ভাস্কর্য নির্মাণকারী নবী সোলায়মান কি হিন্দু ছিলেন?

নবী সোলায়মান কি হিন্দু ছিলেন? 

বাংলাদেশের চরমোনাই পীরের ভাই রেজাউল করিম সম্প্রতি শেখ মুজিবের ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়েছেন, এবং সারা বাংলাদেশ থেকে মূর্তি অপসারণ করতে বলেছেন। কারণ, মূর্তি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। মূর্খ হুজুররা ভাস্কর্যকে যদি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে তাহলে তাদের নবী সোলায়মানকেও তো হিন্দু বলতে হয়। কারণ সোলায়মান নবী তার শাসনামলে তাঁর রাজত্বের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য স্থাপন করেছিলেন (দেখুন কোরআনের সূরা আল ফাতির বা ৩৪ নম্বর সূরা, আয়াত নম্বর ১৩)। 

মোহাম্মদের কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে তাঁর হাদিসের বক্তব্যের বেশ অমিল পাওয়া যায়। যেখানে সরাসরি কোরআনে নবী সোলায়মানের ভাস্কর্য স্থাপনের ব্যাপারটাকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে হাদিসে আমরা দেখতে পাই, মোহাম্মদ ভাস্কর্য এবং ছবি আঁকার বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন। ইসলামে মূর্তিপূজার বিষয়টা সবসময়ই নিষিদ্ধ। মূর্তি বানানো বা মূর্তি রাখা সবসময়ই নিষিদ্ধ। ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, দুনিয়ার কোন নবী কখনোই মূর্তি বানানো বা মূর্তি রাখা এমন কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না; বরং নবী ইব্রাহিম মূর্তি ভাঙ্গার কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু ভাস্কর্যের ব্যাপারটা আলাদা, ভাস্কর্য বানানোর ক্ষেত্রে বা ভাস্কর্য রাখার ক্ষেত্রে মোহাম্মদের পূর্ববর্তী নবীদের আপত্তি তো ছিলই না, বরং নবী সোলায়মান নিজেই শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য বানিয়ে রাখতেন। সুতরাং এখন যে মূর্খ হুজুররা ভাস্কর্য এবং মূর্তিকে একই বিষয় বলে দাবি করে তারা কি জানে যে, সরাসরি ইসলামী শরিয়া আইনেও ভাস্কর্য এবং মূর্তিকে একই জিনিস বিবেচনা করা হয়নি? যদি ভাস্কর্য এবং মূর্তি ইসলামী শরীয়া আইনে একই জিনিস হত তাহলে যে নবী সোলায়মান কোনদিন মূর্তি বানাননি, তিনি কিন্তু অনেক ভাস্কর্য তৈরি করেছেন এবং তাঁর ভাস্কর্য বানানোর ব্যাপারটাকে কোরআনে মহিমান্বিত করে তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য একথা ঠিক যে, মোহাম্মদ তাঁর জীবনের শেষভাগে এসে ভাস্কর্য বানানো, ভাস্কর্য রাখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি সব কিছুকেই চূড়ান্ত নিষিদ্ধ করে গেছেন। 
সহীহ আল-মুসলিমের বুক নাম্বার ১২, হাদিস নং ২২৮৭ তে আছে মোহাম্মদ তার সাহাবী আলীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : 
ألا تدع تمثالا الا طمسته ولا قبرا مشرفا الا سويته
অর্থ : কোন ভাস্কর্য পেলে সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, আর কোনো উঁচু কবর পেলে সেটাকে সমান করে দেবে। 
অন্য একটি বর্ণনায় আছে : 
ولا صوره الا طمستها 
অর্থ : আর কোন ছবি পেলে তাকেও নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। 

মোহাম্মদ বিভিন্ন হাদিসে মূর্তি এবং ভাস্কর্যের যেমন বিরোধিতা করেছেন তেমনিভাবে তিনি ছবি আঁকারও বিরোধিতা করেছেন। একটি হাদিসে আছে : 
ان اشد الناس عذابا يوم القيامه المصورون 
অর্থ : কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে চিত্রাংকনকারীদের। 
যখন ক্যামেরা আবিষ্কার হল এবং এর বহু পরে ক্যামেরা মোবাইল আবিষ্কার হল তখনও পর্যন্ত দুনিয়ার সব আলেম প্রায় একযোগে বলেছিল, ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হারাম। কারণ, নবীর যুগে মানুষ যে হাতে ছবি আঁকত সেটি যেমন নবী নিষিদ্ধ করেছেন ঠিক তেমনিভাবে এই যুগেও যে ক্যামেরা বা যন্ত্রের মাধ্যমে ছবি আঁকা হচ্ছে সেটিও নিষিদ্ধ। ঠিক যেমন নবীর যুগে মানুষ হাতে মদ বানাত আর এখন আধুনিক যুগে এসে মদ কারখানায় তৈরি হয়, আর হাতে বানানো মত যেমন হারাম কারখানায় তৈরি করা মদও তেমনি হারাম। ইসলামী শরীয়া আইনের মূলনীতি হচ্ছে, যে বিষয়টা এনালগ নবীর যুগে হারাম ছিল সেটি ডিজিটাল বর্তমান যুগেও হারাম। সোজা কথায়, যে জিনিস সে সময়ে হাতে তৈরি করা হতো এবং নবী সেটিকে হারাম ঘোষণা করেছেন সেটি যদি বর্তমানে যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয় তবুও সেটা হারাম। যন্ত্র কেবল কাজকে সহজ করতে পারে। যন্ত্র হারামকে হালাল করতে পারে না। 

সুতরাং হুজুররা ইদানিং যে ফতোয়ার গুটি উল্টে দিয়ে বলে, “ইসলাম প্রচারের স্বার্থে ছবি তোলা এবং ভিডিও করা জায়েজ” তাদের এই ফতোয়াটা তাদের নিজেদের সাথে, নিজেদের কেতাবের সাথে এবং নিজেদের বিশ্বাসের সাথেই চরমভাবে সাংর্ঘষিক। ছবি তোলার বিষয়ে হানাফী মাজহাবের ফতোয়া কি, চলুন দেখা যাক :
ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়ার প্রথম খন্ডের 162 নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা আছে : “শরীয়ত যে সমস্ত জিনিসকে হারাম ঘোষণা করেছে, তা সর্বাবস্থায় হারাম। চাই দুনিয়ার কাজের জন্য হোক। চাই দ্বীনের কাজের জন্য হোক। দ্বীন প্রচারের জন্য আল্লাহ তা’আলা কোন হারাম কাজের সাহায্য নিতে বলেননি। তাছাড়া হারামের সাহায্যে কোনদিন দ্বীনের প্রচার হতে পারে না। বরং দ্বীনের দাফন হতে পারে। সুতরাং ইসলাম প্রচারের স্বার্থে হলেও কোন প্রাণীর ছবি বা দৃশ্য ভিডিও করা বা তা সিনেমা-টেলিভিশনে দেখানো নাজায়িয।”
(ইমদাদুল মুফতীন ৯৯১,  ফাতাওয়ায়ে শামী ০৬/৩৪৯) 

আমাদের বর্তমান যুগের রসালো হুজুররা টিভি প্রোগ্রামে যায়। তাদের বক্তব্যগুলো ইউটিউবে প্রচার করে। বিভিন্ন প্রোগ্রামে গিয়ে গ্রুপ ছবি এবং সেলফি তোলে। আর এইসব কিছুই তারা করে ‘ইসলাম প্রচারের স্বার্থে’। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম প্রচারের স্বার্থে ছবি তোলার মতো চরম হারাম কাজটি যদি জায়েজ হয়ে যায় তাহলে ইসলাম প্রচারের স্বার্থে ভাস্কর্য বানানো কেন জায়েজ হবে না? ধরুন বিশিষ্ট ইসলামিক ব্যক্তিবর্গ যেমন - আহমদ শফী, এরদোগান, জাকির নায়েক ওঁদের ভাস্কর্য যদি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়; যদি নবী মোহাম্মদ এবং তার সাহাবীদের ভাস্কর্য ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপন করা হয় তাতে তো ইসলামেরই প্রচার হবে, তাই না? মানুষ যত বেশি নবীর, সাহাবীদের, জাকির নায়েকের, এরদোগানের এবং আহমদ শফীর ভাস্কর্য দেখবে ততই তো মনের মধ্যে ইসলাম জাগ্রত হবে। তাই নয় কি? 

শেষে আবারও প্রশ্ন রেখে গেলাম : ভাস্কর্য নির্মাণকারী নবী সোলায়মান কি হিন্দু ছিলেন?

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted