যারা সেদিন বাস্তু হারিয়েছিল

যারা সেদিন বাস্তু হারিয়েছিল :

---------------------------------

আপনারা যারা আমার লেখা পড়েন, তারা সকলেই জানেন যে আমার লেখার এক প্রধান বিষয়বস্তু হলো উপমহাদেশীয় রাজনীতি, দেশভাগ এবং তদুপরি ছিন্নমূল রিফিউজিদের নিয়ে, কারণ আমার নিজের পূর্বপুরুষরা এই বিষাক্ত প্রক্রিয়ার ভুক্তভোগী হয়েছিলেন ।


আজ থেকে আমি পর্যায়ক্রমে এই ছিন্নমূল মানুষরা আদতে কেন বাস্তুহারা হয়েছিল তা নিয়ে তলিয়ে লিখবো । আপনাদের কাছে আহ্ববান রইলো লেখা পড়ার এবং এই প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার । প্রকৃত ইতিহাস জানার অধিকার তাদের আছে এবং প্রকৃত ইতিহাসই একমাত্র বাঙালিকে তার নিজস্থানে বলীয়ান করে তুলতে পারে :

পূর্ববঙ্গ দেশভাগের পরে হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান । আমার পূর্বপুরুষরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা ছিলেন । আজকে এই অঞ্চল স্বাধীন বাংলাদেশ । আমার দিদা, দাদু, ঠাকুমারা কেন বাস্তুহারা হয়েছিল, ইতিহাসের সেই কথায় যাওয়ার আগে যে অঞ্চল থেকে তারা বাস্তুহারা হয়ে এপার বাংলায় আসতে বাধ্য হয়েছিলেন , সেই পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের একটা সাম্প্রতিক অতীতের পরিসংখ্যান আপনাদের সামনে আগে তুলে ধরি । ৮ ডিসেম্বর,২০১১ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভােকেট তথা বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শ্রীরবীন্দ্র ঘােষ, ইউরােপিয়ান পার্লামেন্টে (ব্রুসেক্স) তার ভাষণে ২০০৯-এর জুন মাস থেকে ৩০.১১.১১ তারিখ পর্যন্ত সংখ্যালঘু হিন্দু প্রেমী আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা সরকারের শাসনকালে ওখানে সংখ্যালঘুদের উপর সংগঠিত অত্যাচারের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে তথ্য দিয়েছিলেন :

* ২৫০ জন সংখ্যালঘুকে খুন করা হয়েছে।

* ২১৫ জন মহিলা কিশােরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

* ২,২০০ জনকে মারধর করা হয়েছে।

* ৪,০৫০-টি পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে।

* ২৭০-টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে।

* ১৫০-টি বসতবাটি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুঠ করা হয়েছে এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

* ৩০৬ জন সংখ্যালঘুকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে ।

এটা হলো বাংলাদেশের তথাকথিত সংখ্যালঘু হিন্দু প্রেমী আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের সুখে বাস করার এক টুকরো চালচিত্র ।

যুক্ত বাংলা ভাগ হবার ফলে বন্যার জলস্রোতের মত লক্ষ লক্ষ হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা ইত্যাদি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, অবশ্য বাংলা বিভক্ত হবার আগেই ১৯৪৬ র নােয়াখালি দাঙ্গা থেকেই এর সূত্রপাত । '৪৭-এর পরে ভারতে যারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানের নিপীড়নে বাস্তুহারা হয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছিলো তারা 'উদ্বাস্তু’ নামেই পরিচিত । ১৯৫০ সালে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি সাময়িকভাবে ভারতের এপার বাংলায় উদ্বাস্তু আগমন কিছুটা স্তিমিত করেছিল বটে, কিন্তু একেবারে স্তব্ধ করেনি, কারণ চুক্তির শর্তসমূহ ভারতে যথার্থভাবে কার্যকর হওয়া আর পূর্ব পাকিস্তান সরকার চুক্তির শর্তাবলী সঠিকভাবে কার্যকর না করা এবং অন্যান্য অনেকগুলাে বৈষম্যমূলক আইন পাশ করা । এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু কখনই তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপত্তা বােধ করেনি। এদিকে, ১৯৫০ এর পর ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য তাদের ভিটে মাটি ত্যাগ করেনি যখন কিনা ১৯৫০ এ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে একতরফা সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু নিধনযজ্ঞ চলেছিল । আমার দিদা, দাদু, ঠাকুমার মত বাস্তুহারারা মূলত দুটো সময়কালীন পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভিটে মাটি ত্যাগ করে ভারতের এপার বাংলায় পালিয়ে এসেছে বা আসছে, এক : ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ আর দুই : ১৯৭১ থেকে আজ পর্যন্ত, যা এখনও একটি নিয়মিত চলমান প্রক্রিয়া ।

পাঠক, অনেকেই এবারে প্রশ্ন করবেন কেন আমি বলছি এই বাস্তুহারারা ভারতের এপার বাংলায় পালিয়ে আসাটা আজও একটা চলমান প্রক্রিয়া । তাহলে আমি কারণটা বলি, আপনারা শুনুন : পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংগ্রামের সময় আওয়াজ উঠেছিল :' এদেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের দেশ ।' বঙ্গবন্ধু মস্ত ভুল করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের হাল ধরার পরে পরেই । তিনি কোরান, হাদিসের আলোকে একটা ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু কোরান হাদিসে মূল আদৰ্শতে ভিন্ন ধর্মীরা হলো ইসলামের শত্রু তাই কোরান হাদিসকে তার জায়গায় রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত ভূখণ্ডকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যায়না আর যে সেটা করতে চায়, সে ইসলামের চোখে মোনাফেক হয়ে যায় । বঙ্গবন্ধুকে তাই তাই তার জীবনের বিনিময়ে এর মাশুল দিতে

হয়েছিল । মুজিবর কন্যা আজকের বাংলাদেশে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে এবং 'বিসমিল্লাহ' যোগ করে অধুনা বাংলাদেশের ইসলামিস্টদের হাতই শক্ত করেছে আর তাই বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ইসলামিস্টদের নিপীড়ন হয়েই চলেছে । প্রতিনিয়ত গভীর রাতের আঁধারে তাই আজকের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু বাস্তুহারা হয়ে ভারতের এবাংলায় পালিয়ে আসছে ।

আগামীতে বলার অনেক আছে , চোখ রাখবেন.....................

রেফ : দেশবিভাগ পশ্চাৎ ও নেপথ্য কাহিনী -ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ।

বাংলাদেশের ইতিহাস -রমেশচন্দ্র মজুমদার ।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted