মুসলিম মেয়েদের অধিকার রক্ষার জন্য কখনও নারীবাদী আন্দোলন হয় না
আমাদের মত গ্রীষ্মকালীন দেশে মেয়েদের মোটামুটি ১৩-১৪ বছর বয়সে ঋতুচক্র শুরু হয়। কিন্তু বিবাহের বয়স ১৮ বছর। কারণ এর আগে মেয়েরা এর জন্য শারীরবৃত্তীয় ভাবে উপযুক্ত হয় না। তবে মাতৃত্বের জন্য মোটামুটি ভাবে ২১ বছর ধরা হয় যখন একজন নারী সুস্থ সবল সন্তান ধারণ ও জন্ম দিতে পারে এবং পালন করতে পারে। ২০১২ সালের POCSO অর্থাৎ বাচ্চাদের যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের থেকে বাঁচানোর যে আইন তাতে ১৮ বছর বয়সের আগে কোন মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তার এই আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি হবে।
POCSO আইনে নির্যাতিতার ধর্ম বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। থাকার কথাও নয়। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে আইনের ক্ষেত্রে ধর্মের উল্লেখ থাকবে কেন? আর আমরা তাই ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেই এক শ্রেণীর মানুষ বলতে থাকে, ধর্ম একটাই আর সেটা মানবধর্ম। আমরা বিভাজন সৃষ্টি করে দাঙ্গা ছড়িয়ে দিচ্ছি, দাঙ্গায় প্ররোচিত করছি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তো আবার 'একই বৃন্তে দুইটি কুসুম' গাইতে গাইতে ভেদ বমি করে মুখ দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। যদিও সেই একটি বৃন্তের দেখা এখনও পাওয়া যায় নি।
আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ এত সুন্দর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সব কিছুতেই তাই না চাইতেই ধর্মের কথা এসে যাবেই। POCSO আইনেই একটি মেয়ের পিরিয়ডস হবার পর যদি তাকে যৌন অত্যাচার করা হয় তবে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস হয়ে যাবে যদি মেয়েটি মুসলিম হয় এবং অভিযুক্তের সাথে তার নিকাহ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মেয়েটির অভিভাবক শুধু মাত্র দর্শক ছাড়া আর কিছুই নয়। হিন্দু নাবালক মেয়েদের ভুলিয়ে কিছু খাইয়ে বশীভূত করে ধর্ম পরিবর্তন করে নিকাহ করলে সে তেরো বছর বয়সেও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে আইনত সক্ষম। কারণ মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই অধিকার দিয়েছে। তারপর ওই বয়সে সে মা হবে এবং ভবিষ্যত অন্ধকার কানা গলিতে গিয়ে শেষ হবে। অথবা লক্ষ্নো বিধানসভার সামনে আগুন লাগানো মেয়েটির মত ভবিতব্য হবে অকালমৃত্যু। হিন্দু সংখ্যা কম হয়ে যাওয়া তো আছেই, সঙ্গে আছে অনেক সমস্যা।
উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় অঞ্জলি তিওয়ারি ওরফে আয়েশার বয়স ৩৫ ছিল। তার জন্য পকসো নয়। কিন্তু দিল্লীর ১৭ বছর বা রাজস্থানের ১৪ বছরের মেয়ের জন্যও পকসো দেওয়া সম্ভব নয়। কোর্টের রায় সেটাই বলছে। যাদের কাছে হিন্দুদের অপ্রচলিত সতীদাহ প্রথা নিয়ে এত গরমাগরম ভাষণবাজি করতে দেখা যায়, তারাই এদের ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। নারীবাদী আন্দোলন হয় না, বলিউডের সেলিব্রিটি ছোটাছুটি করে না। বিরোধী দলের নেতা নেত্রীরা টুইটার বিপ্লব করে না। ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি একটাও ডিবেট বা গ্রাউন্ড রিপোর্টিং করে না।
যারা নারীর অধিকার নিয়ে মনুসংহিতার আদ্য শ্রাদ্ধ করে রাতদিন, যারা হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও ধর্মসূত্রের ভুলভাল শ্লোক দিয়ে প্রমাণ করে নারীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের, তারা অন্য ধর্মের সময় একদম শান্ত। অথচ কুর***আন পড়লেই ছত্রে ছত্রে বৈষম্য খুঁজে পাওয়া যায়। এক পুরুষ দুজন নারীর সঙ্গে সমান। এর থেকে বড় আর কি উদাহরণ চাই?
১৯৮৯ সালে 'সতী' বলে একটা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। নাম ভূমিকায় শাবানা আজমি ছিল। পরিচালক ছিল অপর্ণা সেন। এক বোবা অনাথ মেয়ের ঠিকুজি থেকে জানা গিয়েছিল যে মেয়েটি সতী হবে। তাই বিয়ে হয় নি। বটগাছের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। পরে সতী সন্তানসম্ভবা হয় ও বোধহয় মারা যায়। শেষটা মনে পড়ছে না। একটা অপ্রচলিত প্রথাকে এভাবে লোকের কাছে তুলে ধরে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা করে এরা সব বড় বড় নাম আজ। কিন্তু এই নারীবাদী অপর্ণা মুস**লিম মেয়েদের সঙ্গে হওয়া জঘন্য 'নিকাহ হালালা' প্রথায় পিষতে থাকা মেয়েদের যন্ত্রণার কথা দেখায় নি কখনো। শালমা আগা, রাজ বব্বর অভিনীত 'নিকাহ' সিনেমা ছাড়া আর কি কেউ দেখিয়েছে এই বিষয়ে?
যারা নিকাহ হালালা সম্বন্ধে জানেন না, তাদের ছোট্ট করে বলে দিই। কোন কারণে তালাকের পর যদি প্রাক্তন স্বামী আবার স্ত্রীকে ফিরে পেতে চায় তখন অন্য আরেক জনের সঙ্গে নিকাহ করতে হয় এবং তিনটি ঋতুচক্র দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়। তিনটে ঋতুচক্র কারণ যদি মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে পিতার পরিচয় নিশ্চিত করতে সুবিধা হবে। এরপর মোটামুটি তিন মাস পর আবার সে নিজের পুরানো সংসারে ফিরে আসে কিন্তু মাঝখানে বদলে যায় অনেক কিছু। এখন অবশ্য টাকার বিনিময়ে এই তিন মাসের বাধ্যবাধকতা কমেছে। সাধারণত মৌল**ভীরা এই মহান কর্মে ব্রতী হয়। এই যে যন্ত্রণা, এও কিন্তু মৃত্যুর সমান। কিন্তু নারীবাদী প্রগতিশীল বলিউড থেকে মিডিয়া জগত, সবাই নীরব থাকে। একটা মেয়ের তিন মাসের প্রতি মুহূর্তের তিলে তিলে মৃত্যু, কিন্তু কখনো মানবাধিকার কমিশনের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
সতীদাহ এই দেশে কখনো সর্বসাধারণের জন্য সর্বজনগ্রাহ্য একটা প্রথা ছিল না। পরে এই নিয়ে বিশদে বই আকারে লেখার ইচ্ছা আছে। কিন্তু তবুও যারা রাস্তায় মোড়ে মোড়ে প্রচার করছে যে বিজেপি এলে এখানে সতীদাহ আবার চালু হবে, তাদের অন্য রাজ্যে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে বলব। আর একটা খুব ছোট্ট কথা, যদি সতীদাহ এত প্রচলিত প্রথা ছিল তবে আবার বিধবা বিবাহের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল কেন? পরাশর সংহিতার শ্লোক দিয়ে বিদ্যাসাগর এই আইনের সপক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন। যদি সবার সতী হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল তবে এত এত বিধবাদের জন্য কাশী বা বৃন্দাবনের থাকার ঘটনা কি কাল্পনিক?
প্রতিটা সমাজে কিছু প্রথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তখন সমাজ সংস্কার করতে হয়। নতুন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নিয়মের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু একেশ্বরবাদী পর্বতের মত অটল অনড় ইস**লামের সংস্কার কে করবে? এই দেশে তানিষ্ক থেকে রেস্টুরেন্ট থেকে মিডিয়া, সবাই তো পদলেহনে ব্যস্ত। মুসলিম মেয়েদের সে জন্মগত হোক, বল বা ছল পূর্বক ধর্মান্তরিত হোক, তাদের কথা বলবে কে? আছে কোন অপর্ণা সেন, স্বরা ভাস্কর, সাগরিকা ঘোষ, তনুশ্রী পাণ্ডে, শাবানা আজমি, তিস্তা সিতলবাদ, অরুন্ধতী রায়, দীপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, বরখা দত্ত, সাবা নাকভি?
দেবযানী হালদার
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................