শশাঙ্কের কলঙ্কমোচন আমরা করে ফেলেছি।

Stay Conneted

মহারাজা শশাঙ্ক‚ শ্যামাপ্রসাদ‚ লক্ষ্মণ সেন বা নেতাজির মতোই আরেক হতভাগ্য বাঙ্গালী হলেন সম্রাট ধননন্দ। 

শশাঙ্কের কলঙ্কমোচন আমরা করে ফেলেছি।

 নেতাজির অস্পৃশ্যতা বছর খানেক মতো ছিলো। আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করার পরে তাদের প্রতি মানুষের উন্মাদনা দেখে কংগ্রেসী আর কমিউনিস্ট নেতারা যখন বুঝেছে নেতাজীকে খিস্তানোর থেকে তার গুনাগুন করলে তাদের লাভ বেশি‚ তখনই নেতাজি ভিলেইন থেকে হিরো হয়ে গেছেন। (অফিসিয়াল ন্যারেটিভের কথা বলছি)

যে শ্যামাপ্রসাদ বাঙ্গালী হিন্দুকে নিজের হোমল্যান্ড এনে দিলো‚ সেই শ্যামাপ্রসাদকেই বাঙ্গালী এতদিন অপমান করে গেছে কমিউনিস্ট ব্রেনওয়াশের শিকার হয়ে। যে ছেলে নিজে পূর্ব বাংলা থেকে পালিয়ে এসে শ্যামাপ্রসাদের তৈরী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে প্রাণ বাঁচানোর জন্য‚ সেও ভদ্রলোককে খিস্তিয়ে গেছে "সাম্প্রতিকতা ও বাংলা ভাগ করার" অপরাধে। কেন? না পার্টির বড়রা তো সেটাই করে। তাই আমরাও করি।

 তবে কিনা মানুষ ধীরে ধীরে জাগছে। বাঙ্গালী জাতিগতভাবে অকৃতজ্ঞ নয়। সে মিসগাইডেড হয়ে অসভ্যতামো করতে পারে‚ কিন্তু সত্যিটা জানার পর নিজেকে সংশোধন করতেও পারে সে! সাধারণ মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকজনকে লক্ষ্য করেছি যারা আমার থেকে (হিন্দুত্ববুক্স) শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কিত বই পড়ার পর থেকে ওনার নাম যথেষ্ট সম্মানের সাথে উচ্চারণ করছে। হয়তো সে এখনও কমিউনিস্ট বা সেকুলারই আছে। হিন্দুত্ববাদী হয়নি। কিন্তু আগে যেমন শ্যামাপ্রসাদকে শ্যামাপোকা বলে অপমান করে আহা কি বিরাট কাজ করিয়া ফেলিলাম বলে বগল বাজাতো‚ সেটা 
এখন করে না। পুরো নামটাই উচ্চারণ করে।

মুসলিম‚ ব্রিটিশ ও বামপন্থী -নেহেরুভিয়ান ঐতিহাসিকরা লক্ষ্মণ সেনের উপর কাপুরুষতা‚ বৌদ্ধবিদ্বেষ‚ ব্রাহ্মন্যবাদের যে অভিযোগ এনেছিলো তাও বহুলাংশে দূরীভূত হয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রাণপণ চেষ্টার দ্বারা। বাঙ্গালীরা এখন আর সেইসব গালগল্পে বিশ্বাস করেনা। তার দিগ্বিজয় বা ধর্মীয় সমদর্শীতার কথাও এখন মোটামুটি সর্বজনবিদিত। 

কিন্তু একজন বাঙ্গালী নায়কের কলঙ্ক আর ঘুচলো না। অবশ্য তার কারণও আছে। পূর্বোক্ত প্রত্যেকেরই বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। এছাড়া তাদের প্রত্যেকেরই প্রতিপক্ষ কোনো না কোনো ভাবে বর্তমানের হিন্দু - বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ।   কিন্তু শেষ জনের না কোনো ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে‚ না তার প্রতিপক্ষকে মিথ্যে প্রমাণ করার কোনো দায় আছে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের।

হ্যাঁ আমি প্রবলপ্রতাপ নন্দ সম্রাট ধননন্দের কথাই বলছি।

বাঙ্গালী (গঙ্গাল বা গঙ্গারিডাই) ঘরের এক সামান্য নাপিতের ছেলে ছিলেন মহাপদ্মনন্দ! নিজের ক্ষমতায় সমাজের একজন নিম্নবর্গীয় মানুষ থেকে ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন তিনি। 

মৎস্য, বায়ু ও ভবিষ্য পুরাণ মতে - 

“মহানন্দিসুতশ্চাপি শূদ্রায়াং কলিকাংশজঃ,
উৎপৎস্যতে মহাপদ্মঃ
সর্ব্বক্ষত্রান্তকো নৃপঃ।
ততঃ প্রভৃতি রাজানোভবিষ্যাঃ
শূদ্রযোনয়ঃ,
একরাট্ স মহাপদ্ম একচ্ছত্রো
ভবিষ্যতি॥”

অর্থাৎ তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ক্ষত্রিয় বিনাশকারী একরাট (সম্রাটের পূর্ব ভারতীয় ভার্সান) রূপে।

সেই মহাপদ্মনন্দেরই যোগ্য ছেলে হলে ধননন্দ। ইউরোপ‚ আফ্রিকা‚ সম্পূর্ণ পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে ভারত দখলে উদ্যত আলেক্সান্ডারের বাহিনী সভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলো যার বীরত্বের কথা শুনে। মনে রাখতে হবে এই পিছিয়ে যাওয়া আগ্রাসনকারীটির নাম ছিলো বিশ্বজয়ী আলেক্সান্ডার! অন্য কেউ না। যদি না সেদিন ধননন্দ মগধের সিংহাসনে না থাকত তবে না জানি ইতিহাসের গতিপথ কোন দিকে বইতো।

যার  আমাদের ইতিহাসে স্বাধীনতার রক্ষক বলে পরিচয় পাওয়ার কথা ছিলো‚ প্রবল প্রতাপে যে আটকে দিয়েছিল বিদেশী আগ্রাসনের বিজয় রথ। সেই ধননন্দ ইতিহাসে ভিলেন বলে পরিচিত - শুধুমাত্র সে ক্ষমতা হারিয়েছিলো বলে।

হ্যাঁ‚ হয়তো‚ আই রিপিট হয়তো ধননন্দ অত্যাচারী ছিলো। সেই হিসাবে তো ইতিহাসে অত্যাচারী ছিলো না এমন শাসকের সন্ধান করাই দুস্কর। কারণ জনকল্যানকারী রাষ্ট্রের ধারণা তখন ছিলো না। এখন আমরা ট্যাক্স দি শাসক আমাদের উপকার করবে বলে। তখন ট্যাক্স দেওয়া হত শাসক তার প্রজাদের কোনো ক্ষতি করবেনা এবং অন্য কর সংগ্রহকারীর (বিদেশি শাসক) থেকে রক্ষা করবে - সেইজন্য। তবে এর উপরেও কেউ কেউ অত্যাচারকে শিল্পে পরিণত করে ফেলত। যেমন সিরাজউদ্দৌলা হিন্দু নৌযাত্রীদের নৌকা ফুটো করে দিয়ে তাদের মরতে দেখে মজা পেত। সেসব আলাদা বিষয়। 

যাইহোক‚ ধননন্দের সাথে তার মন্ত্রীর (চাণক্য ) ইগোর প্রবলেম ঘটল। সেই মন্ত্রী রাজ্য থেকে বেরিয়ে অন্য একটি ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর (মোরিয়) সাহায্যে ধননন্দকে উচ্ছেদ করল। হয়তোবা রাজ্যের আভ্যন্তরীন বিরোধী গোষ্ঠীও চাণক্যকে সাহায্য করেছিলো এই কাজে। নিজে প্রাক্তন মন্ত্রী হওয়ায় কারণে চাণক্যের পক্ষে সাম্রাজ্যের দুর্বলতা জানাটাই স্বাভাবিক ছিলো। ফলে সহজেই ধননন্দের পতন ঘটল। পরবর্তী বিজয়ী শাসকরা ইতিহাসকে নিজের মতো করে লিখলো। চিরকালই তাই হয়ে এসেছে। আমাদের জাতির এক গৌরবময় শাসক পরিণত হলো ঘৃণিত খলনায়কে।

পুনঃ এখানে কিন্তু  আরও একটি প্রশ্ন উঠতে পারে। নন্দরা যেহেতু শূদ্র ছিলো‚ সেক্ষেত্রে চাণক্যের নেতৃত্বে  মৌর্যদের অভ্যুত্থান কি তাদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মন ও ক্ষত্রিয় শ্রেনীর যৌথ অভ্যুত্থান ছিলো? খুব একটা কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ ইতিহাস পরবর্তী কালেও এই ধরনের ঘটনার উদাহরণ পাওয়া গেছে। 

খোদ মহারাজা প্রতাপাদিত্যও কিন্তু সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণদের সাহায্য করতে গিয়ে তার নিজের কাস্ট অর্থাৎ কায়স্থ ও ব্রাহ্মনদের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলো। প্রতাপের পতনের পরে তিন মজুমদারের (সাবর্ণদের পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার‚ কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার আর সপ্তগ্রাম বাঁশবেড়িয়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জয়ানন্দ মজুমদার) মধ্যে বাংলা ভাগের কাহিনী থেকে বোঝা যায় ব্রাহ্মণদের বৃহদংশই  মুঘলদের (মানসিংহের) সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। বাঙ্গালী এখনো ইকির মিকির খেলার সময় যে "চামে কাটে মজুমদার" বলে ছড়া কাটে তা কিন্তু আসলে বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুঘলদের সাহায্য করা ভবানন্দ মজুমদার ও তার সহযোগীদের স্মৃতিচারণ করে অবচেতনে।

আরেক বাঙ্গালী শাসক সেন রাজা বল্লাল  সেনও নিম্নবর্ণের পদ্মিনীকে বিয়ে করে সমাজের অন্যান্য উচ্চবর্ণের রোষের মুখে পড়েন। আরও মজাদার বিষয় যেটা‚ বর্তমানে ব্রাহ্মন্যবাদ দিয়ে সবথেকে বেশি মুখরিত যে সম্প্রদায়‚ সেই নমঃশূদ্ররাই ছিলো এই বিরোধিতার অন্যতম হোতা। তারা তখন উচ্চবর্ণ ছিলো। বল্লালের বিয়ে নিয়ে খামোখা ক্যাচাল তৈরী করলে সম্রাট তাদের পতিত করেন। নমঃশূদ্রদের মধ্যে এখনো প্রবাদ প্রচলিত আছে, “নমঃশূদ্র বীর্যবান, বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ সন্তান, বল্লালের কোপেতে জঘন্য”।  বল্লাল-পদ্মিনীর বিবাহের বিরোধী ছিলেন বলেই পতিত হন, এঁরা এমন দাবি করেন। 

তবে বল্লাল সেন শক্তিশালী শাসক ছিলেন বলে এবং তার আমলে তেমন শক্তিশালী বিদেশী আক্রমণ ঘটেনি বলে এই ইন্টারকাস্ট সমস্যায় তাকে তেমন জর্জরিত হতে হয়নি। যদিও সেন সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল‚ রাজনৈতিক - সামরিক ও আদর্শিক - সবই। (আক্ষরিক অর্থেই বাপের বিয়ে সহ্য না করতে পেরে লক্ষ্মণ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়, ফলে বাবা ও ছেলের সংঘর্ষ বাঁধে। যদিও বল্লাল তা সামলে নেন।)  কিন্তু প্রতাপের ভাগ্য ততটা ভালো ছিলো না। ফলে তাঁর পতন ঘটে।

আমাদের আরেক শাসক ধননন্দের ভাগ্যেও কি এমনই কিছু ঘটেছিলো? ইন্টারকাস্ট সংঘর্ষে ক্ষমতা হারাতে হয় করুণভাবে বাঙ্গালীর প্রথম ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের শেষ নায়ককে।

আমি স্রেফ সম্ভাবনার কথা বললাম।  ঐতিহাসিকরা কিন্তু ভেবে দেখতে পারেন। 

পুনঃ ২- কেউ দয়া করে জাতপাত উস্কে দেওয়া বা হিন্দু ঐক্য বিনষ্ট করা এসব ফাও বকবেন না। ইতিহাসে কোনো ঘটনার দায় তার বর্তমান উত্তরাধিকারীর নয়।  সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের উপর গনহত্যা চালিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো‚ এই ঐতিহাসিক ঘটনা বলা মানে তা কখনোই মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো নয়। এখানেও বিষয়টি তেমনিই।

Post a Comment

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................