উর্মিমালা
.........................................
স্টেশনের নাম ঘুমঘুম। এই স্টেশন দিয়েই উর্মিমালা কতবার আসা যাওয়া করেছে! উর্মিমালা যদি জানত মুকুল এখন ঘুমঘুম স্টেশনে? চার বছরে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত একটা মেয়ে কি আর ব্যর্থ প্রেমিককে মনে করে রেখেছে? মুকুলেরও তো জীবন থেমে থাকেনি। অফিসের কাজে সারা দেশ ছুটে বেড়াচ্ছে। এত ব্যস্ততায় উর্মিমালার কথা কি আর মনে পড়ে? কিন্তু ঘুমঘুম স্টেশনে আসতে হবে শুনে মুকুলের ঘুমন্ত প্রেমিক মন যেন আগেরকার দিনের মত জেগে উঠেছে। এখানকার বাতাসে তো উর্মিমালারই ঘ্রাণ জড়িয়ে আছে। উর্মিমালা এখন কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সে কি এখনো আমার কথা ভাবে…
শেষ ট্রেন রাত দুটোয়। পৌঁষ মাসের শীত। মুকুল স্টেশনের ভেতরের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে ট্রেনের অপেক্ষায়। স্টেশন গার্ডের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গেছে। মফস্বলের ছোট্ট স্টেশন এখন জনবিরল। রাত এগারোটার বেশি বাজে। গার্ড লোকটা খুব পান খায়। মাফলারে মাথা কান ঢেকে ফিক করে পিক ফেলে আঙ্গুলের ডগায় জিভে চুন নিয়ে বলে, বুঝলেন, সামনের ঘরটায় এসে না হয় বসেন, বাইরে থাকা ঠিক না।
কেন, বাইরেই তো বেশ আছি। মাথার উপর ছাউনি আছে।
গার্ড এবার নিচু গলায় বলল, তা ভালো। তবে এক মাস যাবাদ স্টেশনে একটা ঘটনা ঘটছে। একটা মেয়েছেলেকে রাত-বিরাতে দেখা যাচ্ছে। তা দেখেই সবাই ভয় পাচ্ছে- এই আর কি?
কেন, ভয় পাচ্ছে কেন?
ভয় পাবে না? আত্মহত্যা করেছে যে! সেই মেয়েটাকে এখন স্টেশনে দেখা যাচ্ছে প্রায়ই…
স্টেশনেই দেখা যাবে কেন?
আরে আপনারে তাহলে খুলেই বলি। ঐ যে বাড়িটা দেখছেন, ঐ বাড়ির বউ ছিলো মেয়েটা। তা বাড়িতে মনে হয় অশান্তি ছিলো ট্রেনের নিচে এসে মাথা দিয়েছে। লোকজন বলছে তার আত্মা এখন স্টেশনে ঘুরছে!
আপনি নিজে দেখেছেন তাকে?
না আমি অবশ্য দেখিনি। দেখলেও আমার কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। আমাকে চাচা বলে খুব ডাকত!
ও আপনার পরিচিত নাকি?
আমাদের আগের মাস্টার সাবের আত্মীয় তিনারা। মেয়েটির স্বামীর ভগ্নীপতি ছিলেন স্টেশন মাস্টার। তখন অনেকবার স্টেশনে এসেছিলো। আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলো। আহা বড় ভালো ছিলো মেয়েটি। দেখে বুঝবার উপায় ছিলো না ঘরেতে সুখ নাই। খুব সুন্দর নাম ছিলো মেয়েটার- উর্মিমালা।
উর্মিমালা!
হ্যাঁ।
তার স্বামীর নাম কি কাজি রেদওয়ান?
হ্যাঁ, ঐ তো কাজি বাড়ি। আপনি চিনেন তাদের?
উর্মিমালা আত্মহত্যা করেছে?
এক মাস হলো। আপনি চিনেন তাদের?
না, তেমন করে নয়…
মুকুল স্টেশনের ছাউনি ছেড়ে কিছুটা দূর পর্যন্ত হাঁটে। গভীর মগ্ন এক ভাবনায় সে আচ্ছন্ন। হঠাৎ মনে হয় কেউ যেন তার পিছু পিছু আসছে। পা টিপে টিপে, নূপুরের মৃদু শব্দ তবু রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে দেয়। এ শব্দ তার চেনা। যে ছন্দে এই নূপুর বাজে মুকুল তাকে চেনে কলেজের প্রথমদিন থেকে…। চার বছরে এতটুকু ধূলো পড়েনি…
মুকুল ফিরে চেয়ে দেখে চার বছর আগের উর্মিমালা চেয়ে আছে তার দিকে। মুখটা ফ্যাকাসে, সাদা। মুকুল একটুও ভয় পেলো না। বিহ্ববল হয়ে চেয়ে ছিলো শুধু। উর্মিমালা মুকুলের মুখের কাছে এসে শান্তভাবে বলল, আমি আত্মহত্যা করিনি। স্বামী আর ভাসুর মিলে মেরে রেললাইনের উপর ফেলে রেখেছিলো। তারপর আমার উপর দিয়ে ট্রেন চলে যায়…।
উর্মিমালা হত্যা মামলা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করল। বাদী উর্মিমালার সাবেক প্রেমিক মুকুল মজুমদার। পুলিশ উর্মিমালার স্বামী ও ভাসুরকে গ্রেফতার করে। তারা স্বীকারোক্তি দেয় উর্মিমালাকে হত্যা করে রেললাইনের উপর ফেলে রেখেছিলো। বিচারে দুজনেরই ফাঁসি হয়।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................