“বৈদিক সভ্যতা”- “The day is not far when the Chicken will come to roost”

“বৈদিক সভ্যতা”- “The day is not far when the Chicken will come to roost”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ 

“বেদ ভিত্তিক সভ্যতা”র  নাম বৈদিক সভ্যতা। আমরা যারা নিজেদের সনাতনী বলে মানি, হিন্দু নামে পরিচয় দেই, তাদের পুর্ব পুরুষরা যে ধর্ম, সংষ্কার এবং জীবন যাত্রা মেনে চলতেন তাকেই বলে বৈদিক সভ্যতা। 

বেদ কে ভিত্তি করে বেশ কিছু শাখা প্রশাখা রুপে নানা ধর্মীয় মত ও পথ এসেছে। এই শাখা প্রশাখা নানা নাম নিয়েছে এবং এদের বিভিন্ন ধর্মীয় গুরু আছেন। এক একজন গুরু তাদের নিজেদের মতো করে বেদের ব্যাখ্যা করে নিজের নিজের দল ভারী করেছেন। এদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে, কিছু কিছু মারামারিও আছে। তবে এরা আবার তাদের সম্বিত ফিরে পেয়ে এক সংগে চলেছেন। নিজেদের ‘সনাতনী হিন্দু’ বলে গর্ব বোধ করেছেন।

বৈদিক ধ্যান ধারনার ওপরে সর্ব প্রথম ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক আঘাত এলো, বুদ্ধদেব যখন বেদ ভিত্তিক আধ্যাত্মবাদ থেকে নিজেক দূরে সরিয়ে নিজের মতো করে “নিরীশ্বর বাদ” প্রচার করলেন। প্রথম দিকে দল ভারী না হলেও, ‘চন্ডাশোক’ যখন সম্রাট অশোক হলেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করলেন, তখন থেকে শুরু হলো বৌদ্ধ ধর্মের জয় যাত্রা। রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা সনাতনীরা কোনো ক্রমে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখলো। পরিশেষে, রাজনৈতিক ক্ষমতা আবার হাত ঘুরে বৈদিক সভ্যতার উত্তরসুরীদের হাতে এলো। আদি শংকরাচার্যের আভির্ভাবে বৈদিক ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলো।

এবারে বিপদ এলো ভারতের বাইরে থেকে। আরবী দস্যুরা ঘোড়ায় চড়ে,হাতে তলোয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে দিকে দিকে “জেহাদ” করতে। বৈদিক ‘কেকয়’, গান্ধার, কম্বোজ একে একে চলে গেলো আরব দেশের যুদ্ধবাজদের হাতে। সেখানকার সমস্ত বৈদিক ধর্মের মানুষগুলো ধর্ম পরিবর্তন করে হয়ে গেলো ঘোরতর বেদ বিরোধী। আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এই জনপদ গুলোও যে বৈদিক ভারতবর্ষের অন্তর্গত ছিলো সেখানকার মানুষগুলোও হয়ে গেলো এই আরবীদের “দাস”। আফগানিস্তান এবং পুর্বতন তক্ষক্ষখন্ড, যা কিনা শ্রী রামচন্দ্রের ভাই ভরতের পুত্র তক্ষকের রাজত্বের অংশ ছিলো, মধ্য এশিয়ার সেই অঞ্চলের মানুষ গুলো, আরবীরা যাদের ধর্ম পরিবর্তন করিয়ে দাস বানালো,  সেই দাসেরা পরবর্তীতে একের পর এক বন্যার জলের মতো ধেয়ে এলো খাইবার গিরিপথ পার হয়ে একবারে মুল ভারত ভুখন্ডে, বৈদিক সভ্যতার উৎপত্তিস্থল এবং বৈদিক ধর্মের পালক ধর্মীয় গুরুদের আশ্রম ভিত্তিক সাধনাস্থলে।   সনাতনীদের রক্তে ভিজে গেলো সারা ভারতের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি। ধ্বংস হয়ে গেলো ১০০০০-১২০০০ বছরের এক প্রাচীন সভ্যতা। বৌদ্ধরা পালিয়ে বাচলো তাদের তিব্বতের গুম্ফায়, সংগে নিয়ে গেলো তাদের কিছু পুথিপত্র। বাকীরা প্রান বাচাতে ওই ‘জেহাদী’ দলে নাম লেখালো এবং হয়ে গেলো আরো মারাত্মক রকমের হিন্দু বিরোধী। 

বৈদিক ব্রাহ্মনেরা নানা দুর্গে রাজাদের এবং নিজেদের প্রান বাচাতে যুদ্ধ করতে করতে মরলো, কিছু ধর্ম পরিবর্তন করে বাচলো, বাকিরা নিজেদের পেট চালাতে “অব্রাহ্মনীয়” নানা কাজ নিয়ে হয়ে গেলো “পতিত ব্রাহ্মন”। শুরু করলো নানা “অবৈদিক” কাজ কর্ম, আর আজো অবধি বংশ পরম্পরায় গালাগাল খাবার ব্যবস্থা করলো অন্য বর্নের মানুষজনদের কাছে।

প্রায় ১০০০০-১২০০০ বছর আগে শুরু হয়েছিলো এই বৈদিক সভ্যতা। প্রত্নতাত্বিকেরাই আজ বলছেন, “মেহেরগড়” ( পশ্চিম পাকিস্তানে) নামক জায়গায় খনন কাজ চালিয়ে তারা আজ একেবারে নিশ্চিত যে এখানে ৮৫০০ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দে (১০৫০০ বছর আগে) এক অতি উন্নত সভ্যতা ছিলো এবং সেই সভ্যতা বৈদিক সভ্যতা। “মেহেরগড়, কালীভাঙ্গান, লোথাল” আজো মাটির নীচে বৈদিক সভ্যতার নিদর্শন নিয়ে আছে। শ্রী কৃষ্ণের দ্বারকা জলের তলায় আজ ৯০০০ বছর ধরে তলিয়ে আছে। রাম সেতুর বয়ষ এখনো নাসার বৈজ্ঞানিকেরা ঠিক করে উঠতে পারেন নি। সরস্বতী নদী এবং সিন্ধু নদীর তীরে উৎপন্ন বৈদিক সভ্যতা ছড়িয়ে পড়েছিলো হিন্দু কুশের পশ্চিমে এবং পুবে। ক্রমে সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাওয়ার পর সেই উন্নত সভ্যতা পুর্ব দিকে সরে আসতে থাকে এবং নাম হয় গাঙ্গেয় সভ্যতা, যার বিকৃত ইতিহাস ( বিদেশী, হিন্দু বিদ্বেষী মুসলিম শাসকদের ভাড়া করা ঐতিহাসিক এবং বামপন্থীদের লেখা) আমরা জানি এবং পড়ি। এই বৈদিক সভ্যতা মুনি ঋষিদের হাত ধরে দক্ষিনে ,পুবে এবং পশ্চিমে সেই ককেশাস অবধি চলে যায়। 

আজ অবধি যে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন, হিন্দুকুশের দুই দিকে, বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে আবিষ্কার এবং খনন হয়েছে, সেই সুত্র ধরে বৈদিক সভ্যতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। 

১) হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো পুর্ববর্তী সময় (মেহেরগড় ইত্যাদি) ১০৫০০ বছর – ৫১০০ বছর (ঋকবেদের সময়)। 

পন্ডিতেরা বলছেন , এই সময়ের কিছু আগে থেকেই বৈদিক সভ্যতা শুরু হয়। মেহেরগড় হরপ্পা থেকে পশ্চিমে অবস্থিত। এক সুবিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে এক প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্বিক সন্ধান বর্তমান পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আর এটি সবচেয়ে পুরানো। পশুপালন থেকে শুরু করে, নানা রকম কৃষিকাজ, তামা এবং লোহার ব্যাবহার, শহর এবং গ্রাম কেন্দ্রিক জীবন যাত্রা সুপরিশীলিত জীবন যাত্রা প্রনালীর প্রমান আজ পাওয়া গেছে। পন্ডিতেরা বলছেন এই সময় থেকেই ঋক বেদের সৃষ্টি হয়েছিলো। 

২) হরপ্পা – মহেঞ্জোদাড়োর সমসাময়িক- ৫১০০-৩৯০০ বছর । 
হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো তে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, যাকে বলা হয় সিন্ধু সভ্যতা ( সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা) সেই সভ্যতাও বেদ ভিত্তিক বৈদিক সভ্যতা। এই সময় সাম, জজুর্বেদ, অথর্ব বেদ রচিত হয়। সিন্ধু সভ্যতার কালে বৈদিক ধ্যান ধারনা এবং জীবন যাত্রা প্রনালী আরো অনেক উন্নত এবং পরিশীলিত হয়, তার প্রমান আজ চোখের সামনে। আজ থেকে ৪০০০-৫০০০ হাজার বছর আগের বৈদিক মানুষ কতো উন্নত ছিলো, তা জেনে অনেক বাঘা বাঘা প্রত্নতত্ববিদ আজ অবাক হচ্ছেন। সেই সময়ের নগর নির্মান পদ্ধতি আজকের থেকে খুব একটা নিম্ন মানের ছিলো না। (যারা বিশদ জানতে চান তারা একটু ইন্টারনেট ঘাটা ঘাটি করুন)।

 ঠিক এই সময় কোনো ‘ইন্দো এরিয়ান বা ইন্দো ইউরোপিয়ান’ “আর্য্য” নাম ধারী জাতি আক্রমন করে এবং সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করে দেয়, সেই বিকৃত মত আজ আর ধোপে টিকছে না। সিমেটিক দুই ধর্মের মানুষগুলো যতোই বলুক, বামপন্থীরা যতোই লিখুক, ইরফান হাবিব আর রোমিলা থাপার যতোই গালাগাল করুক, ওদের কথায় আজ আর কেউ কান দিচ্ছেন না।

৩) ৩৯০০ থেকে ৩০০০ বছর--- 

 এই সময় টা সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার পুর্বদিকে বিস্তারের সময়। সরস্বতী ছিলো “নদীতমা”। পর পর বেশ কিছু ভুতাত্বিক কারনে, বেশ কিছু ভুমিকম্পে নদীর উৎসে বেশ পরিবর্তন হতে থাকে। যমুনা নদী সরস্বতী থেকে আলাদা হয়ে পড়ে, অন্যান্য কিছু ছোট ছোট নদীও সরস্বতী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সরস্বতী শুকিয়ে গিয়ে অন্তসলিলা হয়ে পড়ে। এক দিনে এই ঘটনা ঘটেনি। বৈদিক মানুষ গুলো ধীরে ধীরে তাদের বসত ভুমি ছেড়ে গংগা- যমুনার অববাহিকা অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। গড়ে ওঠে গাঙ্গেয় সভ্যতা। তাই বলে বৈদিক মানুষ তাদের মুল উৎপত্তিস্থলকে ভুলে যায়নি ১২০০০ বছরে ( মেহেরগড়ের বয়ষ যদি হয় ১০৫০০ বছর, তাহলে আরো ১৫০০ বছর যোগ করা যায় সেই সভ্যতার সুচনা সময়।) 

ভুবিজ্ঞানীরা, ভুতাত্বিকেরা, প্রত্ন তাত্বিকেরা আজ সহমত যে, বৈদিক সভ্যতা, যা শুরু হয়েছিলো হিন্দুকুশের দুই পারে, সিন্ধু-সরস্বতীর তীরে আজ থেকে কম হলেও ১২০০০ বছর আগে, সেই সভ্যতার বিস্তার হয়েছে, মানুষ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বাস করতে গিয়েছে সব ঠিকই,কিন্তু সেই সভ্যতা এক ধর্ম কেন্দ্রিক, এক সংষ্কৃতি কেন্দ্রিক সভ্যতা। কাল কালে কিছু পরিবর্তন হলেও তার মুল সুত্র একই ছিলো, সেই সুত্র “বেদ ভিত্তিক আধ্যাত্মবাদ”- বৈদিক দর্শন। 

বৈদিক সভ্যতার সেই প্রবাহ রুদ্ধ হতে থাকলো, আরব দেশে উদ্ভুত এক “জেহাদী” তান্ডবে। ধীরে ধীরে সেই জেহাদী তান্ডব গ্রাস করে নিলো, বৈদিক সনাতনীদের বাস ভুমি, নষ্ট করে দিলো তাদের জীবন যাত্রা, সংষ্কার, তাদের সযত্নে লালিত ধর্মীয় ধারনা। অমৃতের ভান্ডে হলাহল (বিষ) দিলে যা হয়, আজ পুন্যভুমি ভারতে তাই হয়েছে। “আলোর জগত থেকে বৈদিক ভারত ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলো এক অন্ধকারের জগতে”। সেই অন্ধকার দিন দিন ক্রমশ গাড় থেকে গাড়তরো হয়ে চলেছে। এই অন্ধকারের শেষ কোথায় কেউ জানে না।

জানি না কেনো, তবে এটা ঠিক, পৃথিবীতে বারে বারেই অশুভ শক্তির আবির্ভাব হয়। বোধ হয় এক সার্বিক ধংসের মধ্য দিয়ে নতুনের আবির্ভাবের জন্য। বৈদিক দর্শিন তো তাই বলে। মানুষের চীরকালীন সত্য তো চাপা দেওয়া যাবে না। সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই। মুনি ঋষিদের সাধনা লব্ধ সত্য, আরব দেশের থেকে উদ্ভুত দুটি অশুভ অসত্য দিয়ে চীরদিন চেপে রাখা যাবে না। প্রায় হাজার বছর ধরে চলছে সেই শুভ এবং অশুভের দ্বন্ধ। এই দ্বন্ধের শেষ তো আছেই। বৈদিক ধ্যনা ধারনাকে যারা ভালো বাসেন তাদের এখন ‘শালিগ্রাম শিলা’কে বুকে আকড়ে ধরে “নারায়ন নারায়ন’ নাম মুখে জপা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। কারন, আজ যারা বৈদিক ধর্মের ঘোর বিরোধী ,তাদের রক্তে এবং জিনে আছে বৈদিক ধর্ম। শুধু মুখে গালাগাল দিয়ে এবং বিদেশী নিম্নরুচির সংষ্কারের পেছনে দৌড়ালেই তো চলবে না চীরদিন। “The day is not far when the Chicken will come to roost”

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted