ছোট ছোট পাকিস্তান, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে!
১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয় তখন বাংলাদেশের ইসলামের রক্ষক কওমি মাদ্রাসার হুজুররা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ছিল (বাংলাকে তাঁরা হিন্দুদের ভাষা বলত)।
একইসাথে একদল লিবারেল মুসলিম ভাষা আন্দোলনের পক্ষেও ছিল। যখন পশ্চিম ভারতীয় মুসলমানরা তাদের উর্দু ভাষা আরবি লিপিতে লেখা শুরু করেছিল তখন থেকেই উর্দুভাষা হয়ে উঠল ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতীক। সুতরাং ১৯৪৭ সালের সেই দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানে যে উর্দু আগ্রাসন শুরু হলো সেই আগ্রাসন পূর্ব পাকিস্তানেও (আজকের বাংলাদেশ) নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল কওমি হুজুর, আলিয়া হুজুর ও জামায়াত সহ সবগুলি ইসলামপন্থী দল। পূর্ব পাকিস্তানে তখন একদল বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী ছিলেন যারা সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, উর্দুর বিপক্ষে। কিন্তু সে সময়ে কওমি মাদ্রাসাগুলোয় উর্দু ভাষার প্রতি এবং পাকিস্তানের প্রতি ছিল চরম উন্মাদনা, চরম ভালোবাসা। আমি আমার মস্তবড় হুজুর দাদার কাছ থেকেই সে সময়কার সেই উর্দুপ্রেম এবং পাকপ্রেমের ইতিহাস শুনেছিলাম। আমার দাদার তো বড় আক্ষেপ ছিল, ১৯৭১ সালে কেন তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিলেও যুদ্ধ করতে পারেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের কতল করতে পারেননি! আমার পূর্বেকার একটি পোস্টে কেন আমার দাদাজান রাজাকার বাহিনীর স্থানীয় লিডার হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের কতল করতে পারেননি তার বিবরণ দিয়েছি।
পাকিস্তানের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার পরেও বাংলাদেশের সরকার তখন বাংলাদেশের বুকে ছোট ছোট পাকিস্তান বা কওমি মাদ্রাসা টিকিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশের সরকার তখন আরব দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সাথে যাতে সম্পর্ক নষ্ট না হয় সেজন্য এই ছোট ছোট পাকিস্তান বন্ধ করে দেয়নি। অবশ্য কথায় যেমন বলে, বাঘের ঘরে ঘোগের বাস কিংবা শর্ষের ভেতর ভূত ঠিক তেমনি খোদ ভারতেই তখন ছিল (এবং এখনও আছে) ছোট ছোট পাকিস্তান। আর সবচেয়ে বড় পাকিস্তান দেওবন্দ কিন্তু ভারতেই! এবং ভারতের সাথে সুসম্পর্কের জেরে বাংলাদেশের মুমিনদের মালাউনানুভূতি জাগ্রত হওয়ার কারণে যে শেখ মুজিবকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং একই কারণে শেখ হাসিনার উপরে গ্রেনেড হামলা হয়েছে সেই মিনি পাকিস্তান সমূহ কিন্তু ভারতেই বেশি রয়েছে! ওই যে দেওবন্দের হুজুররা তাঁরাও কিন্তু উর্দু ভাষাকে ইসলাম এবং মুসলমানের ভাষা মনে করে। তাঁরাও কিন্তু বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে ইসলামী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মনে করে। তাঁরাও কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে মালাউন ভারতের ষড়যন্ত্র মনে করে। তাঁরাও কিন্তু আহমদ শফীর মতোই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা চায় এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে শরিয়া আইন দেখতে চায়। সুতরাং তখন সঙ্গত কারণে কিংবা অসঙ্গত কারণে, যে কারণেই হোক ইসলাম কি জিনিস সেটা শেখ মুজিব ঠিক বুঝতে পারেননি। তাছাড়া তিনি দেখেছেন, খোদ ভারতেই যেখানে লক্ষ লক্ষ কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে উর্দু ভাষায় পাঠদান করা হয় (এমনকি পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক কওমি মাদ্রাসায়ও উর্দু ভাষায় পাঠদান করা হয়) সেখানে বাংলাদেশে এটি থাকলে অসুবিধা কি? আমি ঠিক জানিনা, শেখ মুজিবের এই ভুল সিদ্ধান্তই বা ছোট ছোট পাকিস্তানের সাথে আপোষকামিতাই কি শেখ মুজিবের নির্মমভাবে খুন হবার জন্য দায়ী কি না। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবগুলো কওমি মাদ্রাসায় উর্দু ভাষায় পাঠদান করা হয়। উর্দু ভাষা শেখা সেখানে বাধ্যতামূলক। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসে রয়েছে উর্দু ভাষা। আপনি যদি মাদ্রাসায় গিয়ে কোন হুজুরকে বলেন, “কেন উর্দু ভাষা এখনো রেখেছেন? উর্দু তো আমাদের দেশ ও স্বাধীনতার শত্রু এবং গণহত্যাকারী পাকিস্তানের ভাষা। আমাদের পাঠ্যতালিকায় কেন এখনও বাধ্যতামূলক উর্দু থাকবে? এ দেশটাকে কি এখনও পাকিস্তান মনে করেন?” তাহলে আপনাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলবে যে, তাঁরা পাকিস্তানকে অনুসরণ করে উর্দুভাষা রেখেছে ব্যপারটা তা নয়, বরং ভারতের দেওবন্দকে অনুসরণ করেই উর্দু ভাষায় পাঠদান করা হচ্ছে। এই জায়গায় গিয়ে কিন্তু আপনি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবেন। কারণ, আপনি ভারতের দেওবন্দ আর পাকিস্তানকে ভিন্ন চোখে দেখে অভ্যস্ত।
আমি উর্দুতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারি না, অথচ আমাদের কিন্তু উর্দু শেখানো হয়েছিল। আজ আপনাদের আমার জীবনের গল্প বলিঃ আমি যখন কোরআন হিফজ করে কিতাবখানায় ভর্তি হলাম এবং আমাদেরকে একইসাথে আরবি এবং উর্দু দুটো ভাষাই শেখানো হলো তখন মাদ্রাসা ছুটি হলে বাসায় ফিরে আসলে আমি স্কুলের বইগুলো পড়তাম। আমার ছোটবোনের স্কুলের বই পড়তাম। আমার প্রতিবেশীদের স্কুলের বই নিয়ে নিয়ে পড়তাম। স্কুলের বইয়ে পড়েছিলাম, পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল, পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষা ভাষা চাপিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করেছিল, আর সেই থেকেই উর্দু ভাষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লাম। যেহেতু আমি ছাত্র জমানায় স্টুডেন্ট হিসেবে খারাপ ছিলাম না, সেহেতু দুর্বল মেধার কারণে উর্দু ভালোভাবে শিখিনি এমন দাবি হালে পানি পাবে না।
আমি উর্দুর বদলে আরবির প্রতি অধিক মনোযোগী হতে লাগলাম। এজন্যই আমার কাছে এখন আরবি ভাষা যেমন ডালভাত উর্দু তেমন ডালভাত নয়। আমার এখন জানতে মন চায়, এই যে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে এতদিন পর আলোচনা হচ্ছে এ আলোচনা আগে কেন হয়নি? আগে কেন বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ কওমি মাদ্রাসা নিয়ে কথা বলেনি? তাছাড়া সময় ফুরিয়ে গেলে কথা বলে লাভটাই বা কি?
আরো প্রশ্ন আছে, স্বাধীনতার পর থেকে যে ছোট ছোট পাকিস্তানগুলি আপনারা বাংলাদেশের বুকে রেখে দিয়েছিলেন সেই ছোট ছোট পাকিস্তান যদি আজ বড় পাকিস্তান হয়ে যায় তাহলে এর দায় কে নেবে? এবং সেটাই কি হয়নি? সেই অবহেলিত, পাদপ্রদীপের নিচে থাকা ছোট ছোট পাকিস্তান থেকেই জন্ম নিয়েছে আহমদ শফী, বাবুনগরী, কাসেমী এবং মামুনুল হক গং। আজ এই ছোট ছোট পাকিস্তানের ফসলগুলি বাংলাদেশের মূলধারাকে, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। আজও সেই ছোট পাকিস্তানগুলির নিয়ন্ত্রক ওই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক পরিচয়ধারী জিহাদী, মডারেট মুসলিম ব্যবসায়ী, আর ভদ্রসদ্র রাজনীতিবিদেরা জিহাদের পক্ষে প্রকাশ্যেই কথা বলছে। তাঁরা ছোট ছোট পাকিস্তানের ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা হুজুরদেরকে বাংলাদেশকে বৃহত্তর পাকিস্তানের অংশ বানানোর জন্য জিহাদের ডাক দিতে বলছে। তাঁরা এখন প্রকাশ্যেই বলছে, “আমরা রাজাকারের গর্বিত সন্তান!” তাঁরা এখন প্রকাশ্যেই বলছে, ‘ওই যে হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ দেখছেন সেটি আমরাই তৈরি করেছি!’
ঠিক একইভাবে ভারতেও তাই হচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন ছোট ছোট পাকিস্তানের বাসিন্দা হুজুরদেরকে ব্যবহার করছে মাহমুদুর রহমান গং ঠিক তেমনিভাবে ভারতের ছোট ছোট পাকিস্তানকেও একদল ব্যবহার করছে। পার্থক্য শুধু এই, বাংলাদেশের ছোট ছোট পাকিস্তানের পালনকর্তাদের পদবি রহমান, হোসাইন, খান ইত্যাদি হলেও ভারতীয় ছোট ছোট পাকিস্তানের পালনকর্তাদের পদবি হচ্ছে রায়, ব্যানার্জী, মুখার্জী, বন্দোপাধ্যায় ইত্যাদি।
জেনে রাখুন, আজ যদি মাহমুদুর রহমান আমেরিকা কিংবা ফ্রান্সে আশ্রয় চায় তবে তাঁকে আশ্রয় দেয়া হবে। পক্ষান্তরে আজ যদি মাহমুদুল হাসান গুনবী কিংবা বাবুনগরী আশ্রয় চায় তাহলে আমেরিকা এবং ফ্রান্স তাদেরকে আশ্রয় দেবে না। এই বৈষম্যের কারণ কি? গুনবী এবং বাবুনগরীর পৃষ্ঠপোষক জিহাদী মাহমুদুরকে আশ্রয় দেবেন তার দাড়িটুপি নেই বলে? আর গুনবী এবং বাবুনগরীকে আশ্রয় দেবেন না কেবল দাড়িটুপি আছে বলে? আমার তো মনে হয়, যে আমেরিকা জিহাদী ইলিয়াসকে আশ্রয় দিয়েছে সে আমেরিকার এখন জসিমউদ্দিন রহমানী এবং মাসুদ আজহারকেও রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া উচিত।
শুধু তাই-ই না, যে মহান ধর্মনিরপেক্ষ (?) রাষ্ট্রটি নিজভূমে ছোট ছোট পাকিস্তান তৈরি করে রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশেও ছোট ছোট পাকিস্তান তৈরি করে রাখায় সহযোগিতা করেছে সে রাষ্ট্রটিরও উচিত দেওবন্দী শিক্ষার প্রোডাক্ট মাসুদ আজহারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে সসম্মানে কোরআনে নির্দেশিত কর্মকান্ড পরিচালনা করতে দেয়া।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................