‘পদ্মাসেঁতু’ যতটা গর্বের, মৌলবাদের আস্ফালন ততটাই লজ্জ্বার
ভোরের কাগজ, ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০।
যুগশঙ্খ, কলকাতা, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০।
Weekly Thikana, NY, 16 Dec 2020.
শিতাংশু গুহ, ১২ই ডিসেম্বর ২০২০, নিউইয়র্ক।। গ্রামবাংলায় এখন আগের দিনের সেই গ্রাম নেই, তাই ‘কাঁকতাড়ূয়া’ কথাটা তেমন শোনা যায়না। এর সাদামাটা অর্থ হচ্ছে, কৃষক কাক বা পাখি থেকে ফসল বাঁচাতে পুরানো কাপড়-বাঁশ বা লাঠি ইত্যাদি দিয়ে অনেকটা মানুষের আকৃতি বানিয়ে ফসলের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখতো, যাতে পশু-পাখি কিছুটা হলেও ভয় পায়! সম্প্রতি বাংলাদেশে ময়মনসিংহের গফরগাঁও-এ ‘কাঁকতাড়ূয়া’ মূর্তি কিনা এ নিয়ে দুই গ্ৰুপে ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছে। সবার জানা যে, ভাস্কর্য বা মূর্তি নিয়ে এ সময়ে দেশে বিতর্ক, আন্দোলন, পাল্টা-আন্দোলন, হুমকি-ধামকি, লেনদেন, আপোষ-মীমাংসা, মামলা-মোকদ্দমা চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে দৃশ্যমান ‘পদ্মা-সেঁতু’ নিয়ে জাতি যেমনি গর্বিত; ঠিক ততটাই লজ্জ্বিত সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির উত্থান ও আস্ফালনে।
বিবিসি খবর দিয়েছে, ভাস্কর্য ইস্যুতে ইসলামপন্থীদের আলোচনার প্রস্তাবে রাজি শেখ হাসিনা সরকার। হেফাজত-ই-ইসলাম এর দুই নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক’র বিরুদ্ধে আনীত ডিজিটাল সিক্যুরিটি এক্ট মামলা নিতে আদালতের অনীহার খবর মিডিয়ায় এসেছে। যদিও ইসলাম অবমাননার নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেফতারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকার ডেইলি ষ্টার পত্রিকা বলেছে, পাবনার কালীমূর্তি ভেঙ্গেছে দুর্বৃত্ত। মিডিয়া জানায়, ইসলাম অবমাননার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন মুক্তমনা ‘দিয়ার্সী আরাগঁ’ পেজের এডমিন দিপু কুমার ওরফে শাহরিয়ার দিপু। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে নবীকে কটূক্তির অভিযোগে আকাশ দাশ নামে এক শিক্ষার্থী আটক হয়েছেন। একই অভিযোগে নোয়াখালীর পাটনি গ্রামে গ্রেফতার হয়েছেন বিপ্লব চন্দ্র দাস ও ফুলক চন্দ্র দাস।
অথচ ভাস্কর্য বিরোধী হেফাজত নেতারা মডারেট বাংলাদেশে আরামেই আছেন। ডিজিটাল আইনকে তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মহাসচিব থাকাকালে মামুনুল হক বলেছিলেন, ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশের সকল ভাস্কর্য অপসারণ করা হবে, সংবিধান হবে ইসলাম ভিত্তিক। এবারের বিজয় দিবসে জাতিকে শুনতে হচ্ছে, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ক্ষমতায় যেতে চায়! অনেকেই প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনার পর কে? মনে পড়ে কি সেই অমর গান, ‘তারপর….?’ তার-আর-পর নেই----? চৌদ্ধ বছর আগে এই ডিসেম্বরে, অর্থাৎ ২৩শে ডিসেম্বর ২০০৬-এ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল এবং খেলাফত মজলিশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতার বাইরে। জাতি তখন ব্যাখ্যা শুনেছিলো, ক্ষমতায় যেতে এই কৌশল? ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে!
জামাত, খেলাফত, ওলামা সবাই এখন হেফাজত। জাতি ভুলেনি, একদা বঙ্গবন্ধু’র বিরুদ্ধে সবাই ‘জাসদ’ ছিলো। জাতি বারবার হেফাজতের সাথে ‘আপোষ’ করেছে। ‘তেতুল হুজুরের’ আশীর্বাদ নিয়েছে। এবারের বিজয় দিবসের দু:খজনক অধ্যায় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সাথে আপোষ করতে হচ্ছে? ভাস্কর্য প্রশ্নে সর্বশেষ আপোষ ক্ষমতায় থাকার স্বার্থেই? ভাস্কর্যের চেয়ে ক্ষমতা বড়, ক্ষমতায় থাকলে ভবিষ্যতে অনেক ভাস্কর্য গড়া যাবে? আওয়ামী নেতারা এখন বলছেন, ক্ষমতায় থাকলে ‘শান্তি’ রক্ষার্থে কখনো কখনো ‘ছাড়’ দিতে হয়, ধর্য্য ধরুন, সব ঠিক হয়ে যাবে? জাতি ধৈর্য্য ধরে আছে বটে! অনেকের মতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে জামাত-ই-ইসলাম-কে কোলে তুলে নিয়েছিলো, দলটি’র অস্তিত্ব এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন, জামাত বিএনপি-কে গিলে খেয়েছে। হেফাজত এখন আওয়ামী লীগের বন্ধু, বিএনপি যেই ভুল করেছে, আওয়ামী লীগ জেনেশুনে একই ভুল করছে না তো?
ইতিহাস বলে, ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না’। একাত্তরে ভূমিষ্ঠ হওয়া বাংলাদেশ এখন যৌবনে। মানুষ নাকি বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধর্মের দিকে ঝুঁকে; কিন্তু রাষ্ট্র ঝুঁকে তা জানা ছিলোনা! পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিষাক্ত ধর্মীয় ছোবল থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এখন পুন্:মূষিক ভব? বাংলাদেশ সরকার এখন গণতন্ত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটি উদারমনা সরকার, কিন্তু প্রগতিশীল মানুষের এতে কোন ‘বক্তব্য’ নেই বা সরকার প্রগতিশীলদের ধাঁর-ধাঁরেনা! সরকার যাঁরা চালায় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক; কিন্তু এদের সখ্যতা হেফাজতের সাথে, বৈরিতা মুক্তমনাদের সাথে, মৌনতা সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বাকহীনতা মাদ্রাসায় বলাৎকারের বিরুদ্ধে, এবং এমত আরো কত কি? কিন্তু এ নিয়ে কথা বলা বারণ। কেউ কেউ বলছেন, ভাস্কর্য ইস্যু একটি সামান্য ঘটনা, এতে বিচলিত হবার কারণ নেই! আসলে কি তাই? মাদ্রাসা ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরাতে ভাস্কর্য ইস্যু?
১৪ই ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’, কারা যেন বলেছিলো, “শহীদ বুদ্ধিজীবী, তোমরা শান্তিতে ঘুমাও; আমরা জেগে আছি”। কথায় বলে, ‘যে ঘুমিয়ে আছে, তাঁকে জাগানো যায়, কিন্তু যে জেগে ঘুমায়, তাঁকে জাগানো যায়না’। জাতি কি জেগে ঘুমাচ্ছে না? পঞ্চাশ বছরে যে জাতি একটি সঠিক ‘মুক্তিযোদ্ধা তালিকা’ প্রণয়ন করতে পারেনা, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনা, একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারেনা, সেই জাতির ভবিষ্যৎ দোদুল্যমান হওয়াই স্বাভাবিক। নি:সন্দেহে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, পদ্মাসেতু এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ধনী দেশ আছে, সেগুলো বসবাসের অযোগ্য, এমনকি বাংলাদেশিরাও সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসে রাজি নয়? সবাই ধাইছে, ইউরোপ, আমেরিকা বা উন্নত দেশে। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশকে বসবাস যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে, এবং এজন্যে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন শর্টকার্ট পথ নেই! দেশ বাহাত্তরে ফিরলে মৌলবাদ হারিয়ে যেতে বাধ্য। # guhasb@gmail.com;
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................