প্রতাপ উৎকলেশ্বর বিগ্রহ কাকা বসন্ত রায়ের হাতে তুলে দিলে বসন্ত খুব খুশি হলেন, অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করলেন সেই বিগ্রহ। প্রতিষ্ঠা করা হল গোবিন্দদেবের বিগ্রহটিকেও। প্রায় একই সময় প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করলেন দেবী যশোরেশ্বরীকেও।
কিছুদিনের মধ্যেই উড়িষ্যা বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে বৈশাখী পুর্ণিমার পুণ্য তিথিতে ধুমঘাট দুর্গে প্রবল ধুমধামের সঙ্গে প্রতাপের দ্বিতীয়বার রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হল। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় প্রায় একশ বছর পর অনুষ্ঠিত রায়গড় দুর্গে “মহারাষ্ট্র জীবন প্রদীপ” শিবাজীর রাজ্যাভিষেককে। কিন্তু এই ঘটনার পরেই শুরু হয়ে গেল গৃহবিবাদ। এই ধরণের ঘটনা যে ঘটবে তা বুঝেই বিচক্ষণ শ্রীহরি মৃত্যুর আগে পুরো রাজ্যকে দুভাগে ভাগ করে প্রতাপকে দশ আনা এবং ভায় বসন্ত রায়কে ছআনা দিয়ে যান। এতদিন সবকিছু ঠিকঠাক চললেও প্রতাপের তীব্র স্বাধীনতাস্পৃহা এবং মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধং দেহী মনোভাব শান্তিপ্রিয় বসন্ত রায়কে বিচলিত করে তুলল। অন্যদিকে প্রতাপও কাকার এই সদাপ্রশান্ত এবং স্থিতিশীল জীবন দর্শনের তীব্র বিরোধী ছিলেন। ফলে রাজ্যবিভাগ অনিবার্য হয়ে উঠল। এই সময় প্রতাপ কাকার থেকে উপযুক্ত জায়গার বিনিময়ে সমুদ্রতীরবর্তী চাকসিরি পরগণাটি দাবী করে বসেন, আসন্ন যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য এবং একটি শক্তিশালী নৌবহর নির্মাণের জন্য এই অঞ্চলটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু বসন্ত রায় কিছুতেই এই দাবী মেনে নিলেন না। পূর্ববঙ্গে এখনও একটি প্রবাদ শুনতে পাওয়া যায় “সারা রাত ঘুরে মরি, তবু না পাই চাকসিরি”। এ ঘটনায় প্রতাপ কাকা বসন্ত রায়ের ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। যাইহোক পূর্ববঙ্গে আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য চন্দ্রদ্বীপরাজ (বাকলা) কন্দর্পনারায়ণের মহাবীর পুত্র রামচন্দ্রের (রামচন্দ্র পোর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের সঙ্গে বহু যুদ্ধ জেতেন, ভুলুয়ারাজ লক্ষণমানিক্যকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীয় রাজধানীতে নিয়ে আসেন) সঙ্গে নিজের একমাত্র মেয়ে বিন্দুমতীর বিয়ে দিলেন প্রতাপ। এহেন রামচন্দ্র কিন্তু প্রতাপের বশ্যতা স্বীকার করেননি। প্রতাপ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে বন্দী করেন, শোনা যায় এরকম যে ঘটতে পারে সে ব্যাপারে বসন্ত রায় আগেই রামচন্দ্রকে সতর্ক করেছিলেন। যাইহোক স্ত্রী বিন্দুমতী এবং শ্যালক কুমার উদ্যাদিত্যের সহায়তায় রামচন্দ্র প্রতাপের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে যান এবং যশোহর ছাড়ার পূর্বে তোপধ্বনি করে প্রতাপকে তাঁর পালানোর ব্যাপারটি জানিয়ে দিয়ে যান সদর্পেই। অপমানিত প্রতাপ তাঁর পিছুধাওয়া করলেও তাঁকে ধরতে পারেননি। এক্ষেত্রেও প্রতাপের সমস্ত রাগ গিয়ে পুঞ্জীভূত হল কাকা বসন্ত রায়ের ওপর, কেননা নানা সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে তাঁর ধারণা হল রামচন্দ্রকে প্রতাপের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলেছেন বসন্তই। এই সন্ধিক্ষণে, বাৎসরিক পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে কাকা বসন্ত রায়ের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেলেন প্রতাপ, যা অগ্রাহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। এখানেই ঘটে গেল একটি মারাত্মক ট্র্যাজেডি। নির্দিষ্ট দিনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে কাকার বাড়ী পৌঁছলেন সন্দিগ্ধ প্রতাপ। বসন্ত রায়ের ছেলে গোবিন্দ তাঁর বাবাকে প্রতাপের এসে পৌঁছনোর সংবাদ দিতে গেলেন। বসন্ত এই সময় সান্ধ্যকালীন পূজার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। একজন পরিচারককে নির্দেশ করলেন গঙ্গাজল আনার জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে “গঙ্গাজল” ছিল বসন্ত রায়ের অত্যন্ত প্রিয় অস্ত্র এবং এ তথ্য প্রতাপের অজানা ছিল না সুতরাং প্রতাপ কাকার এই আদেশ শুনতে পেয়ে মনে করলেন তাঁকে খুন করার জন্যই কাকা ওই পরিচারককে উপরোক্ত অস্ত্র আনতে আদেশ দিচ্ছেন । তক্ষুণি আত্মরক্ষার্থে নিজস্ব তরবারি বের করে ফেললেন প্রতাপ। গোবিন্দ যে মুহুর্তে দেখলেন বসন্ত রায় আক্রান্ত হতে চলেছেন, বাবাকে প্রতাপের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজের অস্ত্র ছুঁড়ে দিলেন প্রতাপের দিকে–কিন্তু সে অস্ত্র লক্ষ্যচ্যুত হল। স্বভাবতই আতঙ্কিত এবং ক্রুদ্ধ প্রতাপ গোবিন্দকে তড়িৎ গতিতে আক্রমণ করলেন। ফল সহজেই বোঝা যায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিহত হলেন গোবিন্দ। এক বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি হল মুহুর্তের মধ্যে। দুপক্ষের লোকজনই সশস্ত্র হয়ে পরস্পরকে আক্রমণ শুরু করল। এই অবসরে খোলা তরবারি নিয়ে প্রতাপ ঢুকে পড়লেন বসন্ত রায়ের ঘরে। ভীত বসন্ত রায় আত্মরক্ষার্থে এবার সত্যিই “গঙ্গাজল” আনতে আদেশ দিলেন। কিন্তু হায়! তখন বড় দেরী হয়ে গেছে। প্রতাপের তরবারির কঠিন আঘাতে মুহুর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বসন্ত রায়ের ছিন্ন মাথা। পিতৃব্য এবং ভ্রাতৃরক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল প্রতাপের হাত। নিয়তির পরিহাস ছাড়া কিই বা বলা যায় একে! বসন্ত রায়ের অন্য পুত্রেরা পিতৃশোকে পাগলের মত হয়ে প্রতাপকে আক্রমণ করলেন। অস্ত্রচালনায় পটু প্রতাপ তাঁর রণদুর্মদ বন্ধুদের সাহায্যে তাঁদের অতি সহজেই পরাজিত এবং একে একে হত্যা করলেন। বসন্ত রায়ের স্ত্রী কনিষ্ঠ পুত্রকে কচুবনে লুকিয়ে রখেন, প্রতাপ তাকে পরে উদ্ধার করে নিজের স্ত্রীর কাছে দেন বড় করে তোলার জন্য। বসন্তের স্ত্রী সহমৃতা হলেন। বসন্ত রায়ের শোকসন্তপ্ত জামাতা রূপরাম বসু বালক কচুকে প্রতাপের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য বসন্ত রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিজলী–কাঁথি রাজ ঈশা খাঁ মশোন্দরীর শরণাপন্ন হলেন। ঈশা খাঁর সেনাপতি বলবন্ত সিং এই গুরুদায়িত্ব নিলেন। ঈশা খাঁর তরফ থেকে প্রচুর উপহার নিয়ে প্রতাপের কাছে পৌঁছলেন বলবন্ত। ধূর্ত বলবন্ত জানতেন বলপ্রয়োগ করে কিছুই হবে না অতএব তিনি ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রতাপকে প্রতারণা করে কচু রায় কে উদ্ধার করে নিয়ে হিজলী পৌঁছলেন। রূপরাম কচুরায়কে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন, খুশি হওয়ার পালা ঈশা খাঁরও কেননা তিনি উদ্ধার করে দিতে পারলেন বন্ধুপুত্রকে। কিন্তু ঈশা ও বলবন্ত এও বুঝলেন প্রতারিত প্রতাপ এত সহজে তাঁদের ছেড়ে দেবেন না, প্রতিশোধ প্রতাপ নেবেনই। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তাঁরা যুদ্ধপ্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এবং বাস্তবে ঘটলও তাই। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জল এবং স্থলে দুদিক থেকে হিজলী আক্রান্ত হল। বিশাল নৌবহরের সাহায্যে জলে হিজলীর ওপর আক্রমণের ছক সাজালেন নৌসেনাধ্যক্ষ পর্তুগীজ রডা। আর ডাঙায় আক্রমণের নেতৃত্ব দিলেন শঙ্কর, সূর্যকান্ত,মদনমাল,চমুপতি।স্বয়ং প্রতাপ থাকলেন আক্রমণের পুরোভাগে। এ আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা ঈশা খাঁর ছিল না। তবুও তিনি লড়লেন সাধ্যমত।আঠের দিনের মাথায় একটি গোলার আঘাতে তিনি প্রাণ হারালেন। সমগ্র হিজলী তখন অবরুদ্ধ, রডার ক্রমাগত গোলার আঘাতে হিজলী দুর্গ বিদ্ধস্ত। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর বলবন্তও প্রাণ হারালেন। ভেঙে পড়ল সব অবরোধ। নির্মম ভাবে লুণ্ঠন করা হল হিজলী। কিন্তু হায়! যে কচু রায়কে পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রতাপ এই ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধ লড়লেন,তাঁকে উদ্ধার করতে পারলেন না। দুরদর্শী রূপরাম প্রতাপের আক্রমণের শুরুতেই কচু রায়কে নিয়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হয়ে যান। আসলে তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন যে এই যুদ্ধের কি পরিণাম হতে চলেছে। হতাশ প্রতাপ অগত্যা দুজন উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারীর হাতে হিজলীরাজ্যের শাসন ও রাজস্ব আদায়ের ভার দিয়ে সসৈন্যে যশোরে ফিরে এলেন। দক্ষিণবঙ্গের একটি বড় অংশও চলে এল প্রতাপের অধিকারে। ইতিমধ্যেই প্রতাপ জানতে পারলেন যে পার্শ্ববর্তী বিক্রমপুরের শাসন কর্তা চাঁদ রায় ও তাঁর ভাই কেদার রায়ও স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনে ব্রতী হয়েছেন এবং প্রতাপের সঙ্গে রচিত মিত্রতাসূত্র ছিন্ন করার জন্য তাঁরা বদ্ধপরিকর। স্বভাবতই প্রতাপ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সেনাপতিদের সঙ্গে গভীর মন্ত্রণার পর অতর্কিতে বিক্রমপুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতাপ। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে গেল বিক্রমপুর। এই ব্লিৎজক্রীগের ধাক্কা সামলাতে পারলেন না চাঁদ রায়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলেন বিক্রমপুরাধিপতি চাঁদ রায়। চতুর প্রতাপ সন্ধি করে ফেললেন চাঁদ রায়ের সঙ্গে। মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে আগামী লড়াইয়ে আরো একজন সঙ্গী বাড়িয়ে নিলেন তিনি।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................