রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসচিন্তা

রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসচিন্তা 

                      প্রমথনাথ বিশী একবার বলেছিলেন ,, "রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখায় মহাকবির হাতের রচনা । তাঁর প্রত্যকটি লেখা নতুন করে ভাবতে শেখায় ।" কবিগুরু তাঁর বিপুল রচনার মাধ্যমে আমাদের ভাব জগতের নানা দ্বার উন্মোচন করে রেখে গেছেন । প্রয়োজন ও অভিরুচি অনুসারে আমরা সেই অসামান্য ভাণ্ডার থেকে মণিরত্ন আহরন করতে পারি । উপন্যাস , ছোটগল্প , কবিতা , গান , নাটকের পাশাপাশি রবীন্দ্র প্রতিভার অসামান্য স্বাক্ষর কবিগুরুর রচিত বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধাবলী ।

শিক্ষা , সাহিত্য , দর্শন , সমাজ ভাবনা , রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের উপর রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন । বেশ কিছু প্রবন্ধ তিনি ইতিহাস বিষয়ে রচনা করেছেন । মানবীয় প্রজ্ঞা ও জ্ঞান চর্চার একটি প্রাচীন উপকরণ " ইতিহাস "___ অতীতচর্চা । সেই অতীতচর্চার ধরণ ও পদ্ধতি নিয়ে হেরোডোটাস থেকে শুরু করে হালের উত্তর আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকরা তাদের অধীত জ্ঞান সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছেন । এর সাথে ইতিহাসের নতুন-নতুন আবরণ উন্মোচিত হয়ে চলেছে । এ যেন এক নিরন্তর প্রক্রিয়া । 

আঠারোটি সুচিন্তিত ও সুলিখিত প্রবন্ধের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইতিহাস চিন্তাকে ব্যক্ত করেছেন । ভারতবর্ষের ইতিহাস , ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা ,   শিবাজী ও মারাঠা জাতি , শিবাজী ও গুরু গোবিন্দ সিংহ , ভারত ইতিহাস চর্চা , কাজের লোক কে , বীরগুরু , শিখ স্বাধীনতা , ঝাঁন্সির রাণী , ঐতিহাসিক চিত্র , ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত , মুর্শিদাবাদ কাহিনী , ইতিহাসকথা প্রভৃতি । 
এই ইতিহাসমূলক প্রবন্ধগুলো এক অসামান্য কবির মানষলোকে ইতিহাসের স্থান কোথায় তার উদাহরণ । এক কবির চিন্তায় ও দৃষ্টিতে ইতিহাসের ব্যাখ্য কেমন হতে পারে তাঁর প্রকৃষ্টতম নিদর্শন রবীন্দ্ররচিত ইতিহাস বিষয়ক কতিপয় প্রবন্ধাবলী । 

বিশেষ করে "ভারতবর্ষের ইতিহাস" ও "ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা" এই প্রবন্ধ দুটি আমাদের ইতিহাস ভাবনার জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম । খ্যাতিমান ঐতিহাসিক অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর  - "রবীন্দ্রনাথ ও ইতিহাস চিন্তা" শীর্ষক  প্রবন্ধে রবীন্দ্র প্রতিভার এই বিশেষ দিক দিয়ে আলোচনা করেছেন । অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস বিষয়ক ভাবনাকে তাঁর বহুমুখী ও বহুদর্শী প্রতিভার অবিস্মরণীয় বিকাশ হিসেবে দেখিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের জ্ঞান সাধনা ও ইতিহাস দৃষ্টির স্বাক্ষর ইতিহাস চর্চা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা । 

          ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন --- ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই , তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র । কোথা হইতে কাহারা আসিল , কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল , বাপে-ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল , একদল যদি বা যায় কোথা হইতে আর-একদল উঠিয়া পড়ে পাঠান-মোঘল পর্তুগিজ-ফরাসী-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে জটিল করিয়া তুলিয়াছে । 
কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের  দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না । ভারতবাসী কোথায় , এ-সকল ইতিহাস তাহার কোনো উত্তর দেয় না । যেন ভারতবাসী নাই , কেবল যাহারা কাটাকাটি খুনোখুনি করিয়াছে তাহারাই আছে । ...

রবীন্দ্রনাথ রাজবৃত্তের ইতিবৃত্তকে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বলে মনে করেননি । ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের অপূর্ণতা নির্দেশ করে কবি ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস রুপে এই ভূখণ্ডের গণ মানুষের ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষ জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন তাঁর প্রবন্ধে । ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের ইতিহাস যতদিন না রচিত হবে , ততদিন পর্যন্ত এই জাতির উন্নতির আশা নেই বলে মন্তব্য করেছেন । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নির্বাচিত ইতিহাস পড়ানো হয় , তা জাতির মেধা ও মননশীলতার পথে প্রতিবন্ধক স্বরূপ বলে কবি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন । 

"শিবাজী ও মারাঠা জাতি" প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর মধ্যে ভারতীয় জাতীয় বিকাশের স্বরূপ লক্ষ্য করেছেন । গুরু গোবিন্দ সিংহকে ত্যাগ ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক রুপে বর্ণনা করেছেন । "কাজের লোক কে" প্রবন্ধে গুরু নানকের অসামান্য জীবনাদর্শকে উদ্ধৃত করেছেন । বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র সিরাজদৌল্লা গ্রন্থের ভুমিকা লিখতে গিয়ে কবি তৎকালীন সময়ের বাস্তবতার উপর নিজের মতামত দিয়েছেন । 

ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধগুলো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ,, কখনো গ্রন্থ সমালোচনা রুপে , কখনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থের ভূমিকা রুপে । কখনো বন্ধু ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র অনুরোধে । এছাড়া কবির বহু কবিতা , উপন্যাস , ছোটগল্পে ও ভ্রমণকাহিনীতে ইতিহাসের সুগভীর স্পর্শ পাওয়া যায় । বৌঠাকুরানীর হাট , রাজর্ষি , বিসর্জন , পারস্যের যাত্রী , জাভাযাত্রীর পত্র , কালান্তর , প্রাচীন সাহিত্যের ছত্রে-ছত্রে ইতিহাসের নির্যাস ছড়িয়ে রয়েছে । 

রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস রচনার কথায় উৎসাহী হয়ে রবীন্দ্রভক্ত ঐতিহাসিক লিখলেন বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব , ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসার মতো অসামান্য ইতিহাস গ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তা অনেকাংশে পূর্ণতা লাভ করেছিল নীহাররঞ্জনের ইতিহাস গবেষণার মাধ্যমে । এক মহাকবি এক মহান ঐতিহাসিকের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে গেছেন একান্ত নিভৃতে । সাহিত্যে , সঙ্গীতে , দর্শনের সঙ্গে ইতিহাসের ক্ষেত্রেও যুগপ্রবর্তন করেছেন । অনুপ্রানিত করেছেন রাবীন্দ্রিক ইতিহাস ভাবনাকে । এক কবির মাঝে এক ইতিহাসবেত্তার সত্ত্বা লুকিয়েছিল , তা যারা অনুধাবন করবেন তারা ভারত ইতিহাস চর্চার ধারায় "রাবীন্দ্রিক" অনুষঙ্গকে বুঝতে সক্ষম হবেন । 

অক্ষয়কুমার , সুনীতিকুমার , নীহাররঞ্জনরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন রাবীন্দ্রিক ইতিহাস চিন্তা ও চেতনাকে । আজ আমরা বিশ্বভারতী কতৃক প্রকাশিত "ইতিহাস - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" পাঠ করে তা পরোক্ষ ভাবে হলেও অনেকাংশে অনুধাবন করতে পারি । 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিময় ধ্যানগম্ভীর ভাবপ্রজ্ঞা দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাসকে কখনো প্রাচীনত্বের পটভূমিকায় , কখনো মধ্যকালীন পরিপ্রেক্ষিতে , কখনোবা আধুনিক কালের আবর্তে ইতিহাসের বিবর্তনকে অবলোকন করেছেন । আজ আমরা তাঁকে আবার নতুন করে বুঝতে চেষ্টা করছি মাত্র । একদিন হয়তো ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় জাতীয়তাবাদী , মার্কসবাদী , নিম্নবর্গীয় ধারার পাশাপাশি নতুন করে রাবীন্দ্রিক ধারাকে মাধ্যম রুপে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে পাবো । যে ধারার সঙ্গমে ঘটবে সমস্ত কিছুর সমন্বয় ।। 

তথ্যসূত্রে উল্লিখিত গ্রন্থ পাঠের ফলস্বরূপ সীমিত পরিসরের এই লেখা । দীর্ঘ লেখার ধৈর্য্য ও ক্ষমতা না থাকায় এবং এ সংক্রান্ত আরো অধিক জ্ঞানের সল্পতার কারণে লেখাটিকে সীমিত আয়তনে রেখেছি । তথ্যগত যেকোনো ত্রুটির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী । 
ধন্যবাদ ...

তথ্যঋণ : 
ইতিহাস 
জাভাযাত্রীর পত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,, (বিশ্বভারতী)

ভারতীয় ঐতিহ্য ও রবীন্দ্রনাথ 
ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা : নীহাররঞ্জন রায় ,, (দে'জ)

রবীন্দ্র সঙ্গমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ
সাংস্কৃতিকী : সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় । (আনন্দ)

◇ ছবিতে ইন্দোনেশিয়ার জাভাদ্বীপে বোরোবুদূর স্তূপ পরিদর্শনে রবীন্দ্রনাথ ......

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted