আজকে একটা বিশেষ কাজে পুরোনো লেখাগুলো দেখতে বসে দেখি গল্প লেখা হয়েছে ম্যালা! এতগুলি গল্প লিখেছিলাম মূলত ব্লগকে কেন্দ্র করে। ব্লগের সেই দিন আর নেই। ফেইসবুকে গল্প পড়ার লোক নেই। একটা উপন্যাস ৭৫% লিখে আর শেষ করতে বসছি না। এমনই অলস আমি! যাই হোক, নিচের গল্পটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। নতুন করে পড়ে মনে হলো আপনাদেরও পড়তে দেই। প্রশংসা নিন্দা দুইটাই আমার শেরপা ...
উপর নিচ
.......................................
অপলক মানুষ আকাশের পানে চায়। এই কাজটা তারা বংশ পরম্পরায় করে আসছে। কিন্তু আকাশ থেকে কোন জবাব আসে না। তবে সেখানকার প্রতিনিধি হিসেবে জবাব দেন ইমামসাব, ধর্য্য ধরো মিয়ারা! ধর্য্যশীলকে আল্লাপাক পছন্দ করেন। এই বিষয়ে একটা হাদিস আছে...।
কিন্তু মানুষ আর এখন হাদিস শুনতে চায় না। গৃহস্থের পেটে যখন ভাত থাকে, যে মৌসুমে ধান খুব ভাল হয়, হাটে বেচে দুটো পয়সা গাঁটে আসে, তখন ভাল করে গোসল করে, বেশি করে মাথায় তেল মেরে শুক্রবারের জুম্মার বয়ান শুনতে খুব ভাল লাগে। এই ইমামসাব বলেনও ভাল। তার মুনাজাতে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না।
মানুষ এখন সব ফেলে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাড় ভেঙ্গে পড়তে দেখে গাঙের মধ্যে। আজ সকালবেলাও স্কুলঘরটা ওখানে ছিল, এখন সেখানে শুধুই অথৈ পানি। লোকজন ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু চেয়ে থাকে। নদীর উপর তো আর রাগ করা যায় না। তারচেয়ে ভাগ্যকে দোষ দেয়া ভাল। মানুষ ফরিয়াদ জানায়, হে আল্লাপাক, আমাদের রক্ষা করো! এই গজব থেকে আমাদের রক্ষা করো মাবুদ...।
কিন্তু মানুষের পাপের ভারা বড় বেশি হে! মানুষের পাপ যখন সীমালঙ্ঘন করে ফেলে তখন আল্লাপাক এইভাবে তার শাস্তি দেন। নূহ নবীর আমলে মানুষের যখন পাপের ভারা পূর্ণ হয়েছিল তখন আল্লাপাক এইরকম পানির গজব দিয়ে তার উম্মদদের শাস্তি দিয়েছিলেন...।
হুজুরের বয়ানের শ্রোতা এখন কম। জোহরের আযান নিজেই দিয়েছেন। মুয়াজ্জিন ছোকরাটা পানি দেখে আগেই ভেগেছে। মসজিদ না থাকলে তার চাকরিও যে থাকবে না এটা সে বুঝেছে। তাই আগেভাগেই ভাগ্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। ইমাম সাব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছোকরার ভেতরে আল্লার কালাম ছিল না। তাই আল্লাপাকের উপর আস্থা কম। ইমাম সাবের দৃঢ় বিশ্বাস মসজিদের কিছু হবে না। নদী এইদিক এসে বেঁকে চলে যাবে ইনশাল্লাহ! কেউ কোনদিন শুনেছে আল্লার ঘর পানিতে ডুবে? কাল রাতে ওস্তাদজি স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন। তিনিও সেই কথা বললেন। ওস্তাদজি স্বপ্নে আশ্বস্ত করে বলেছেন, বেটা, আল্লার ঘর রক্ষা করবেন আল্লাপাক নিজে, তুমি চিন্তাযুক্ত কেন?
আফসোসের কথা বেশির ভাগ মানুষের ঈমান বড় দুর্বল! এই যে আযান হয়েছে বিশ মিনিট, একটা লোক পর্যন্ত নেই মসজিদে! নামায কি তাহলে আজ একা পড়তে হবে? লোকজনের এখন কোন কাজ নেই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। সারাদিন নাওয়া খাওয়াহীন উসখুখুসকু মানুষগুলো নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। নামায কালামের কথাও ভুলে বসে আছে। আরে গাঙ পাড়ে খাড়ায় না থেকে আল্লাপাকের কাছে মাফ চা! বল, মাবুত, অনেক পাপ করেছি, এইবার মাফ চাই!
ফজল সরকারের বাড়িতে দুপুরবেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত ইমাম সাবের। এই বাড়িও আজ মরা বাড়ির মত। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ভেতর থেকে ভাত তরকারি এলো। আজকের খানাও গরিবী হালের। ভাত তরকারির কোন ছিরি নাই। ঠান্ডা ভাত আর বেগুন দিয়ে টেংরা মাছের ঝোল। ডাল দিতে ভুলে গেলো। ইমাম সাব দুবার ডেকে সেকথা মনে করিয়ে দিলেন। ভেতর থেকে তখন এক মহিলা এসে চরম বিরক্তি দেখিয়ে শব্দ করে ডালের বাটি রেখে গেলো। সাত বছর বয়েস থেকে পরের বাড়িতে খাওয়া অভ্যাস। হুজুর মানুষ বলে সব জায়গাতেই সম্মান পান। তবে অপমানের অভিজ্ঞতাও কিছু আছে। এদের মনমেজাজ এখন ভাল না। নদী ভাঙ্গনে পথে বসার জোগার হয়েছে। খেতে দিচ্ছে এই তো বেশি। ইমাম সাব কিছু মনে করলেন না। মাথা নিচু করে খেয়ে উঠে গেলেন। বেরিয়ে যাওয়ার মুখে ফজল সরকারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।
মুখটা কালো হয়ে আছে মানুষটার। ইমাম সাবকে দেখেও সালাম দিলো না। উল্টো ভুরু দুটো কুঁচকে ফেললো।
ইমাম সাব বিব্রতভাবে বললেন, পানির নামায পড়ন লাগবো। কাল দুপুরে গাঙ পাড়ে নামায। গেরামের সবাইরে থাকতে কন।
ফজল সরকার সিগারেট ধরায়। ভুর ভুর করে ধোঁয়া ছাড়ে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, নামায পড়লে ভাঙ্গন থামবো?
ইনশাল্লাহ!
তাইলে আগেই পড়তেন? ফজল সরকারের কন্ঠে শ্লেষ।
ইমাম সাব চুপ করে থাকেন বিব্রত ভঙ্গিতে। ভাঙ্গন যখন শুরু হয় ইমাম সাব তখন বলছিলেন শুকুর আলহামদুলিল্লাহ !
খারাপ মেয়েছেলেদের একটা পাড়া আছে গ্রামের বাইরে। অনেককাল থেকে ওরা ডেরা বেঁধে আছে সেখানে। এক রাতে সেটা বিলিন হয়ে যায় নদী গর্ভে। ইমাম সাব তখন আকাশে হাত তুলে শুকুর জানিয়ে ছিলেন। এই পাড়া তুলে দেয়ার জন্য ইমাম সাব কম চেষ্টা করেননি। সে প্রায় বছর খানেক আগের কথা। এক জুম্মাবার একদল গ্রামবাসী গিয়ে হামলাও চালায় সেখানে। কিন্তু খানকি* মাগীগুলো* লাঠি বটি নিয়ে মুসল্লিদের উপর পাল্টা হামলা চালায়। শেষে প্রশাসন এসে হস্তক্ষেপ করে দু’পক্ষকে থামায়। কি শয়তানী* দেখো, কতোগুলো এনজিও আর সরকার খানকিগুলোর* পক্ষেই গেলো! বলে উচ্ছেদ করা যাবে না! আল্লার গজব পড়ুক সরকারের উপর! মুসল্লিদের উপর হাত তুলেছে বেশ্যামাগীগুলি*। কত্ত বড় বেয়াদবী! আল্লাঅলা লোকের গায়ে হাত। বছর না ঘুরতেই অবশ্য আল্লাপাক তার নতিজা দেখিয়ে দিয়েছেন। খানকি* বাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে অবশেষে আল্লার রহমতে।
সেই মাগীগুলো* গাট্টি বোচকা নিয়ে রাতের আঁধারে তারপর কোথায় গিয়ে উঠেছে কে জানে। ইমাম সাবের এখন হঠাৎ জানতে ইচ্ছা হলো, ওরা শেষে কোথায় গিয়ে উঠেছে? নদী ভাঙ্গা মানুষের ঠাই হয় রাস্তায়। ওরা নিশ্চয় শহরের রাস্তায় গিয়ে উঠেছে। ইমাম সাব দাড়িতে হাত বুলান। নদীর চরিত্র বড় আজব ।খানকি* বাড়ি থেকে যে ভাঙ্গন শুরু সে ভাঙ্গন আজ মসজিদের দোড় গোড়ায়। সবই আল্লাপাকের ইচ্ছা। মানুষের পাপের জন্য আল্লাপাক শাস্তি দেন। মানুষের উচিত সেই শাস্তি থেকে মাফ চাওয়া। কাল দুপুরে নদীর পাড়ে ইমাম সাব নামায পড়াবেন সেই মাফ পাওয়ার জন্য। আল্লাপাকের ইচ্ছায় নদী ফের শান্ত হবে।
হবে না! ফজল সরকার শুকনো খড়খড়ে গলায় বলে। নামাযে কোন কাজ হবে না হুজুর! আপনে ভিনদেশী মানুষ। নদীর চেহারা দেইখা কিছু বুঝবেন না...।
ফজল সরকারের চেহারা দেখে ইমাম সাব আর কোন কথা বলতে পারে না। নইলে বুখারী শরীফ থেকে একটা হাদিস তিনি বলতে গেছিলেন এ বিষয়ে। আল্লাপাকের পরীক্ষা বিষয়ক এই হাদিসটা ইদানিং তিনি খুব বলছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষের কান দিয়ে বোধহয় এখন কিছু ঢুকছে না। হাদিস কোরআনের কথা শুনলে মুখে উদাসিন একটা ভাব এনে এরা অসভ্যর মত শরীরের নানান জায়গায় চুলকাতে থাকে। প্রথমে বগল, তারপর পাছা...। সব শেষে মাথা গোজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চাষাভূষাদের নিয়ে এই এক সমস্যা। এদের মধ্যে ধর্মকর্ম একদম কম। বড়ই বেদ্বিন এই মানুষগুলো...।
ফজল সরকার বলে, আপনের খবর কি?
ইমাম সাব জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে। কিসের খবরের কথা জানতে চায় ফজল সরকার বুঝতে পারে না।
যাওয়ার আগে দেখা করে যাইয়েন।
ইমাম সাবের মুখ হা হয়ে যায় অজান্তে। বলে, কিসের কথা কন?
কই যাইবেন ঠিক করছেন? এবার একটু বিরক্ত মনে হয় ফজল সরকারকে।
ইমাম সাব অকুল পাথারে গিয়ে পড়েন। কোথায় যাবে সে? ফজল সরকার ধরেই নিয়েছে সব গিয়ে নদীতে পড়বে? এই মসজিদ থাকবে না? ইমাম সাব আর কিছু বলতে পারে না। অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে তার বোকা বোকা লাগে। ফজল সরকার উত্তরের আশা বোধহয় করেননি। অন্যমনস্কভাবে ভেতর বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ইমাম সাব আরো কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি হবে নাকি? খারাপ লক্ষণ। খুবই খারপ লক্ষণ।
ধীর পায়ে মসজিদে দিকে হাঁটতে থাকেন ইমাম সাব। শূন্য মসজিদ। একটা বাঁশের খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকেন। নিজেকে তার একলা এক দ্বীপের বাসিন্দা বলে মনে হয়। এরপর বাস্তুহারা হবেন। চাকরি থাকবে না। এখান থেকে কোথায় যাবেন ঠিক নেই। ভাবতে ভাবতে ইমাম সাবের তন্দ্রার মত আসে। তিনি ভাঙ্গনের শব্দ শুনতে পান। তন্দ্রার মধ্যে বিড়বিড় করে বলেন, বেটা, আল্লার ঘর রক্ষা করবেন আল্লাপাক নিজে, তুমি চিন্তাযুক্ত কেন?...
পরদিন দুপুরে নামাযের আয়োজন হয় নদীর পাড়। দু’রাকাত নফল নামায। ঢাকার কয়েকটা কাগজের সাংবাদিক আসছে। তারা বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে মোনাজাতের ছবি তুলবে। সেই ছবি খবরের কাগজে ছাপা হবে। সারাদেশের মানুষ দেখবে নদী ভাঙ্গন রোধে আল্লাহ রহমত প্রার্থনা করে মোনাজাত হচ্ছে।...
দেখতে দেখতে কালো মেঘে আকাশটা ছেয়ে যায়। ঠান্ডা কনকনে একটা বাতাস এসে গায়ে লাগে।...নদীতে উথাল পাথাল হয়। ঝড়ো বৃষ্টিতে পাড়ের মাটি দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। তীর্যক বৃষ্টি ধারা শরীরে সুচের মত গিয়ে বিঁধে...।
ইমাম সাব মোনাজাত ধরেন। আবেগ ধরা গলায় বলেন, ইয়া রহমানু রাহিম! ইয়া গফুরু রাহিম...নদী ভাঙ্গন থেকে আমাদের রক্ষা কর মাবুত! আমরা কার কাছে যাবো? কোথায় যাবো?...
ইমাম সাবের কন্ঠ ছাপিয়ে এ সময় আকাশে ভীষণ গর্জন হয়। বজ্রপাতে কানে তালা লেগে যায় সবার। তবু মানুষের কন্ঠ আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিতে চায়। সমবেত কন্ঠ ফের উচ্চকিত হয়, ইয়া গফুরু রাহিম... ইয়া রাহমানু রাহিম...
কিন্তু একটা ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা তাদের কন্ঠকে বেশি দূর যেতে দেয় না। উড়িয়ে নিয়ে ফেলে মাঝ নদীতে। তখন বাতাসের ঝাপটায় সেটা একটা গোঙ্গানির মতই শুনতে লাগে...।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................