখানে পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। রাজ্যগুলিকে নিয়ে বিশদ আলোচনা এই লেখার পরবর্তী অংশে করা হয়েছে।

আন্দামান ও নিকোবর:

আন্দামান ও নিকোবরে হিন্দু সংখ্যালঘু/হিন্দু বিলুপ্ত এলাকার হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে কিন্তু এটা মূলত নানকৌড়ি ও কার নিকোবরের হিন্দু সংখ্যালঘু অঞ্চলকে খন্ডিত করে নতুন তহশিল গঠন করার ফল। নানকৌড়ি ও কার নিকোবরের তহশিলগুলিতে ধর্মান্তর ঘটে সেখানকার হিন্দু জনসংখ্যা এই পর্যায়ে পৌছে গেছে যা বিবেচনায় আসেনা। নিকোবরের তিনটি তহশিলের মধ্যে দুটি থেকে হিন্দু জনসংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তহশিলগুলি ২০০১ সালে সংযুক্ত থাকার ফলে আমরা ২০০১ ও ২০১১ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনা করতে পারিনা।

উত্তর পূর্বের রাজ্য:

উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির মধ্যে নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম, উভয় যায়গাতেই, হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে এবং মেঘালয়েও তাদের অংশীদারি বিপুল মাত্রায় কমেছে। তিনটি রাজ্যেই হিন্দুরা আজ সংখ্যালঘু। মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশেও হিন্দু জনসংখ্যা প্রভূত হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমানে মণিপুরে হিন্দুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কিছুমাত্র বেশী। নীচের তালিকাতে হিন্দুদের পতনের হার দেখানো হয়েছে। অরূণাচলে বর্তমানে খ্রীস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিকিমের মত রাজ্যেও, যেখানে হিন্দুদের অবস্থা তুলনামূলক ভাল, মোট জনসংখ্যার ১০% ইতিমধ্যেই খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। কেবলমাত্র ত্রিপুরাতেই খ্রীষ্টানদের অংশীদারি ৪.৩৫%। উপজাতিদের প্রায় ১২% ইতিমধ্যেই খ্রীষ্টান হয়ে গেছে। ১৯০১ সালে উত্তর পূর্বাঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা যেখানে ৯৫%-এর বেশী ছিল আজ সেটা প্রায় ৫৩%-তে এসে দাঁড়িয়েছে। খ্রীষ্টানদের অংশীদারি প্রায় ৪৫.০৩%। মণিপুরের লিলং উপত্যকা আর মেঘালয়ের কিছু বিক্ষিপ্ত এলাকা বাদ দিলে অধিকাংশ স্থানে মুসলিম জনসংখ্যা এখনও আশঙ্কাজনক নয়। উত্তর পূর্ব ভারতে হিন্দু জনসংখ্যার পতন এখনও উপেক্ষিত আছে।

মিজোরাম:

মিজোরাম এমন একটা রাজ্য যেখান থেকে হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে। রাজ্যের সব প্রত্যন্ত অঞ্চলেই (২০টা তহশিল) হিন্দু জনসংখ্যা ২০%-র নীচে নেমে গেছে। এই রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন ৩টি তহশিলেও হিন্দুরা সংখ্যালঘু এবং তাদের অনুপাত ২০-৫০%। মাত্র ২টি তহশিলে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মাত্র একটি তহশিলে, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া, তাদের অনুপাত ৬০%-এর বেশী এবং এদের অধিকাংশই বৌদ্ধ চাকমা যারা এখনও ধর্মান্তরিত হয়নি। ত্রিপুরা সংলগ্ন রিয়াং-ই এই রাজ্যের শেষ এলাকা যেখানে এখনও উপজাতিরা আছে যারা এখনও ধর্মান্তরিত হয়নি।

নাগাল্যান্ড:

নাগাল্যান্ডের সবকটি তহশিলেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু। ১৯৫১ সালে নাগাল্যান্ডে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৫৩% যা ২০১১ সালে ৯%-তে পরিণত হয়েছে। এখানে কোন তহশিলই আর হিন্দুবহুল নয়। এমনকি ডিমাপুরের মত স্থানেও, যেখানে বিশাল সংখ্যক হিন্দু ডিমাসা গোষ্ঠী বসবাস করে এবং যেখানকার সাথে আসামের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, আজ হিন্দু জনসংখ্যা মাত্র ৪২%। বাকি এলাকাগুলিতে হিন্দুদের অনুপাত আরও কম। বস্তুত, নাগাল্যান্ড থেকে হিন্দুরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

মেঘালয়:

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে মেঘালয়েই সবচেয়ে দ্রুত হিন্দু জনসংখ্যার পতন ঘটেছে। ১৯৫১ সালের ৭৩% হিন্দু জনসংখ্যা ২০১১ সালে ২১%-এ নেমে গেছে। মেঘালয়ের ৩৯ টি তহশিলের মধ্যে ৩৭ টি-তেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু। কেবলমাত্র একটি তহশিলে (পিনুরলা) হিন্দু জনসংখ্যা বিপদসীমায় আর একটি তহশিলে (খাতারনং লেইটক্রো) হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই দুটি তহশিল প্রধানত সেং খাসি অধ্যুষিত। যদিও ২০০১ সালেই বাকি তহশিলগুলিতে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গিয়েছিল। মেঘালয়ে মূলত তিনটি উপজাতির বসবাস – খাসি, গাড়ো এবং জয়ন্তীয়া। এদের মধ্যে খাসি ও গাড়োদের ধর্মান্তর প্রায় সম্পূর্ন, কেবলমাত্র সেং খাসিরা এখনও টিকে আছে। জয়ন্তীদের মধ্যেও একটা বড় অংশ ইতিমধ্যেই ধর্মান্তরিত হয়ে গেলেও, উল্লেখযোগ্য সংখ্যার এখনও ধর্মান্তর হয়নি।

মণিপুর:

মণিপুর এখনও হিন্দুবহুল হলেও সেটা কেবলমাত্র সংখ্যাতত্বের হিসাবে। এখানে হিন্দু জনসংখ্যা, ১৯৫১ সালের ৮৪% থেকে ২০১১ সালে ৫০.৩% হয়ে গেছে এবং পরবর্তী জনগণনায় খ্রীষ্টানবহুল হয়ে যাবে। মণিপুরের বহির্ভাগ পুরোপুরি ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। শুধু আসাম সীমান্ত সংলগ্ন একটি তহশিলে হিন্দু জনসংখ্যা বিপদসীমায় অবস্থান করছে। কেবলমাত্র মণিপুরের অভ্যন্তরীন ভাগ – ইম্ফল উপত্যকা – যেখানে মেইটিস-দের আধিপত্য বেশী, এখনও হিন্দুবহুল (হিন্দু ও সানামাহী) রয়েছে। মেইটিসরাই সম্ভবত আসামের বাইরে, উত্তর পূর্বাঞ্চলের একমাত্র জনগোষ্ঠী যারা যারা ধর্মান্তরকরণকে প্রতিহত করতে পেরেছে।

অরুণাচল প্রদেশ:

১৯৭১ সাল পর্যন্ত, অরুণাচল প্রদেশে উল্লেখযোগ্য খ্রীষ্টান জনসংখ্যা ছিলনা। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে খ্রীষ্টান জনসংখ্যা ছিল ০.১% যা বাড়তে বাড়তে ১৯৮১ সালে ৪%, ১৯৯১ সালে ১০%, ২০০১ সালে ১৮% এবং ২০১১ সালে ৩৪%-এ পৌছায়। ২০০১ ও ২০১১ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন উপরের মানচিত্রে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে, এই রাজ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও এনিমিস্ট জনসংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে এবং খ্রীষ্টানরাই এখন অরুণাচল প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্থানীয় ডন্যি পোলোর স্থান দখল করছে খ্রীষ্টান ধর্ম। এইভাবে চলতে থাকলে, ২০৩১ সালের মধ্যেই অরূণাচলের অর্ধেকের বেশী জনসংখ্যা খ্রীষ্টান হয়ে যাবে।

অহিন্দু ক্ষেত্র বিশিষ্ট রাজ্য

ওড়িশা

ওড়িশার উত্তর ও দক্ষিণ – উভয় উপজাতিবহুল অংশেই ধর্মান্তরকরণের প্রভাবে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। দক্ষিণে গজপতি জেলার অনেক অংশ, পূর্ন ধর্মান্তরকরণের ফলে, বিগত এক দশকের মধ্যে হিন্দু শূন্য হয়ে গেছে। এটা উল্লেখ করা দরকার যে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে গজপতি জেলাতে হিন্দু জনসংখ্যার ৬% পতন ঘটেছে যা অত্যন্ত বিপদজনক। গজপতির উত্তরে কান্ধামাল জেলাতেও ধর্মান্তরের প্রভাব পড়েছে। রায়গড়, কোরাপুটের মত অন্যান্য জেলাগুলিতেও বিগত কয়েক দশকে খ্রীষ্টান জনসংখ্যা ৫-১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ্যের উত্তরে, রাঁচির উপজাতিবহুল এলাকার সীমান্ত সংলগ্ন সুন্দরগড় অঞ্চলেও ধর্মান্তরকরণের ব্যাপক প্রভাব পরেছে।

তামিলনাড়ু:

তামিলনাড়ুতে ধর্মান্তরকরণের অধিকাংশ রাজ্যের দক্ষিণতম জেলা কন্যকুমারীতে ঘটে থাকে। এই ধারা তখন থেকেই চলে আসছে যখন এই অংশ পূর্বতন ট্রাবাঙ্কর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল যেখানে ধর্মান্তরের হার খুবই বেশী ছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে ১৯৫১ সাল থেকে ব্যাপক হর্মান্তরকরণের ফলে এখানকার খ্রীষ্টান জনসংখ্যা গত ৬০ বছরে, ১৯৫১ থেকে ২০১১-এর মধ্যে, ৩০% থেকে বেড়ে ৪৫% হয়ে গেছে। এখানে চারটের মধ্যে দুটি তহশিলে হিন্দুরা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু। থুথিকুড়ি আর থিড়ুনাভেল্লীও ধর্মান্তরকরণের শিকার হচ্ছে। দুই জেলাতেই খ্রীষ্টানদের সংখ্যা, কাগজেকলমে, ১০-২০% (প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে বেশীও হতে পারে)। থুথিকুড়ি জেলার থিড়ুচেন্দুর ও সাথানকুলাম এবং থিড়ুনাভেল্লী জেলার নাঙুনেড়ি ও রাধাপূরমে খ্রীষ্টান জনসংখ্যার উপস্থিতি লক্ষনীয় যদিও এখনও হিন্দু জনসংখ্যা কোথাও ৬০%-এর নীচে নামেনি।

রাজস্থান ও হরিয়ানা:

রাজস্থান ও হরিয়ানার মেয়ঠ অঞ্চলে হিন্দু ও জৈনদের ব্যাপক পতন দেখা যাচ্ছে। হরিয়ানারতে মেয়ঠ-ই হল একমাত্র জেলা যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু এবং মেয়ঠের অন্তর্গত সবকটি তহশিলেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু। আলওয়ার ও ভরতপুরের বহু তহশিলে হিন্দু জনসংখ্যা, প্রতি দশকে, ৫% করে কমছে, যদিও সেখানকার হিন্দু জনসংখ্যা এখনও ৬০%-এর নীচে নামেনি। হরিয়ানার মেয়ঠ জেলার তাওড়ু-র মত অঞ্চলে, ২০০১ থেকে ২০১১ দশকে হিন্দু জনসংখ্যা ৮% কমেছে আর তারফলে এক দশকের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। এছাড়া, এটাও উল্লেখ করা দরকার যে উত্তর প্রদেশের মথুরাতেও মেয়ঠের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। ২০০১-১১ মধ্যে মথুরার পশ্চিম প্রান্তের তহশিলগুলিতে হিন্দু জনসংখ্যার ২% পতন ঘটেছে। এটা মাথায় রাখা দরকার যে মথুরাতে হিন্দু জনসংখ্যার (৯০%) প্রেক্ষিতে দশকপিছু ২% পতন যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ।

অহিন্দু এলাকায় বিশাল মাত্রায় হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া রাজ্যসকল

যদিও, সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি, যা এক লাখের বেশি, হয়েছে নিম্নলিখিত রাজ্যগুলিতে।

রাজ্য ২০০১ ২০১১ শতকরা বৃদ্ধি
উত্তরাখন্ড ৪.৬৩ লাখ ৫.৭১ লাখ ২৩.৩২%
জম্মু ও কাশ্মীর ৫.৭২ লাখ ৭.৭৭ লাখ ৩৫.৮৪%
মহারাষ্ট্র ৪.৫১ লাখ ১১.৯৫ লাখ ১৬৪.৯৭%
ঝাড়খণ্ড ৮.৩৭ লাখ ১২.৩৫ লাখ ৪৭.৫৫%
বিহার ১৭.৬৬ লাখ ২৩.৯৫ লাখ ৩৫.৬২%
আসাম ৩৪.০৩ লাখ ৪৩.৯৯ লাখ ২৯.২৭%
পশ্চিমবঙ্গ ৬৬.৮৮ লাখ ৮০.৬৭ লাখ ২০.৬১%
কেরালা ৭৪.৩৬ লাখ ৮৮.৭৮ লাখ ১৯.৩৯%
উত্তর প্রদেশ ৬৪.৪২ লাখ ৯০.৫৩ লাখ ৪০.৫৩%
মোট ২.৮১ কোটি ৩.৬৬ কোটি ৩০.২৫%

এই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, এক, বিপন্ন হিন্দু জনসংখ্যার প্রায় ৯০% এই ৯ টি রাজ্যে বাস করে যা ২০০১ ও ২০১১ জনগণনায় পরিলক্ষিত হয়েছে। দুই, বিপন্ন হিন্দু জনসংখ্যার সংখ্যা উত্তর প্রদেশে সর্বাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে (২৬.১১ লাখ), কেরালা (১৪.৩২ লাখ) ও পশ্চিমবঙ্গ (১৩.৯৭ লাখ) যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে। শতকরা হিসাবে মহারাষ্ট্র এই তালিকার শীর্ষে আছে যেখানে বৃদ্ধির হার ১৬৪.৯৭%। ঝাড়খণ্ড (৪৭.৫৫) ও উত্তর প্রদেশ (৪০.৫৩)যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে। প্রত্যেকটা রাজ্যকেই নীচে আরও পরিস্কারভাবে পর্যালোচনা করা হবে।

উত্তরাখন্ড:

উত্তরাখন্ডে শুধ্যমাত্র রুড়কি তহশিলই বিপদসীমায় অবস্থান করছে যেখানে মুসলমান জনসংখ্যা ৪৩%। এই তহশিলে হিন্দু জনসংখ্যা ২% হ্রাস পেয়েছে। তবে এরসাথে যশপুরের (শহীদ উধম সিং নগরের অন্তর্গত) মত আরও কিছু তহশিল আছে যেখানে হিন্দু জনসংখ্যা দ্রুত বিপদসীমার দিকে এগোচ্ছে। এটা মনে রাখা দরকার যে শুরুর দিকে উত্তরাখন্ডে হিন্দু জনসংখ্যার অংশীদারি ছিল ৯৩% (১৯৫১ সালে) পরে সেটা কমতে কমতে ২০১১ সালে ৮৫.৫%-এ এসে পৌছেছে। এছারাও, ভোতিয়াদের মত বহু ছোট ছোট পার্বত্য উপজাতিদের খ্রীষ্টান ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে পৃঃ ১০৫-১০৬ (৪১) যার ফলে বৈচিত্রময় উত্তরাখন্ডের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটের সম্মুখীন।

জম্মু ও কাশ্মীর:

জম্মু ও কাশ্মীরের জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ – এই তিনটি অঞ্চলেই হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। কাশ্মীরের হিন্দু জনসংখ্যা যা ১৯৬১ সালে ৩১% ছিল, সেটা পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের আগমনের ফলে ১৯৮১ সালে ৩৫% হয়, কিন্তু তার পর থেকেই মুসলমানদের বংশবৃদ্ধির উচ্চ হারের ফলে কমে ৩২%-এ নেমে যায়।
জম্মুর পার্বত্য অঞ্চলের সাতটির মধ্যে ছয়টি জেলাতেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু। একমাত্র ব্যতিক্রম হল উধমপুর। রামবন, কিসটয়ার, বাটোটের মত শহরে হিন্দু সংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ২০০১-১১ দশকে, নওশেরা ও রামবনের মত তহশিলে মুসলমান জনসংখ্যা ৫০%-এর বেশী হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রামবন তহশিলে হিন্দুরা ২০০১-১১ দশকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে এবং রিয়াসি জেলাতেও হিন্দু জনসংখ্যা ৫০%-এর বেশী হ্রাস পেয়েছে। ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবেও হিন্দুদেরকে চেনাবের দক্ষিণে সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।
বৌদ্ধদের কম জন্মহারের পরিপ্রেক্ষিতে লাদাখ অঞ্চলেও হিন্দুরা জমির দখল হারাচ্ছে। লাদাখের বহু এলাকায় গিয়ে কাশ্মীরীরা এখন বসতি স্থাপন করছে। কাশ্মীর উপত্যকা থেকে হিন্দুদের বিতাড়িত করার ফলে সেই এলাকা ইতিমধ্যেই হিন্দু শূণ্য হয়ে গেছে।

মহারাষ্ট্র:

ভিওয়ান্ডির মত বড় তহশিলে বিপদসীমায় বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার পরিণতি হিসাবে ২০০১-১১ দশকের মধ্যে, ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে হিন্দুদের সংখ্যাবৃদ্ধির, ৪.৫ লাখ থেকে ১১.৯৫ লাখ, সবচেয়ে বেশী ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। প্রাথমিক অবস্থায় মহারাষ্ট্রের কেবলমাত্র মালেগাও তহশিলেই হিন্দুরা বিপদসীমায় বসবাস করতো। এছাড়া, ২০০১-১১ দশকে, শুধু মুম্বাই জেলাতেই হিন্দু জনসংখ্যা ৩% পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। মহারাষ্ট্রের অধিকাংশ মুসলমানদের বড় অংশকে প্রধানত ঔরঙ্গাবাদের সাথে সাথে মুম্বাই আর থানে এলাকাতে দেখা যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই মালেগাও ও ভিওয়ান্ডি, উভয় স্থানেই হিন্দু জনসংখ্যা ২-৪% কমে গেছে। তাছাড়া, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে, বিশেষত, পূর্ব বিদর্ভের সিরোনচা এবং কামটির মত যায়গায় খ্রীষ্টানদের জনসংখ্যাও বাড়ছে। যা ২০০১-১১ দশকের মধ্যে ২-৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঝাড়খণ্ড:

ঝাড়খন্ডে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে হিন্দুদের সংখ্যা ৪৭% বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৩৭ লাখ থেকে ১২.৩৫ লাখ হয়েছে। উত্তর পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিন পুর্বাঞ্চল – উভয় যায়গার উপজাতিবহুল এলাকাতে খৃষ্টানদের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলমানদের বসতি স্থাপনের ফলে এই রাজ্যের উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ঝাড়খন্ডের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত সিমডেগা জেলাতে হিন্দুরা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু হয়ে গেছে আর পূর্বতন সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত সাহেবগঞ্জ ও পাকুড় জেলাতেও হিন্দুদের অনুপাত প্রায় ৫০% হয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল যে ১৯৯১ থেকে এই রাজ্যের উত্তর পূর্বাঞ্চলে উপজাতিদের ধর্মান্তরকরণের কাজ চরমে পৌছেছে আর তারফলে এই এলাকায় খ্রিষ্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৮০%। ধর্মান্তরের কাজ রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও চলছে।

বিহার:

বিহারের উত্তর পূর্ব অংশ (প্রাক্তন পূর্ণিয়া) বিপুল মাত্রায় মুসলমান অধ্যুষিত যার মধ্যে কিষনগঞ্জ জেলাতে মুসলমানরা ইতিমধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আড়া ও কাটিহার জেলা বিপদসীমায় অবস্থান করছে। এছাড়াও, নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন তহশিলগুলি, যেমন সীতামাড়ি, চম্পারন এই সব এলাকাতেও হিন্দুরা হয় বিপদসীমায় পৌছে গেছে বা তার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বিহারের নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলিতে মুসলমান জনসংখ্যা দ্রুতহারে বাড়ছে। বিহারী মুসলমানরা বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত হওয়ার কারণে উত্তর পূর্ব বিহারে বাংলাদেশীদের জনস্রোতও গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১১ দশকের মধ্যে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে হিন্দুদের সংখ্যা ১৭ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ লাখ হয়েছে।

আসাম:

আসামে হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৫১ সালের ৭৩% থেকে কমে ২০১১ সালে ৬১.৮৮% হয়েছে। এক দশকের মধ্যে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে হিন্দুদের সংখ্যা ৩৪ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ লাখ হয়েছে। নিম্ন আসামের (পশ্চিম আসাম) অধিকাংশ তহশিলে হিন্দু জনসংখ্যা ৬০%-এর নীচে নেমে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণে অধিকাংশ তহশিলেই হিন্দুরা হয় সংখ্যালঘু অথবা বিলুপ্ত। কাল্গাছিয়া, বাঘবর এবং ছাপার-এর মত তহশিলে ২০০১-১১ দশকে হিন্দুদের বৃদ্ধি ঋণাত্মক। এমনকি ব্রহ্মপুত্রের উত্তর অংশতেও সম্প্রতি হিন্দুরা হয় সংখ্যালঘু অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখানে ৯ টা জেলায় (৭ টা নিম্ন আসাম আর ২ টা বারাক উপত্যকা) হিন্দুরা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু। এই পরিণতির মূল কারন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ যা লখিমপুর বা সতিপুরের মত উত্তর আসামের জেলাগুলিকেও প্রভাবিত করছে এবং এরই ফলে নওবৈচা গ্রামীণ তেজপুরের মত তহশিলগুলিতে হিন্দুরা আজ বিপদসীমায় বাস করছে। অন্যদিকে, বারাক উপত্যকার তিনটির মধ্যে দুটি জেলায় হিন্দুরা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু। শিলচর শহর হিন্দুবহুল হওয়ার কারণে কেবলমাত্র কাছাড় জেলাতেই হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। ২০২১ সালের মধ্যেই বারাক উপত্যকায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়ার মুখে। তাছাড়া, উপজাতিদের মধ্যে ব্যাপক ধর্মান্তরের কারণে কাছাড় পার্বত্য অঞ্চলেও হিন্দুর সংখ্যা কমছে। ডিমা হাসাও জেলাতে খ্রীষ্টানদের জনসংখ্যা প্রায় ৩০%।

পশ্চিমবঙ্গ:

পশ্চিমবঙ্গের প্রধানত দুটি অংশে অহিন্দুরা বেশী – ১) মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, মালদা ও বীরভূম দ্বারা গঠিত মধ্যভাগ, যার মধ্যে মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, মালদাতে হিন্দুরা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু ও বীরভূমের কিছু অংশে হিন্দুরা হয় সংখ্যালঘু হয়ে গেছে অথবা বিপদসীমায় বাস করছে। এবং ২) কলকাতা এবং ভাগীরথীর পূর্বপারে অবস্থিত সংলগ্ন দুই ২৪ পরগণা জেলা। দুটি অংশই বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন যার মধ্যে কেবল দক্ষিণে নদীয়া, মধ্য অংশে দক্ষিণ দিনাজপুর ও উত্তরে জলপাইগুড়ি এবং কুচবিহার এখনও হিন্দুবহুল আছে। ২০০১ সালে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে হিন্দুদের সংখ্যা ৬৬ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে, ২০১১ সালে, ৮০ লাখ হয়েছে।

কেরালা:

২০০১ সালে কেরালাতে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৭৩ লাখ – যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। এখানে ৬০%-র বেশী হিন্দু বসবাসকারী অংশকে বিভিন্ন পকেটে ভাগ করা হয়েছে। দক্ষিণ কাসাড়াগোড় ও উত্তর কান্নুরে এখনও একটি খন্ড আছে যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাবহুল। উত্তর কোজিকোড়ে ও দক্ষিণতম কান্নুর নিয়ে গঠিত কেরালার উত্তর-মধ্য অংশেও একটি হিন্দু খন্ড আছে। এছাড়া, মধ্য কেরালা এবং ত্রিচুড় ও পালাক্কাড় কিছু অংশ নিয়ে গঠিত মাল্লাপুরমের দক্ষিণ ভাগে একটি হিন্দু খন্ড আছে। এগুলি ছাড়া আলাপ্পুজা, কোল্লাম, পাঠানামথিট্টা ও তিরুবনন্তাপূরমের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত দক্ষিণভাগেও একটি বড় হিন্দু খন্ড রয়েছে। কেরালার মালাবার এলাকাতে হিন্দুদের সংখ্যা ৫০%-এর সামান্য বেশী। প্রাক্তন কোচিনে তারা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু এবং প্রাক্তন ত্রাবাঙ্কোরে তারা সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজ্যের ১৪ টি জেলার মধ্যে হিন্দুরা ৫ টা জেলাতে ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু, ৫ টা জেলায় বিপদসীমায় বাস করছে আর ৬০%-এর বেশী হিন্দুবহুল মাত্র ৪ টি জেলা। কেরালার কোন জেলাতেই হিন্দুদের সংখ্যা ৭০%-এ নেই। ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে তিরুবনন্তাপূরমে হিন্দুরা বিপদসীমায় চলে এসেছে। হিন্দু সংখ্যালঘু অঞ্চল পালাক্কাড় জেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।

উত্তর প্রদেশ:

৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যার ভিত্তিতে উত্তর প্রদেশের স্থান প্রথম। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল যে ২০০১ সালেও উত্তর প্রদেশে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৬৪ লাখ, যা সেই দশকে কেবলমাত্র কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের থেকে কম। যদিও ২০০১-২০১১ দশকে এই সংখ্যা ২৬ লাখ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১১ সালে ৬০%-এর কম হিন্দুবহুল এলাকাতে বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা ৯০ লাখ হয়ে গেছে। পরবর্তী জনগণনার সময় মেরঠ ও তড়াই আওধ-এর মত তহশিল যুক্ত হবার ফলে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমাদের ধারণা। ২০১১ সালেই তড়াই আওধ-এর উত্রাউলা তহশিলে হিন্দুরা বিপদসীমায় অবস্থান করছে (বাহরিচ ও সরস্বতী জেলার পুনর্বিন্যাসের ফলে ৫০-৬০% হিন্দুবহুল বাহরিচের মত তহশিলকে ২০০১ থেকে ২০১১-এর মধ্যে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার পরিণতি)। উত্তর প্রদেশের রামপুর জেলা ইতিমধ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে এবং আরও পাঁচটি জেলা বিপদসীমায় অবস্থান করছে। রোহিলখন্ডের অন্তর্গত রামপুর-বিজনৌর-বেরেলি-মোরাদাবাদ খন্ডের অনেল তহশিলেই হিন্দুরা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘু হয়ে গেছে বা বিপদসীমায় বসবাস করছে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পরে উত্তর দোয়াব অঞ্চলেই হিন্দুদের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে আর উত্তর দোয়াবের মুসলিম এলাকা দ্রুত বাগপত, গাজিয়াবাদ ও আলীগড় পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। মুজাফফরনগর ও সাহারানপুর জেলার বহু এলাকাতেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এই এলাকাগুলি ছাড়াও, উত্তর প্রদেশের বহু শহরেও হিন্দু জনসংখ্যা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে।

কম বিপদজনক রাজ্য / অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রাজ্য

সিকিম, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক এবং ছত্তিসগড় – এই রাজ্যগুলিতে, ২০০১ এবং ২০১১ উভয় গণনাতেই, হিন্দু জনসংখ্যার কোন অংশই বিপদসীমায় অবস্থান করছেনা। গুজরাটের কচ্ছ জেলার পাকিস্থান সংলগ্ন একটি তহশিলে হিন্দুরা ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিপদসীমায় পৌছে গেছে। একইভাবে, অন্ধ্রপ্রদেশের রায়াচুটি তহশিলে হিন্দুরা বিপদসীমায় পৌছে গেছে। তেলেঙ্গার হিন্দু সংখ্যালঘু এলাকা কেবল হায়দ্রাবাদ শহরেই সীমাবদ্ধ তবে হিন্দু সংখ্যালঘু অঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য – ৬ লাখ। যেহেতু ২০১১ সালের আগে হায়দ্রাবাদের ক্ষেত্রে আলাদা কোন তহশিলের অস্তিত্ব ছিলনা তাই পরিবর্তনের হার পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে হিন্দু সংখ্যালঘু অঞ্চলে হিন্দুদের বসবাস সংখ্যা, যা ২০০১ সালে ৫৫.৬ হাজার ছিল, ২০১১ সালে ১.৩ লাখ হয়েছে – সংখ্যার হিসাবে যেটা যথেষ্ট উচ্চহারে বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধি প্রধানত বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকাতে, ব্যাপকহারে মুসলমান অনুপ্রবেশের ফলে ঘটছে। একইভাবে, গোয়ার মাত্র একটি তহশিলে – সালসেট – হিন্দুরা সংখ্যালঘু এবং তাদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। যদিও গোয়ার ২৬% খ্রীষ্টান জনসংখ্যা সত্ত্বেও এই সংখ্যা বজায় রয়েছে। অবশেষে দিল্লীর পালা। এখানে, ২০০১ সাল থেকেই, একমাত্র দড়িয়াগঞ্জ ছাড়া, আর কোথাও হিন্দু জনসংখ্যা সংখ্যালঘু নয়। এখানে প্রায় ২ লাখ হিন্দু সংখ্যালঘু বা বিপদসীমায় বসবাস করেন, কিন্তু এই সংখ্যা অনেকদিন ধরেই বজায় রয়েছে। এইসব রাজ্যগুলিতে হিন্দু জনসংখ্যার আধিপত্য এখনও বজায় রয়েছে।

হিন্দু জনসংখ্যা পতনের পরিণতি

হিন্দুদের পলায়ন – স্বেচ্ছায় ও প্ররোচিত:

বহু ক্ষেত্রেই হিন্দু সংখ্যালঘু এলাকা ছেড়ে হিন্দুদের চলে যাওয়ার দাবী উঠছে। এই দাবী শুধু পাকিস্থান বা বাংলাদেশ নয়, যেখান থেকে হিন্দুরা চলে আসতে বাধ্য হয়েছে, ভারতেরও অনেক স্থানে একই দাবী উঠছে।

মিজোরামে অনেকবার হিন্দুদের এলাকা ছেড়ে যাবার দাবী উঠেছে। ১৯৬০ সাল থেকেই এই রাজ্যে মিজো উগ্রপন্থীরা অ-মিজো উপজাতি এবং অখ্রীষ্টানদের এলাকা ত্যাগ করার দাবী জানিয়ে আসছে (৭)। ত্রিপুরা সংলগ্ন রিয়াং, যারা ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, ১৯৯৭ সালেই খ্রীষ্টান-মিজো বাহিনীর দ্বারা রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং সরকারিভাবে তারা ফেরার দাবি জানালেও, নিজেরা ফিরতে খুব আগ্রহী নয় (৬)। প্রায় ৩০,০০০ রিয়াং নিজেদের জমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে।

জেহাদি অত্যাচারের ফলে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কাশ্মীরি পন্ডিতদের বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা আজ সর্বজনবিদিত। খুব সাবধানী হিসাব করেও আমরা দেখেছি যে ২.৩৭ লাখ থেকে ২.৮৭ লাখ কাশ্মীরি পন্ডিতকে উপত্যকা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে (৩৫)। বর্তমানে কিছু সরকারী কর্মচারী ও নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া কাশ্মীরে হিন্দুদের বাস্তবিক কোন বসবাস নেই।

সরাসরি চাপের ফলে উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলির মত বাধ্যতামূলক এলাকাত্যাগ ছাড়াও, মালাপুরমের একটা বড় অংশ থেকে নায়াররা, নিম্ন আসাম থেকে কচ, বোড়ো, রাভাস, টিওয়া সহ অন্যান্য ছোট উপজাতিরা , এবং পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কাইরানা থেকে হিন্দুরা পালাতে বাধ্য হয়েছে (জনগণনাতে হিন্দু জনসংখ্যার পতন দশকপিছু ৬%-র বেশী দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়)। জেহাদিদের অত্যাচারের ফলে কিসটওয়ারের মত পার্বত্য এলাকা থেকেও হিন্দুরা পালাতে বাধ্য হয়েছে পৃ ১৮-১৯(৪২)। এটা মনে রাখা দরকার যে হিন্দুদের পলায়ন একালা নির্বিশেষে ঘটে থাকে। কেরালা হোক বা কাশ্মীর, কাইরানা হোক বা নাগাল্যান্ড – খ্রীষ্টান বা ইসলামিক চাপের মুখে হিন্দুদের পলায়ন নিয়মিত ঘটনা।

বৈচিত্রের ধ্বংস:

এই লেখার উদ্দেশ্য যদিও খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ রোধ করা নয়, তবে এটা স্পষ্ট যে এর ফলে অহিন্দু উপজাতীরাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বিশেষ রীতিনীতি ও পরম্পরার ধারক, দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী এই সমস্ত উপজাতীরাই খ্রীষ্টান মিশনারীদের সহজ লক্ষ্য। মিশনারীদের ক্রমাগত আক্রমণে নাগা এবং কুকি/মিজো বিশ্বাসীরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খাসি, গাড়ো, জয়ন্তীয়া, ডল্যি পোলো সহ আন্দামান ও নিকোবরের অন্যান্য উপজাতীগুলিও তাদের অস্তিত্বরক্ষার অন্তিম চেষ্টা করছে। এমনকি মধ্য ভারতের স্বর্ণ সম্প্রদায়, সিকিমের লেপচা এবং উত্তরাখন্ডের ভোতিয়াদের সংখ্যাও ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। খুবই মজার ব্যাপার হল যে বৈচিত্রের ধ্বজাধারী খ্রীষ্টানরাই হল ভারতের বৈচিত্র ধ্বংস করার মূল কাণ্ডারি।

নাগাল্যান্ডেও বহুবার ‘খ্রীষ্টান নাগাল্যান্ডের’ দাবী উঠেছে পৃ ১৮২(৮)। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ অসহানুভূতি প্রকাশের ফলে (৯) এখানকার অখ্রীষ্টান উপজাতিদের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটের মুখে এবং NSCN অখ্রীষ্টানদের উপর তান্ডবলীলা চালিয়েই যাচ্ছে।

মেঘালয়ের মাইলেম-এ বসবাসকারী প্রকৃতীবাদী সেং খাসি উপজাতিরা বহুবার তাদের চিরাচরিত অন্তিম সংস্কার পদ্ধতিতে খ্রীষ্টানদের নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদ করেছেন (২৪)।
অরুণাচল প্রদেশেও হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে (১২)।

দাঙ্গা:

সাম্প্রতীককালে যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে সেগুলির প্রায় সবকটি সেখানে হয়েছে যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পশ্চিমবঙ্গের কালিয়াচক (১০-৩৩% হিন্দু) ও বসিরহাট (৩০-৫০% হিন্দু), কেরালার মারাড (৪৭% হিন্দু), আসামের কোকরাঝাড় (৪০-৬০% হিন্দু), উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগর (৪৬-৫৪% হিন্দু), জম্মু ও কাশ্মীরের কিসটওয়ার (১৫) (৪২% হিন্দু)। টেমলং ও সেনাপতি দ্বারা অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে যুক্ত মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকা প্রায়শই খ্রীষ্টান নাগাদের দ্বারা অবরোধের শিকার হয় এবং বিগত বছরেও এই ঘটনা ঘটেছিল (১১)।

হিন্দুদের নিরাপত্তার কথা বলতে গেলে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, বিশেষত হিন্দুদের স্বার্থে জড়িত ব্যক্তিরা, হিন্দুবহুল এলাকাতেও ইসলামিকদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। সাম্প্রতিক বসিরহাট দাঙ্গা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উত্তর ২৪ পরগণার অন্তর্গত বসিরহাটে হিন্দু জনসংখ্যা ৭৩%। যদিও মূল দাঙ্গার স্থল বসিরহাট-বাদুরিয়া অঞ্চলে (৩৫-৫০%) হিন্দুরা সংখ্যালঘু।

হিন্দু নেতৃত্বের হত্যা:

এই দাঙ্গারই আরেকটা ধরণ হল দক্ষিণ ভারতের কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যগুলিতে, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া এবং আল-উম্মাহ সমেত, বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠন দ্বারা হিন্দু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হত্যা। নীচে আমরা এই সংগঠনগুলির দ্বারা সম্পাদিত হতালীলা বর্ণনা করবো। আশর্য্যজনক হল যে হত্যাগুলি সম্পাদিত হয়েছে ভেল্লোর (২টি হত্যা), রামনাথপূরম, সালেম এবং চেন্নাই-তে [২৬]। আরও আশ্চর্য্যকর হল যে রামনাথপূরম তহশিলে মুসলমান সংখ্যা ২৭% (তামিলনাড়ুর সাপেক্ষে যথেষ্ট উঁচু হার) এবং ভেল্লোর শহরে মুসলমান হার ২৪%। চেন্নাইতে মুসলমানদের জনসংখ্যার হার কম (৯.৪৫%) হলেও তাদের বিপুল সংখ্যার উপস্থিতি (৪.৪ লাখ) আক্রমণকারীদের সহজেই স্থানীয়দের ভিড়ে মিশে যেতে সাহায্য করে। একইভাবে, কর্ণাটকের দক্ষিন কানাড়া [২৭] সহ মাডিকেরি [২৮], সিমোগা [৩২], মাইশোর [২৯] এবং ব্যাঙ্গালোর [২৭] শহরে এই হত্যালীলা চলছে। এক্ষেত্রেও দক্ষিণ কানাড়াতে ২৪% মুসলমান, মাডিকেরিতে ২৩% মুসলমান, সিমোগাতে ২৪% মুসলমান, মাইশোরে ২২% মুসলমান এবং ব্যাঙ্গালোরে ১৬% মুসলমান এবং তাদের বিপুল সংখ্যায় উপস্থিতি (১১.৯ লাখ) কমন ফ্যাক্টর। কেরালার পরিস্থিতি আরও খারাপ যেখানে কেরালার সরকারী হিসাবে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া ২৭ জন ব্যক্তির, অধিকাংশ বিজেপি/আরএসএস ও সিপিএম কর্মী, হত্যার সাথে যুক্ত [৩০]। কান্নুর-এর নারাথ-এ পিএফআই একটি উগ্রপন্থী শিবিরও চালাতো [৩১]। পিএফআই মাইশোরে ছাত্রদের হত্যার সাথে জড়িত ছিল [২৯] এবং পুনে, মুম্বাই ও হায়দ্রাবাদ বিস্ফোরণে যুক্ত ছিল [৩৩]। উত্তর কেরালার মালাবার উপকুলে (যেখানে কান্নুর অবস্থিত) প্রচুর সংখ্যায় মুসলমানের বসবাস এবং ত্রিচুর (১৭%) বাদে বাকি জেলাগুলির জনসংখ্যার ২৫%-এর বেশী হল মুসলমান।

একই ধারা দেখা গেছে যেখানে খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকরা স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে। হিন্দু ধর্মগুরুরা খ্রীষ্টান উগ্রবাদীদের লক্ষ্য। স্বামী লক্ষণানন্দকে কান্ধামাল জেলার তুমুদিবান্দা তহশিলে [৩৭] হত্যা করা হয়েছিল যেখানে হিন্দু জনসংখ্যা ৬৩.৬% আর বাদবাকিদের অধিকাংশ খ্রীষ্টান। ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশেও একই ধারা পরিলক্ষিত হয়েছে যখন খ্রীষ্টান বহুল তহশিলের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু সন্ন্যাসী শান্তি কালী মহারাজ ও জৌলুসমণি জামাতিয়াকে খ্রীষ্টান উগ্রপন্থী দল NLFT (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা) হত্যা করেছে।

ভারতে আঞ্চলিক সংহতির প্রভাব

একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল যে, দীর্ঘদিন ধরে চলা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলির সবকয়টিই সেইসব স্থানে যেখানে অহিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাশ্মীর উপত্যকায় আশির দশকের শেষ থেকে পৃথকীকরণের দাবী চলে আসছে এবং এখনও কোন বিরাম নেই। একইভাবে, নাগাল্যান্ডেও ভারতের স্বাধীনতালাভের সময় থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদ চলে আসছে। একই অভিজ্ঞতা ভারতীয় জাতীয় সেনারও (INA) হয়েছিল। ভারতীয় জাতীয় সেনা নাগাল্যান্ডে পৌছানোর পরে, সেখানকার খ্রীষ্টান আদিবাসীদের আচরণ দেখে, INA কমান্ড্যার, মহম্মদ জামান কিয়ানি স্মৃতিচারণ করেছেন যে – “সীমান্ত এলাকা, যেখানে লড়াই চলছিল, সেখানে মূলত খ্রীষ্টান ধর্মালম্বী নাগা ও চিন উপজাতীদের বসবাস ছিল এবং জাপানী বা INA অপেক্ষা, বৃটিশদের সাথেই তাদের বেশী মিল ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, পালেল ক্ষেত্রে যুদ্ধ যখন স্থিতাবস্থায় পৌছেছে, ইংরেজী কথোপকথনে সক্ষম একজন তরুণ নাগা মহিলা, যিনি আসলে ব্রিটিশদের গুপ্তচর ছিলেন, খবর যোগানকারী হওয়ার আগ্রহ নিয়ে, দ্বিতীয় রেজিমেন্টাল হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করেন। কিছুদিন থাকার পরে, সুযোগ পাওয়া মাত্রই, তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যান!” পৃ ১২৪ [৩৯]। (কিয়ানি মুসলমান ধর্মালম্বী ছিলেন এবং এই স্মৃতিচারণ লিপিবদ্ধ করে পাকিস্থানে চলে যাওয়ার কয়েকবছর পরে। তাই তাঁকে হিন্দু উগ্রবাদী বলে অভিযুক্ত করা যাবেনা)।

একইভাবে, ১৯৬২ সালে চীন আক্রমণের সময়, নওগাঁও ও দাড়াং-এ (নওগাঁও ও দাড়াং- উভয় স্থানেই মুসলমান জনসংখ্যা ৩০%-এর বেশী) পূর্ব পাকিস্থান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে আগত অবৈধ মুসলিমরা সাদা পতাকা ও পাকিস্তানের পতাকা দেখিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল পৃ ১০৭ [৪০]। এটাও খুব লক্ষ্যনীয় যে হিন্দুবহুল এলাকাতে দীর্ঘ সময় ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলেনা। কিছু যায়গায় বিক্ষোভ অবশ্যই হয়েছে কিন্তু কখনই সেটা দীর্ঘমেয়াদি হয়নি – উলফা বা খালিস্থানি আন্দোলনের মত জঘন্য আন্দোলনও, খুব বেশী হলে, ১৫ বছর স্থায়ী হয়েছিল। তামিলনাড়ুতেও, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ভারত থেকে আলাদা হবার দাবী উঠেছিল কিন্তু সেটা গুরুত্ব পায়নি। পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু বা আসামে গড়ে ওঠা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন খুব বেশী প্রভাব ফেলেনি কারণ এগুলি ছিল হিন্দুবহুল এলাকা আর হিন্দুরা ভারতের প্রতি তাদের আনুগত্য বজায় রেখেছিল। এটা প্রমাণিত যে ভারতের সংহতি হিন্দুদের কাছেই নিরাপদ।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted