পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী মুসলিমরা নিজ দেশীয় সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে প্রবলভাবে আরবী তুর্কি সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

যদি অখন্ড বাংলা যেটা শরৎ বসু সোহরাওয়ার্দী চেষ্টা করেছিলেন স্বাধীন করতে সেরকম কিছু হলে তার চেহারাটা কি রূপ ধারণ করত? এতদিন পর্যন্ত লিাবারালদের মত ছিলো বাংলা অখন্ডভাবে স্বাধীন হলে সেখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন জায়গা থাকত না কারণ সেখানে হিন্দু মুসলমান হতো প্রায় সমান সমান। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। আমার মনে হয় এখানে কেবলই হিন্দুত্ববাদীদের উপরই দোষ চাপিয়েছেন ভারতীয় বামপন্থি ও লিবারালরা। কেননা পূর্ব বঙ্গে মুসলমানরা মনে হয় না সেরকম অখন্ড বাংলা চাইত কারণ সেই বাংলায় মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু বাঙালীরা থাকত এগিয়ে। সিনেমা বলেন সাহিত্যে বলেন, রাজনীতি- এখানে সত্যজিৎ মানিক ঋতিত্ব হেমন্ত মান্নাদে জ্যোতি বসু বিধান রায়দের কাছে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা কুলিয়ে উঠত না। তখন আরো বেশি করে সাম্প্রদায়িক জাতিভেদ জেগে উঠত। বাঙালী মুসলমান প্রতিনিয়ত মুসলমান হতে হতে আর হিন্দুয়ানী ত্যাগের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় আরবী তুর্কি মিলিয়ে একটা হাঁসজারু হয়ে পড়ত আরো বিকট আকারে।

এই শতাব্দীতে এসে বিগত শতাব্দীর অনেক ধারণাই আজকে বাতিল বলে চিন্তকরা বাদ দিয়েছেন। ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, অস্ট্রেয়ার সরকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের রাজনৈতিক ইসলামকে মোকাবেলা করতে নাজেহাল হচ্ছেন। ইউরোপের লিবারালরা রাজনৈতিক ইসলামকে ঠেকাতে কঠর হচ্ছেন। সেখানে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ইসলাম কোন নতুন জিনিস ছিলো না। মুসলমানদের আগমন থেকেই রাজনৈতিক ইসলামকে ভারত জানে। তারপর ইংরেজ আমলে বারবার ইংরেজ প্রশাসন রাজনৈতিক ইসলামকে মোকাবিলা করেছে। যে কারণে ইংরেজদের সহায়তায় আলীয়া মাদ্রাসায় মুসলমানদের ইংরেজি বিজ্ঞান সাহিত্য পড়িয়ে চেয়েছিলো রাজনৈতিক ইসলাম থেকে দূরে রাখতে। বলাই বাহুল্য আলীয়া মাদ্রাসাও রাজনৈতিক ইসলামকে বাদ দিতে পারেনি। কারণ ইসলামে রাজনীতিকে বাদ দিলে আধ্যাত্মিকতা বলতে আর কিছু থাকে না। ইসলাম কেবলই একটি ধর্ম- এরকম করে বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে ব্রেকেট বন্দি করতে কিন্তু কেউ সফল হয়নি। ইসলাম বলে মুসলমানদের অবশ্যই আল্লার শাসন কায়েম করতে হবে। ইসলাম কেবল ব্যক্তিগত ধর্ম পালন নয়, ইসলাম কায়েম অর্থ হচ্ছে দেশ শাসন করবে ইসলাম। কাজেই পৃথিবীতে কখনই মুসলমানদের নিয়ে সমস্যা যাবে না যদি না ইসলাম চর্চা থেকে তাদের দূরে রাখা যায়। কারণ রাজনৈতিক ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্র হচ্ছে ‘মুসলিম উম্মাহ’। আপনি হজ পালন বন্ধ করতে না পারলে কখনই এই উম্মাহ চেতনা থেকে মুক্ত থাকবেন না। এখন ফ্রান্স জার্মানি নিজেদের দেশে বাইরে থেকে কোন ইমাম না আনার যে ঘোষণা দিয়েছে তা ফলপ্রসু হবে না কারণ জার্মান ফ্রান্স বেলজিয়াম ইংলেন্ড থেকে প্রতিবছর যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান হজ করতে যায় সেখানে তাদের একটা ট্রেনিং হয়ে যায়। এটা মুসলিম উম্মাহর ট্রেনিং। কাজেই দেশীয় ইমামরা সেই রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিতই কেবল নয় নিজেদের আত্মপরিচয় হিসেবে সেটাকেই মনে করে।

অবিভক্ত বাংলা স্বাধীন হলে বাংলাদেশকেও একই সমস্যা মোকাবিলা করতে হতো। রাজনৈতিক ইসলামের কবল থেকে হিন্দু মুসলমান সমান সমান হলে বন্ধ থাকত- এটা যে একদমই ভুয়া তত্ত্ব সেটা ফ্রান্স ইংলেন্ড বেলজিয়াম অস্ট্রেয়াতে ইসলাম বিরোধী আইন পাশের তোড়জোড় থেকেই নিশ্চয় এখন বুঝতে পারছেন। কারণ বিষয়টা হিন্দু মুসলমান কোন সমস্যা নয়। সমস্যা ইসলামকে নিয়ে। ইসলাম শুধু হিন্দুদের জন্য সমস্যা নয়, ইসলাম মুসলমানদের জন্যও সমস্যা। যে কারণে আগের লেখায় বলেছিলাম ভাসানীর ‘বাংলা আমার আসাম আমার ত্রিপুরা আমার এগুলি না পেলে আমার দেশের পূর্ণতা পায় না’ বলা উক্তিগুলো আসলে মানুষ নয় মাটির জন্য আহাজারী। এগুলোকে মুসলিমদের আওতায় আসার আফসোস। কারণ পাকিস্তানে যদি এই অঞ্চলগুলো যোগ হতো তাহলে অহমিয়াম ও বাঙালী হিন্দুদের কোন দেশই থাকত না! তারা মাইগ্রেট করে ভারতের অবাঙালী এলাকাতে গিয়ে ঠাই নিতো। যেমনটা কাশ্মিরের হিন্দু পন্ডিতরা দেশহারা হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মাইগ্রেশন করেছে। সংখ্যা বিচারটা তাই কোন গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্রীলংকাতে ইসলাম ও মুসলমান এখন প্রচন্ড রকমের একটা সন্দেহজনক ব্যাপার। মসজিদগুলোকে সন্ত্রাসের আড্ডাখানা মনে করা হয়। কোলকাতার বেকার হোস্টেলে রাখা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য উঠিয়ে দেয়ার জন্য কি সেখানকার মুসলমানরা আন্দোলন করেনি? তারা যে ভাষায় বিরোধীতা করেছিলো সেই একই ভাষায় ঢাকার মৌলবাদীরা ব্যবহার করেছে। বেকার হোস্টেলে কোন মুসলমানের মূর্তি বানিয়ে সেটাকে পুজা দেয়া মুসলমানরা বরদাস্ত করবে না- এমনটাই ছিলো সেখানকার মুসলিম নেতাদের মুখের ভাষা। তাহলে কি করে বলেন শরৎ বসুর স্বপ্নের বাংলা অখন্ড স্বাধীন হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো? তখন তো আনন্দ পাবলিকেশনকে ঢাকায় আটকাতে পারত না। তাহলে আহমদ ছফার মুসলিম বাংলার সাহিত্য বই ব্যবসা কি করে রক্ষিত হতো? বুঝতে পারছেন সমস্যা কত প্রকট হতো? একদিকে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, কওমি মাদ্রাসার হেফাজত ইসলামসহ পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের ফান্ডামেন্টালিস্ট আক্রমন, সঙ্গে ছফাদের হিন্দু সাহিত্য হিন্দু বই হিন্দুত্ববাদের বিরোধীতা অখন্ড বাংলার হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? 

তাই আমার সব সময়ই মনে হয়েছে ইংরেজ শাসনে যে অখন্ড ভারত গড়ে উঠেছিলো একমাত্র সেরকম একটি দেশে থেকে গেলেই সম্ভব হত সাম্প্রদায়িকতা থেকে অনেকখানি মুক্তি- কখনই পুরোপুরি নয়। ভারত এমন একটি দেশে যেখানে অনেক রাজ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু। ভারতে শিখ, মুসলিম, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য রয়েছে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সঙ্গে তাই ভারতের কোন রকম তুলনা চলে না। ভারতে কোন জাতি সম্প্রদায় তার সংস্কৃতি বিলিন হয়ে যাবার আশংকায় না থাকলেও পাকিস্তান বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায় বিলিন হয়ে যাবার আশংকায় রাত পোহায়। উপরন্তু পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী মুসলিমরা নিজ দেশীয় সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে প্রবলভাবে আরবী তুর্কি সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমার মনে হয় বহু জাতি সম্প্রদায় মিলে যুক্তরাজ্য ব্যবস্থায় মুসলমানরা রাজনৈতিক ইসলামের বদলে সেক্যুলার রাষ্ট্র চায় যাতে সে সেই সুযোগে নিজেদের ইসলামিক লেবাস সংস্কৃতি বিশ্বাসকে জীবিত করে রাখতে পারে। অন্তত সে জন্য হলেও একটা বিরাট অঞ্চল সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষতার খানিকটা স্বস্তি আদায় করা যায়। আমি জানি, সেটাও শতভাগ কোন সমাধান নয়।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted