ভিরাট হিন্দুত্ববাদীদের নতুন অস্ত্র এখন বয়কট। চীন বয়কট, হালাল বয়কট, বলিউড বয়কট, খানদের সিনেমা বয়কট, মুসলমান ব্যবসায়ী বয়কট। দিকে দিকে শুধু বয়কট, বয়কট আর বয়কট। বয়কট সংস্কৃতির বেশ কিছু ব্যবহারিক মুশকিল আছে। প্রথমত, বর্জনের তালিকায় শুরুর দিকে একটা দুটো নাম থাকলেও, ধীরে ধীরে সেই তালিকাটা বড় হতে থাকে। আর এই তালিকাতে যত বেশি নাম যুক্ত হয়, মনে রাখা তত কঠিন হয়ে পড়ে যে কাকে, কখন, কি কারণে বয়কট করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, আর্থিক বর্জন বা সামাজিক বর্জনের মাপকাঠি কি হবে, সেই বিষয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা না থাকা। একটা গোষ্ঠীকে যে কারণে বর্জন করা হল, অন্য কোন গোষ্ঠীকে বর্জনের কারণ হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই কি পরিপ্রেক্ষিতে এবং কি কি শর্ত পূরণ করলে কোন গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেবে হিন্দু সমাজ; সেই বিষয়ে কোন আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যাচ্ছে। যখন হিন্দু সমাজের একটা অংশ কোন কারণে একজনকে বর্জনের দাবি করছে, আরেকটা অংশ হয়তো সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে অন্য একজনকে বহিষ্কারের চেষ্টা করছে। এতে হিন্দুত্ববাদ সম্বন্ধে মানুষের কাছে একটা বিশৃঙ্খল, খাপছাড়া ধারণা সৃষ্টি হয়। তৃতীয়তঃ, কর্তৃত্বের প্রশ্ন। অর্থাৎ কাকে কেন বহিষ্কার করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী কে? এবং তাঁর কথা বাকি হিন্দুরা মানতে বাধ্য থাকবে কেন?
ভিরাট হিন্দুদের সমস্যা হল, তাঁরা গোলমাল বাঁধিয়ে গা গরম করতে যতটা আগ্রহী, সমস্যার গভীরে গিয়ে তার সমাধান করার ক্ষেত্রে ততটা নন। যদি তাঁরা সেটা চাইতেন, তবে দেখতে পেতেন, বয়কট সংস্কৃতির উন্নততর সমাধান হিন্দুদের নিজেদের ইতিহাসেই আছে। বয়কট বা বর্জন বা বহিষ্কার, কথাগুলোর মধ্যে একটা নেতিবাচক গন্ধ আছে। ভারতবর্ষের অনেকগুলো ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বেছে বেছে একজনকে বয়কট করা, পৃথিবীর বহুসংখ্যক দেশের মধ্যে একটি বা দুটি দেশকে নিজের শত্রু গণ্য করা, বলিউডে এত পদবীর নায়কদের মধ্যে খুঁজে খুঁজে ওই একটি পদবীকে ব্রাত্য করে রাখা; এগুলো আজকের যুগে বড্ড চোখে লাগে। এটা কূটনীতির যুগ। আজকাল মনের বিষ বাইরের লোককে দেখিয়ে লাভ নেই। কূটনৈতিক বিচারে যেটা ঠিক, সেভাবে বলেও দিব্যি লক্ষ্যভেদ করা যায়।
প্রাচীন যুগ থেকেই হিন্দুরা আত্মসচেতন। তাই আমাদের নিয়ম গুলোও সেভাবেই বানানো হয়েছিল। প্রতিটি হিন্দু তার দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য সেই অঞ্চলেরই অন্য হিন্দুদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বাসনপত্রের জন্য স্থানীয় কুম্ভকার, লোহার জিনিসের জন্য স্থানীয় কামার, সোনার জিনিসের জন্য স্বর্ণকার ইত্যাদি। ইংরেজ আমলে যখন হিন্দু যুবকরা কাজের জন্য শহরাঞ্চলে আসা শুরু করলেন, তখনও প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে গড়ে উঠেছিল "হিন্দু মেসবাড়ি" এবং খাওয়ার জন্য ছিল "হিন্দু হোটেল"! এসব প্রতিষ্ঠানে রাঁধুনি, পরিবেশক থেকে শুরু করে কাঁচামাল বিক্রেতা, কয়লাওয়ালা, মিস্ত্রি পর্যন্ত সকলেই ছিলেন হিন্দু। এভাবেই গড়ে উঠেছিল একটা শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনীতি। হিন্দু যত বেশি পড়াশুনা করল, চড়চড় করে তার মধ্যে উদারতা বাড়ল; নিজেকে রক্ষার নিয়মগুলোর উপরেই সে কালিদাসের মত কুঠার চালানো আরম্ভ করল।
আমিনিয়ার বিরিয়ানি, হাজী সাহেবের কাবাব, নাহুমের কেক, ইংলিশ বেকারির পাউরুটি-বিস্কুট; খাবারের মধ্যে দিয়েই বাঙালির বিশ্ব-দর্শন হল। অন্যান্য জিনিসেও বাঙালি সস্তা খুঁজল, পাড়ার দোকানের ভাত নষ্ট হল। বিজাতীয় দোকান উড়ে এসে জুড়ে বসল। ফলে, সমস্যা যখন নিয়ম ভাঙতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে; সমাধানের জন্যেও আমাদের পুরোনো নিয়মেই ফিরতে হবে। আমাদের কাউকে বয়কট করার দরকার নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস আমাদের অবশ্যই স্বধর্মী এবং স্বজাতির দোকান থেকেই কিনতে হবে। কারণ এটাই আমাদের ধর্মীয় নিয়ম এবং ঐতিহ্য। আর ধর্ম পালনের স্বাধীনতা যখন সংবিধান স্বীকৃত অধিকার, তখন নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্য পালন করা থেকে কেউ আমাদের বাধা দিতে পারে না।
কোন দোকানের কর্তা আমাদের স্বধর্মী বা স্বজাতি কিনা, সেটা বোঝার জন্য কোনরকম পতাকা ব্যবহারেরও দরকার নেই। দোকানের ভিতর চিরাচরিত শ্রী শ্রী লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি বা মা কালীর ছবিই যথেষ্ট। ছবি দেখে পণ্য কেনা যেতেই পারে। এবারে এমন অনেক পরিস্থিতি আসতে পারে, যেখানে স্বধর্মী বা স্বজাতির দোকান বা পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতে হবে। তবে বিধর্মীর থেকে স্বধর্মী এবং বিজাতির থেকে স্বজাতি আমাদের কাছে অবশ্যই প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
এর ধর্মীয় কারণ ছাড়াও অন্যান্য বহু কারণ রয়েছে। ভারতে হিন্দুদের মধ্যে এখনো বিপুল সংখ্যক দরিদ্র রয়েছেন। বাঙালিরাও আর্থিক ভাবে ভয়ঙ্কর দুর্বল। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে এর বহু প্রমাণ পাওয়া যাবে। কাজেই অন্য জাতি বা ধর্মের মানুষকে সাহায্য করার আগে প্রত্যেকের উচিত নিজ ধর্ম বা নিজ জাতির মানুষকে সাহায্য করা। নিজের পরিবারের পেট খালি রেখে যে অন্যের পরিবারের মুখে ভাত জুটাতে যায়; তাকে মহান মানুষ নয়, দায়িত্ব জ্ঞানহীন নির্বোধ বলা যায়। একই ভাবে জাতি আমাদের বৃহৎ পরিবার। ধর্ম আমাদের বৃহত্তর পরিবার। পরিবার যার যার, দায়িত্বও তার তার। অতএব অন্যদের দায়িত্ব কাঁধে চাপানোর আগে প্রত্যেকের উচিত নিজেদের বৃহৎ পরিবারের দায়িত্ব ঠিকঠিক ভাবে পালন করা। এতে কোন ভুল নেই, কোন অন্যায় নেই।
বয়কট শব্দটার ভার খুব বেশি। হুটহাট করে এর ব্যবহার করলে আন্তর্জাতিক জগতে হিন্দুদের সম্বন্ধে খুব ভুল একটা বার্তা পাঠানো হয়। যেন হিন্দুরা ভীষণ সংকীর্ণ মনের, নীচু মানসিকতার মানুষ। সেজন্য বয়কট করা উচিত খুব বেছে বেছে। এবং এমন কিছু বিশেষ জিনিসকেই বয়কট করা উচিত, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা সেই বয়কট করা গোষ্ঠীর কাছে খুব শক্তিশালী একটা বার্তা পাঠাতে চাই। বাকি সবকিছুর জন্য আমাদের যুক্তি হওয়া উচিত আত্মসংরক্ষণ। আত্মসংরক্ষণ অর্থাৎ নিজেদের রক্ষা। নিজেদের রক্ষা মানে শুধু শারীরিক রক্ষা নয়, আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক রক্ষাও বটে। আমরা অন্য কোন জাতি বা ধর্মকে ঘৃণা করি না বা কারু বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমরা আমাদের স্বধর্ম এবং স্বজাতির পক্ষে। কারণ জাতিস্বার্থ রক্ষা পেলেই আমাদের ব্যক্তি স্বার্থও সুরক্ষিত থাকবে।
#বয়কট_নয়_আত্মসংরক্ষণ_চাই
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................