বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কালজ কবি বিনয় মজুমদার
বত্রিশ বছরের উদ্রান্ত অর্ধ-উন্মাদ যুবক কবি বিনয় মজুমদার, ১৯৬৬ সালে হঠাৎ করে, অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গোপালগঞ্জ মহকুমার তাড়াইল গ্রামের পৈত্রিক ভিটায় চলে আসেন।
বিনয় মজুমদার ঘোষণা দিয়েছিলেন - প্রয়োজনে তিনি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন, তবুও তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ব পুরুষের বাড়িতে বসবাস করবেন।
বিনয় মজুমদার ঘোষণা দিয়েছিলেন - প্রয়োজনে তিনি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন, তবুও তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ব পুরুষের বাড়িতে বসবাস করবেন।
পাকিস্তান সরকার বিনয় মজুমদার-কে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। জেলে বসে তিনি শিক্ষিত কয়েদিদের মুখে শুনলেন এক আদ্ভুত কথা যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে অনেক বড় কবি নজরুল ইসলাম। শুধু তা-ই নয়, নজরুল ইসলামের নোবেল পুরস্কার চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিনয় মজুমদার হেসে বলতেন, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কাজী নজরুল ইসলাম তখন কোন কবিতা লেখেননি..." লোকজন তার কথা বিশ্বাস করত না। পরে, বনগাঁ সীমান্তে কবিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে সম্মত হওয়া সত্ত্বেও, তার জীবনের মহা সর্বনাশ করে দিয়েছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা- কবির বাম চোখ আর বাম কান নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। সংবাদপত্রের পাতায় শিরোনাম হয়েছিল 'কবি বিনয় মজুমদার সীমান্ত মানে না।'
বিনয় মজুমদারের ভাষায়, "নমঃশূদ্র সমাজে তখন কবি বলে কেউ ছিল না। আমি প্রথম নমঃশূদ্র কবি। ... ১৯৬৩ সালের কিছু চিন্তাকে আমি ভাবলাম, মৌলিক আবিষ্কার এবং সেগুলোকে আমি লিখে ফেললাম। লিখে ফেলে প্রথমে আমি ম্যাকমিলান কোম্পানিকে দিয়ে বললাম যে, দ্যাখো তো তোমরা ছেপে দিতে পারো কিনা পুস্তকাকারে। একদম একেবারে যা কিনা মৌলিক আবিষ্কার, যা কোথাও পাঠ্য নেই। ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম আমার কাছ থেকে তা অ্যাকসেপ্ট করল। ওরা বলল, হ্যাঁ, আমরা আপনার পাণ্ডুলিপিখানাকে যত্নের সঙ্গে প্রিজার্ভ করছি, আমাদের মিউজিয়ামে রেখে দিচ্ছি..."
কবি বিনয় মজুমদার উদ্ভাবিত গণিতের কিছু মৌলিক সূত্র- ইউরোপের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই মহাপ্রতিভাধর ব্যক্তিটি প্রথম যৌবনে দু'-দু'বার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কবি বিনয় মজুমদার ছিলেন কৃতি ছাত্র, রেকর্ড নম্বর নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ইঞ্জিনিয়ার। ঠাকুরনগর রেলস্টেশন সংলগ্ন শিমুলপুর গ্রামে, কবি তার পিতার রেখে যাওয়া বাড়িতে অত্যন্ত অবহেলিত অবস্থায় বসবাস করতেন । আশির দশকের শেষ দিকে নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে অবস্থানকালে, আমি ঠাকুরনগর রেলস্টেশনে যাতায়াতের সময় দেখেছি, দুষ্ট ছেলেরা রাস্তার পাগল মনে করে, পাথর ছুড়ে কবিকে রক্তাক্ত করছে।
কবি বিনয় মজুমদার আক্ষেপ করে বলতেন,"তিনি নমঃশূদ্র বিধায়,সাংঘাতিক অবহেলিত। কিন্তু মতুয়া মহাসঙ্ঘের শীর্ষস্থান- 'ঠাকুর বাড়ি' সংলগ্ন নমঃশূদ্র সমাজে বসবাস করতেন কবি। নমঃশূদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া দুষ্ট ছেলেরাই কিন্তু চরম অবজ্ঞায়, বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কালজয়ী নমঃশূদ্র কবির শরীরে দিনের পর দিন পাথর ছুড়ে, তাকে রক্তাক্ত করেছে। মহাপ্রতিভাধর বিনয় মজুমদারের ঘোরতর দুর্দিনে, কলকাতা থেকে গোবরডাঙা পর্যন্ত যারা, কবির প্রতি সহযোগিতার উদারহস্ত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন- তাদের প্রায় সবাই ছিলেন বর্ণহিন্দু এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ। যেমন কবির প্রথম জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ― বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সনাতন সদানন্দ দাশ
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................