বাঙালির চেনা বিশ্বাসঘাতক : মীরজাফর

------------------------------------------------------

মীর জাফর হল সেই আদিকাল থেকে বাঙালির ব্যবহৃত বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক বিশেষণ । মীর জাফর : সৈয়দ মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান ।


মীর জাফর ছিলো ইরানি বংশোদ্ভূত। বাবা সৈয়দ আহমেদ নাজাফি আর জাফর তাদের দ্বিতীয় সন্তান। পারস্য থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে বাংলায় আসে ভাগ্যান্বেষণে আর এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি করা শুরু করে । বঙ্গ সমাজের অধিকাংশ বাঙালির উপমহাদেশীয় লিপিবদ্ধ ইতিহাস পড়া চোখ দিয়ে দেখলে, আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে অবশ্যই 'মীর জাফর' লোকটা বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক । ব্যাটা নবাবকে কথা দিয়ে কথার খেলাপ করেছিল, নিজের দেশের মানুষের কথা না ভেবে ভিনদেশী ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়েছিল এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূচনায় সহায়তা করেছিল । পাঠক, এতো গেল বঙ্গ সমাজের প্রচলিত ইতিহাস পড়া বাঙালির মীর জাফর সম্মন্ধে মূল্যায়ন । চলুন আজকে আমরা, ইতিহাসের চাপা ছাই একটু ঘাঁটা ঘাঁটি করে দেখি মীর জাফর ঠিক কতটা বেঈমান বা বিশ্বাসঘাতক ছিল :

লিপিবদ্ধ উপমহাদেশীয় ইতিহাস পড়া বাঙালির মীর জাফর সম্মন্ধে এক প্রধান অভিযোগ :

➤মীর জাফর নিজের দেশকে ভিনদেশী ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল । একদম ভুল পাঠক । হ্যা, যা বলছি, তা অনেক ভেবেই বলছি । বাংলা-বিহার-উরিষ্যা তার নিজের দেশ ছিলই না ! মুঘল আমলের বেশীরভাগ মুসলিম শাসকদের বা হোমড়াচোমড়াদের মত তারও ব্যাকগ্রাউন্ড মধ্যপ্রাচ্যের । উপরে আগেই লিখেছি : 'মীর জাফর ছিলো ইরানি বংশোদ্ভূত। বাবা সৈয়দ আহমেদ নাজাফি আর জাফর তাদের দ্বিতীয় সন্তান। পারস্য থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে বাংলায় আসে ভাগ্যান্বেষণে আর এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি করা শুরু করে' । এখানকার মানুষের ভাষাও তার মাতৃভাষা ছিল না । সত্য এটাও যে সিরাজউদ্দৌলা পরিবারও মধ্যপ্রাচ্য থেকে মাত্র কয়েক পুরুষ আগেই এদেশে এসেছিল !

➤এবারে আসি, ইংরেজদের সহযোগিতার প্রসঙ্গে । ইংরেজরা তো বাংলা-বিহার-ঊরিষ্যা দখল করতে চেয়েছিল, তাই নবাবের সেনাপতি মীর জাফরকে মোটা অংকের ঘুষ অফার করেছিল এবং ঘুষ নিয়ে মীর জাফর নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । পাঠক, আবারও ভুল, মোস্ট ভুল ! আদতে, ইংরেজরা মীর জাফরকে সাহায্য করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য, যার বিনিময়ে তারা এই অঞ্চলে বিনা শুল্কে ব্যবসা করতে পারবে এবং রাজকোষ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা যুদ্ধের খরচ হিসাবে তাদের দেওয়া হবে । যুদ্ধ জিতে ইংরেজরা ভোল পালটে, নবাবের ক্ষমতার দিকেও হাত বাড়ায় । মীর জাফর মোহভঙ্গ হয়ে ইংরেজদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা বাচানোর জন্য যখন আপ্রান চেষ্টা শুরু করলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে ! ডাচরা সাহায্যের হাত বাড়ালে মীর জাফর, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে, কিন্তু যুদ্ধে হেরে যায়, চলে যায় তার গদি ।

পাঠক, উপমহাদেশের লিপিবদ্ধ ইতিহাস পড়ে আমরা সকলেই জানি যে, মীর জাফরের গদিতে ইংরেজরা মীর কাসেমকে বসিয়েছিল । তাহলে মীর কাসেমও কি ইংরেজদের থেকে ঘুষ নিয়ে মীর জাফরের সাথে বিস্বাসঘাতকতা করেছিল ? আসলে সব থেকে বড় বিস্বাসঘাতকতার স্বীকার বা একরকমের বোকা বনেছিল মীর জাফর নিজেই ! একজন ঝানু সৈনিক আর প্রাসাদ রাজনীতি বিজ্ঞ হয়েও সে ইংরেজদের চাল ধরতে পারেনি । মীর জাফরের সম্মন্ধে আরও একটা অভিযোগ বাঙালি করে থাকে । নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা আলীবর্দি মীর জাফরকে বিভিন্ন সময়ে কেবল সাহায্যই করেনি, এমনকি তার সৎ বোনের সাথে তার বিয়েও দিয়েছিল, অথচ মীর জাফর সেসব কথা ভুলে সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । তাহলে তো পাঠক, আলীবর্দির রাজনৈতিক ইতিহাসও একটু কাঁটাছেঁড়া করতে হয়, কি বলেন ? আলীবর্দি খাঁর রাজনৈতিক উত্থান হয়েছিল নবার সুজা-উদ-দৌলার (আওরঙ্গজেবের ভাই নয় ) হাত ধরে । কপর্দকহীন মির্জা মুহম্মদ আলীকে সুজা-উদ-দৌলা উচ্চ পদে বসিয়ে ‘আলীবর্দি’ উপাধী দিয়েছিল । আলীবর্দি নবাব সুজা-উদ-দৌলাকে বিভিন্ন যুদ্ধে সাহায্য করলেও, পরে নবার সুজা-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর আলীবর্দি শাসনক্ষমতা নবাবপুত্র সরফরাজ খাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয় । তাহলে পাঠক, বিশ্বাসঘাতক কে নয় ? পাঠক, সত্য হলো, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র রাজা-বাদশাহ-নবাবদের জীবনধারারই একটা অংশ, তাই কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নয় !

যে সময়ের লিপিবদ্ধ ইতিহাসের রেফারেন্স টেনে মীর জাফরকে বাঙালি বেঈমান আখ্যা দেয়, সে সময়ে বাঙালি মোটেও স্বাধীন ছিল না । সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে মুঘল আমলের যত মুসলিম শাসক, সকলেই ছিল বিদেশি । সকলেই মধ্যপ্রাচ্যের কোন না কোন দেশ থেকে কপর্দহীন অবস্থায় ভাগ্যোন্নয়নে এদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল । রবার্ট ক্লাইভ এর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজদের সাথে তাদের তফাৎ হলো : এই মুসলিম শাসকরা এখানে এসে এটাকেই তাদের দেশ বানিয়েছিল, কেউই আর ফিরে যায়নি বা এখানকার সম্পদ তাদের নিজেদের দেশে পাচার করেনি । ভারতবর্ষকে তারা উপনিবেশ না বানিয়ে বরং এক ধর্ম বিজয়ের উল্লাসে মেতেছিল । মীর জাফরকে বিশ্বাসঘাতক বলার আগে বাঙালিকে আরো বিশ্লেষণ করতে হবে আর যে সময়ে এই অঞ্চলে 'দেশ' কন্সেপ্টটাই ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি, সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে 'দেশদ্রোহী' র আখ্যাও দেওয়া যায়না । আসলে মীর জাফর নিজের স্বার্থ রক্ষাকারী এক বেকুব যে, ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় ভুল লোককে বিশ্বাস করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল !

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted