ফ্রান্সের মত দেশের সেক্যুলার লোকজনরা কেন ইসলামের প্রতি একখানি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল?

জনাব প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ, সম্প্রীতি জানতে পারলাম ফরাসী পার্লামেন্টে ইসলাম ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি আইন পাশ করতে যাচ্ছেন। আপনি সরাসরিই বলেছেন ফ্রান্সে ৬০ লাখ মুসলিমদের মধ্যে এমন অংশ আছে যারা ফ্রান্সের আইনকে বাদ দিয়ে ইসলামিক আইন চায়। ফ্রান্সের ভিত্তি সেক্যুলারিজম আর সেই সেক্যুলারিজমের শত্রু হচ্ছে ইসলাম। নতুন আইনে ফ্রান্সে মসজিদ মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বিদেশ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থদান কঠরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। শিশুদের বাড়িতে জিহাদী শিক্ষা দেয়া হয় বলে বাড়িতে শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করে সমস্ত মুসলিম শিশুদের তিন বছর বয়েসে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হবে… ইত্যাদি।

মাননীয় প্রেসিডেন্ট, বড় পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই ফরাসি সেক্যুলাররাই ইরানের মত চরম আধুনিক একটা দেশকে মোল্লা শাসিত মধ্যযুগীয় একটা দেশে পরিণত হতে মোল্লা খোমিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলো! ১৯৭৮ সালে যখন খোমিনিকে কোন মুসলিম দেশই আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি তখন ফ্রান্স সরকার তাকে আশ্রয় দিয়েছিলো। খোমিনির রাজনৈতিক বিশ্বাস কি সেটা কি ফ্রান্স জানত না? খোমিনি ফিকাহ শাস্ত্রের উপর মসজিদে বক্তৃতা দেয়ার সময় বলতেন, “ইসলাম শুধুমাত্র মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কের আলোচনায় সীমিত নয়। ইসলাম একটি পলিটিকাল ধর্ম। ইসলামের পলিটিক্স এর অন্যান্য নিয়ম-নীতি ও ইবাদতের সাথে জড়িত। যেহেতু সরকারের একটি পলিটিকাল দিক আছে, ইসলামেরও বিভিন্ন পলিটিকাল দিক আছে”। ফ্রান্স সরকার কি তখন এই পলিট্রিকাল ইসলাম কি জিনিস জানত না?এখন তাই বলা চলে ইরানী নারীদের ১৪০০ বছর পিছনে নিয়ে যেতে ফরাসী লিবারালদের খানিকটা ভূমিকা আছে? ফরাসী সেক্যুলার মিডিয়া ও বামপন্থিরা খোমিনিকে ফ্রান্সে হিরোটিক ইমেজ দান করেছিলো। ফ্যাসিস্ট খোমিনি ফ্রান্স থেকেই ইরানে বিপ্লব পরিচালনা করছিলেন। রেজা শাহকে নিয়ে যত অভিযোগ সমালোচনাই থাক তার বিকল্প হিসেবে কি কোন ইসলামিক মৌলবাদীকে বেছে নেয়ার সুযোগ আছে? আজ ফ্রান্সে ঠিক ইরানের মতই ইসলামিক একটা শক্তি নড়েচড়ে উঠতেই আপনার সরকার সেই শক্তিকে এখনি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন যাতে ফ্রান্সকে ইরান বা আফগানিস্থান হতে না হয়! 

ফান্সে আপনাদের নতুন আইন পাশের পক্ষে ৯৯ ভাগ ফরাসী একমত তা জনমত জরিপেই নাকি জানা যাচ্ছে। ফ্রান্সের মত দেশের সেক্যুলার লোকজনরা কেন ইসলামের প্রতি একখানি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল? কেন মুসলিমদের ফ্রান্সে বিপদজনক মনে করা হয় তার একটি ব্যাখ্যা সম্প্রীতি আপনি দিয়েছেন আপনার ভাষণে। আপনি বলেছেন, ফ্রান্সের ঐক্যের প্রধান বন্ধনই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, যারা ধর্মের নামে সেখানে ফাটল ধরাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে’। অর্থ্যাৎ পরিস্কার করে ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে এই লড়াই। কিছুদিনই আগেই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা মসজিদে হামলার পর মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে একটি হাদিস আউড়িয়েছিলো, ‘মুমিনরা হচ্ছে একটি দেহের মত, দেহের একটি অংশে আঘাত প্রাপ্ত হলে যেমন পুরো দেহ আলোড়িত হয় তেমনি কোন মুমিন আঘাত প্রাপ্ত্ হলে সমগ্র মুমিনের একই প্রতিক্রিয়া হয়…। চিন্তা করুন একবার, যে হাদিসটি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পাঠ করেছেন সেই হাদিসে মুসলমানদের একটি দেহের সঙ্গে তুলনা করে সমগ্র মুসলমানদের ঐক্য কেমন প্রতিক্রিয়াশীল ধরণের হবে সেটাই এখানে বলা হয়েছে। এরকম কট্টর জাতীয়তাবাদী হাদিস পাঠ করে নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী মুসলিমরা কি করে মূলধারায় মিশে যাবে? এ ধরণের লিবারাল রাজনীতিবিদরা বিগত পঞ্চাশ বছরে সারাবিশ্বে সেক্যুলারিজমকে ধ্বংস করেছেন এবং করছেন। আপনি নিজেই আপনার ভাষণে ফ্রান্সে রাষ্ট্র থেকে গির্জাকে আলাদা করার আন্দোলনের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। অথচ আপনারাই ফ্রান্সে মাদ্রাসা শিক্ষার অনুমোদন দিয়েছেন যেখানে পলিট্রিকাল ইসলামের একাডেমিক চর্চা হয়!

মাননীয় প্রেসিডেন্ট, বহু বছর ধরে আপনারা বলার চেষ্টা করেছেন, গুটি কয়েক উগ্র জঙ্গি মতালম্বীদের জন্য ইসলাম ও মুসলমানদের দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু আজ যখন ফ্রান্সের ইসলামিক সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে মাদ্রাসা মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছেন তখন গোটা ফরাসী মুসলিম কমিউনিটি আপনাদেরকে ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ বলছে! ভাবা যায় শিল্প সাহিত্যের দেশে মাদ্রাসা! ভাবা যায় ফারাসী দেশে মুসলিম পুরুষরা নারীদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে আপত্তি জানায় এবং শহরের সুইমিং পুলে নারী পুরুষকে আলাদাভাবে সময় বেঁধে দিচ্ছে তারা! তিন বছরের বাচ্চা মেয়েদের মাথায় হিজাব পরানো হচ্ছে। ফরাসী সংস্কৃতিকে মুখের উপর বেয়াল্লাপনা অসভ্যতা বলে গর্ব করছে! মিশেল ফুকোর মত বামপন্থি বুদ্ধিজীবী এখন ফ্রান্সের এই অবস্থা দেখলে কি বলতেন জানি না। কারণ তিনিই ইরানে গিয়ে খোমিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন। হায় লিবারাল! হায় সেক্যুলারিজম!...

মাননীয় প্রেসিডেন্ট, ফরাসী জনগণ আপনাদের আইন পাশকে স্বাগত জানালেও লিবারাল ও মানবাধিকার কর্মীরা কিন্তু আপনাকে এখনি ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ বলে ট্যাগিয়ে ফেলেছে! তারা বলছে মাদ্রাসা ও হিজাব মুসলমানদের অধিকার। আর হ্যান্ডশেক না করা তাদের সংস্কৃতি! এতসব বিরোধীতার সঙ্গে আপনাদের ভোটের রাজনীতিও যে গণেশ উল্টে দিতে পারে জানি। তবু এতসব স্বত্তেও ইসলাম যে একটা জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটা ধর্ম সেটা বুঝার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশে এই পদক্ষেপগুলো নিলে এতক্ষণে নোয়াম চমেস্কি ‘ইসলামফোবিয়া’ ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ বলে ধুয়ে দিতেন। কিন্তু ফরাসী মধ্যপন্থি রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনার পদক্ষেপে ‘নরেন্দ মোদি গন্ধ’ খুঁজে পাবার সম্ভাবনা কম। আপনি বলেছেন সেক্যুলার ফ্রান্সের জন্য সবাইকে লড়তে হবে সেই শক্তির বিরুদ্ধে যারা সেক্যুলারিজমের শত্রু। কোন রকম রাখঢাক না করেই আপনি নাম উল্লেখ করে বলেছেন,’ বিশ্বজুড়ে ইসলাম একটি সঙ্কটে পড়েছে, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও এই ধর্মটি সঙ্কটে’। অর্থ্যাৎ শত্রুকে আপনি ও আপনারা চিহিৃত করে ফেলেছেন। দেখা যাক আগামী বিশ্বে এই চিহিৃত শত্রুর সঙ্গে কতটা কি পেরে উঠেন…।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted