কিরে বাঙাল? তোরা তো উদ্বাস্তু !
---------------------------------------------
ছোটবেলায়, স্কুলে সহপাঠীদের কাছ থেকে বা পাড়ায় বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায়ই টোন টিটকিরি শুনতাম : কিরে বাঙাল ! তোরা তো উদ্বাস্তু । মাথা গরম হয়ে যেত, ঝগড়া করতাম, হাতাহাতি মারামারিও হয়েছে বহুবার । মেজাজ খিঁচড়ে, মুখ গোমড়া করে বাড়িতে বসে থাকতাম ।
এই টিজ করাটা বেড়ে যেত, যখন ইস্টবেঙ্গলের কাছে মোহনবাগান ২/৩ গোলে হেরে যেত । আমরা কয়েকজন যারা ওদের ভাষায় বাঙাল, পাল্টা ওদের ‘ঘটি’ বলে ডাকতাম । সেই অল্প বয়সে এই ‘বাঙাল’ আর ‘উদ্বাস্তু’ র পেছনে যে কি মর্মান্তিক ইতিহাস রয়েছে তা জানতাম না,আর বোঝা তো দূরের ব্যাপার । বয়স বাড়লো, পড়া বাড়লো, মানুষের সাথে পরিচয় বাড়লো । ধীরে ধীরে জানলাম আমি কেন বাঙাল আর কেনই বা আমি উদ্বাস্তু । নেহরু-জিন্না-গান্ধীর রাজনৈতিক কূটকাচালি, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাওঁতা, স্বাধীনতার নামে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং অতঃপর রক্তাক্ত ধর্মীয় হিংসার মাধ্যমে দেশভাগই জন্ম দিয়েছে এই আমাদের মত বাঙাল, উদ্বাস্তুদের ।
এই টিজ করাটা বেড়ে যেত, যখন ইস্টবেঙ্গলের কাছে মোহনবাগান ২/৩ গোলে হেরে যেত । আমরা কয়েকজন যারা ওদের ভাষায় বাঙাল, পাল্টা ওদের ‘ঘটি’ বলে ডাকতাম । সেই অল্প বয়সে এই ‘বাঙাল’ আর ‘উদ্বাস্তু’ র পেছনে যে কি মর্মান্তিক ইতিহাস রয়েছে তা জানতাম না,আর বোঝা তো দূরের ব্যাপার । বয়স বাড়লো, পড়া বাড়লো, মানুষের সাথে পরিচয় বাড়লো । ধীরে ধীরে জানলাম আমি কেন বাঙাল আর কেনই বা আমি উদ্বাস্তু । নেহরু-জিন্না-গান্ধীর রাজনৈতিক কূটকাচালি, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাওঁতা, স্বাধীনতার নামে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং অতঃপর রক্তাক্ত ধর্মীয় হিংসার মাধ্যমে দেশভাগই জন্ম দিয়েছে এই আমাদের মত বাঙাল, উদ্বাস্তুদের ।
পশ্চিমবঙ্গে স্থিতু মানুষরা যখন ১৯৪৭-এর ১৫ই অগাস্ট স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করেছে, তখন কাতারে কাতারে পূর্ববঙ্গের হিন্দু বাঙালি রক্তাক্ত ধর্মীয় দাঙ্গায় জেরবার ! পূর্ববাংলার ত্রস্ত দিনগুলোতে স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়া তো দূরের থাক, পূর্ববঙ্গের হিন্দু বাঙালি তখন কোনোক্রমে দৈনন্দিন জীবন যাপনের স্বল্প সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে, যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি জলের দরে বেঁচে, প্রাণ বাঁচাতে বিপুল সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসছে । হাজারে হাজারে শরণার্থী হয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ অভিমুখে। কেউ এসে উঠল আত্মীয়ের বাড়ি, কেউ শরণার্থী ক্যাম্পে, কেউ জায়গা না পেয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আবার অনেকেই পা বাড়ালো পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলোর দিকে,বেশ কিছু উদ্বাস্তুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্দামান ও দন্ডকারণ্যে । এরাই ধর্মীয় দাঙ্গায় সমূলে দেশত্যাগী জনগোষ্ঠী বাঙ্গাল। সবারই তখন অবস্থা সমান,সকলেরই জবর দখল করা জমিতে বসবাস যার নাম ‘কলোনি’। আমার দাদু, ঠাকুমাও ছিলেন এই প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসা দেশত্যাগী জনগোষ্ঠীর অংশ, তাই আমি আজও বাঙাল, উদ্বাস্তু যদিও আমার জন্ম ভারতের কলকাতায় । আমি আমার পূর্ব পুরুষের দেশে কখনো পা রাখিনি । হ্যা, আমি বাঙাল, উদ্বাস্তু যাই বলা হোকনা কেন, কিন্তু ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে আমার বাবা, কাকা জ্যাঠারা এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন আর তার সুফল আমরাও ভোগ করতে পেরেছি । যারা আমাদের বাঙাল, উদ্বাস্তু ট্যাগ দেন, তারা কি বুঝবেন উদ্বাস্তু কলোনির মানুষদের গোষ্ঠীবদ্ধ দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম কতটা কঠিন ছিল ?
প্রতিবেশীর কাছে গৃহস্থালী প্রয়োজনীয় বস্তু দেওয়া-নেওয়া করে দিন গুজরান, প্রতিবেশীর মধ্যে এটা সেটা ধার করা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ব্যতিক্রমী কিছু খাবার তৈরি হলে প্রতিবেশীকে ভাগ দেওয়া। সবার বাড়িতে ঘড়ির মত প্রয়োজনীয় যন্ত্রও ছিল না। যার যার বাড়িতে ঘড়ি ছিল তাদের কাছে সময় জেনে নেওয়া, এক বাড়ির খবরের কাগজ তিন চার বাড়ির লোকে পড়া এই সবই ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ । সেই সামাজিক সংগ্রামের দিনগুলোতে এই বাঙাল উদ্বাস্তুরা একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখেছিল : ‘লেখাপড়া করে বৃহত্তর সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা’, আর তাই আজ ভারতের যে সকল বাঙালি সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত, তাদের সিংহভাগ বাঙাল । তখনের পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে পূর্ববঙ্গ থেকে সর্বস্ব খুইয়ে আসা কোনো ছাত্র যখন ক্লাসে তার সহপাঠীদের পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার কথিত ভাষাগুলো শোনাতো, তখন কলকাতার ফটফটিয়ে-ইংরাজি-বলা বনেদি পরিবারের সহপাঠীরা শুনে বলতো : ‘তুই তো অনেক খিস্তি জানিস !’ মাতৃভাষা-খিস্তির সাংস্কৃতিক সংঘাতকে অতিক্রম করে বাঙাল উদ্বাস্তুরা সমাজে তাদের জায়গা করে নিয়েছে বেশ উচ্চস্থানে । এপারের বাবুরা অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও পারবেন না অস্বীকার করতে !
১৯৪৬ পর্যন্ত আমরা, এই বাঙাল উদ্বাস্তুরা ছিলাম ভারতবর্ষের নাগরিক । ১৯৪৭ এ আবার আমাদের পূর্বপুরুষদের ভারতে এসে নতুন করে নাগরিক হতে হয়েছিল । এই লজ্জা কি আমাদের ? না, এই লজ্জা গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাদের…………
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................