সংহত সমাজের নৃত্য : লোকনৃত্য

সংহত সমাজের নৃত্য : লোকনৃত্য 

আপনি যে লোকনৃত্য করিতেন তাহা কী করিয়া বুঝিব! সেই দিন অপ্সরাদের কথা শুনিয়া রাগান্বিত হইয়াছিলেন।  স্বর্গের অপ্সরা, মন্দিরের দেবদাসী  আর রাজপ্রাসাদের সুন্দরী নর্তকী ছাড়াও যে সাধারণ মানুষ নৃত্য করিতে পারে তাহা ভাবি নাই । আপনি লোকনৃত্য করিবার জন্য জন্ম লইয়া ছিলেন বারংবার, তাহা কী করিয়া জানিব! যাহা হউক আপনি যাহা শুনাইলেন তাহা আমি একবার উদ্গিরণ  করিতেছি। আহা হা নাসিকায় হস্ত রাখিতেছেন কেন? সেই উদ্গিরণ নহে। লোকনৃত্য লইয়া যাহা বলিলেন তাহা একবার বলিতেছি, মিলাইয়া লন-
লোকনৃত্য  কোনও একক নৃত্য নহে। ইহা সংহত সমাজের নৃত্য। উক্ত নৃত্যে প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করিতে পারিত। যাহারা নৃত্য করিতে পারিত না তাহারা বাদ্য বাজাইয়া অথবা দর্শকের ভূমিকায় রহিয়া উৎসাহ প্রদান করিত। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিত। ইহাতে কাহারও ব্যক্তিগত প্রতিভা প্রকাশের অবকাশ রহিত না। ইহা হইল স্বাভাবিক আনন্দের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করিতে পারিত। বিচ্ছিন্ন সমাজকে এক সূত্রে গ্রন্থিত করিবার শক্তি ইহার প্রবল। গ্রামের সাধারণ  মানুষের দৈনন্দিন সুখ, দুঃখ, ব্যাথা, বেদনার প্রকাশ হইত লোক নৃত্যে। লোকনৃত্য বেশ কয়টি ভাগে বিভক্ত, যথা -সামরিক, সামাজিক ও ধর্মীয়। 
সামরিক নৃত্যের উৎপত্তি রাজা মহারাজা ও জমিদারদের সময় হইতেই। রাজা ও জমিদাররা নিজেদের রাজত্ব রক্ষা করিবার কারণে সৈন্য বা লাঠিয়াল রাখিত। বাংলার রায়বেঁশে, লাঠি নৃত্য, তরবারি নৃত্য, ঢালী নৃত্য এবং কেরালার ভেলাকালি নৃত্য হইল সামরিক নৃত্য। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করিয়া ধর্মীয় লোকনৃত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। বাংলার বাউল নৃত্য, গাজন নৃত্য, চড়ক গম্ভীরা, ভাদু নৃত্য, জারি নৃত্য  এবং মালাবারের থেরায়ট্যম প্রভৃতি ধর্মীয় নৃত্য। এছাড়া বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকনৃত্য পরিবেশন করা হইয়া থাকে এগুলোকে সামাজিক লোকনৃত্য বলা হয়। যেমন বৌনৃত্য,ছৌনৃত্য।
সমাজ আদিম কাল হইতে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়াছে। সমাজের এই বিবর্তনের মধ্য দিয়া লোক- সংস্কৃতির প্রবাহ ফল্গুধারার মত প্রবাহিত হইয়া জাতির জীবন -তরুকে রস -সিঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে। এই লোক -সংস্কৃতি ফুলে, ফলে পল্লবিত হইয়া সমাজের আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়াইয়া  রহিয়াছে। 
যখন রাজা মহারাজারা সুরা পান করিয়া রাজ প্রাসাদে রাজনর্তকীর নৃত্য দেখিতেন,তখন প্রজাগন ভুক্ত কিংবা অর্ধভুক্ত হইয়াও মাঠে, ঘাটে আপন মনের মাধুরী মিশাইয়া সমবেত হইয়া নৃত্য করিত। ইহারা শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিধিনিষেধ জানিত না। ইহার ধারা লোক সমাজই বহন করিয়াছে।  সেই কারণে আজও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের বর্ণাঢ্য লোকনৃত্যের  প্রচলন রহিয়াছে।  
---কৈশোরে বিদ্যালয়ে পড়িবার সময় ব্রতচারী শিখিতে গিয়া লোকনৃত্য  শিখিয়াছিলাম। জানিয়াছিলাম, ইংরেজদের শাসনকালে (1903) গুরুসদয় দত্ত ইংল্যান্ডে সিভিল সার্ভিস পড়িতে গিয়া সেই স্থানে লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান দেখিয়া অভিভূত হইয়াছিলেন। ইহার পর দেশে ফিরিয়া বাংলার লোকসংস্কৃতিকে উদ্ধার করিয়া বাংলার যুব সম্প্রদায় ও সমাজকে সচেতন করিবার পরিকল্পনা করিয়াছিলেন। দেশে ফিরিয়া 1923খ্রিঃ এ তিনি মৈমনসিংহে Folk Dance and Song Society স্থাপন করিয়াছিলেন। পরে উক্ত সমিতির সদস্যদের লইয়া 1932খ্রিঃ এ ব্রতচারী সমিতি গঠণ করিয়াছিলেন। উক্ত সমিতির মাধ্যমে ব্রতচারী আন্দোলন শুরু করিয়াছিলেন। কলকাতার 12 নম্বর লাউডান স্টিটে তাঁহারা প্রধান কার্যালয় অবস্থিত ছিল। তিনি পাঁচটি ব্রতের প্রবর্তন করিয়াছিলেন। এই ব্রতের কারণে যুবসম্প্রদায়ের চারিত্রিক গঠণ দৃঢ় করিতে চাহিয়াছিলেন। এই পাঁচটি ব্রত হইল -জ্ঞান ব্রত, শ্রম ব্রত, সত্য ব্রত, ঐক্য ব্রত, আনন্দ ব্রত। যাহারা উক্ত ব্রত পালন করিত তাহাদের ব্রতচারী বলা হইত। উক্ত  ব্রতে  জ্ঞানের প্রতীক জ্বলন্ত মশাল, শ্রমের প্রতীক কোদাল, সত্যের প্রতীক কুঠার, ঐক্য এর প্রতীক সরল রেখাকে ধরা হইয়া থাকে। আর উক্ত  চারিটি ব্রত আনন্দের সহিত সাধনা করিলে তবেই ব্রতচারী হওয়া সম্ভব হয়। তাঁহার নিজের ভাষায়, “দেহ করে সক্ষম, বল আনে চিত্তে, ব্রতচারী নৃত্যে স্থান তাই কৃত্যে।” বাংলার প্রায় সমস্ত লোকনৃত্যের চর্চা করা হইয়া থাকে উক্ত ব্রতচারী সমিতিতে। দেশপ্রেম, নাগরিকত্ব বোধ ও জাতীয়তা বোধ জাগাইতে চাহিয়াছিলেন এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। তিনি বলিতেন-
“ষোল আনা বাঙালি হ
বিশ্ব মানব হবি যদি
শাশ্বত বাঙালি হ।”
 (এই সকল উপদেশ অবশ্য বর্তমানে যুবসমাজ মানিতে চাহিবে না। অবাঙালি হইতেই ইহারা বেশি আগ্রহী। একবার বিদেশে যাইতে পারিলে দেশের পিতা মাতার খবরই রাখিতে ভুলিয়া যায়- তথ্য সূত্র? দৈনন্দিন খবরের কাগজ)
-এত সুন্দর আয়োজন করিয়া, এত সুন্দর কথা বলিয়াও শেষ পর্যন্ত উক্ত মহান ব্যক্তি গুরুসদয় দত্ত মহাশয় 1941 খ্রিঃএ কর্কট রোগে আক্রান্ত হইয়া  মৃত্যু বরণ করিয়াছিলেন। পরবর্তীতে ভারত স্বাধীন হইলে ভারত সরকারের প্রচেষ্টায় লোকনৃত্য পুনরুজ্জীবিত হইয়া উঠিল। স্বাধীনতার পূর্বে লোকনৃত্য সম্ভ্রান্ত সমাজের মনোযোগ পায় নাই। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর কালে জনসমাজে লোকনৃত্য সম্বন্ধে একটি চেতনা বোধ দেখা গিয়াছিল। দেশীয় সংস্কৃতির ওপর মমত্ববোধ জাগিয়াছিল, স্বদেশ ও স্বজাতিকে চিনিবার একটি অদম্য স্পৃহাও জাগিয়া উঠিয়াছিল। যাহার ফলে উত্তর ভারতের হিমালয় হইতে দক্ষিণের কন্যা কুমারিকা পর্যন্ত জানা অজানা সকল লোকনৃত্যকে ভারত মাতার বেদীতলে সংস্কৃতির অর্ঘ্যে সাজাইয়া দেওয়া হইয়াছিল।-- ঠিকঠাক বলিয়াছি কিনা মিলাইয়া লন। আপনি পূর্ব জন্মে সারা ভারত জুড়িয়া লোকনৃত্য করিয়া বেড়াইতেন জানিয়া বড়ই প্রীত হইলাম। আপনার কাছে বিভিন্ন জায়গার গল্প শুনিয়া সমৃদ্ধ হইলাম- 
কেরলে জন্মাইয়া আপনি যে লোকনৃত্য করিয়াছেন তাহাকে ভেলাকালি বলা হইয়া থাকে। ইহা সম্বন্ধে বলিতেছি। মিলাইয়া লন-
 নৃত্যের নাম ভেলা কালি নৃত্য। ইহা  কেরলের একটি সামরিক নৃত্য। সাধারণত নায়াররা এই নৃত্য করিত। ত্রিবাঙ্কুরের পদ্মনাভ স্বামীর মন্দিরে ফাল্গুন -চৈত্র মাসে এই নৃত্য পরিবেশন করিত। ইহাতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ দৃশ্য দেখানো হইত। অবশ্য এখনও ভেলাকালি নৃত্যে এই দৃশ্য দেখানো হয়।  নর্তকরা কুরুদের ভূমিকায় অভিনয় করিত। এবং পাণ্ডব দের কাঠের মূর্তি তৈয়ারি করিয়া মন্দিরের রাস্তার পাশে পুঁতিয়া রাখিত।-- অদ্ভুত নৃত্য বটে! --- যাহা হউক, নৃত্যে ড্রাম ও ভেরী বাজাইয়া যুদ্ধ ঘোষণা করা হইত। প্রত্যেক নর্তক -যোদ্ধা বাম হস্তে ঢাল ও ডান হস্তে একটি লাঠি লইয়া নৃত্য করিত। সাদা লুঙ্গির উপর একটি লাল রঙের কাপড়ের বাঁধিয়া লইত। আর একটি কাপড়ের টুকরা হাতে বাঁধিয়া লইত। মস্তকে লাল পাগড়ি বাঁধিত। ধীর লয় থেকে দ্রুত লয়ে নৃত্য পরিবেশন করিত। যুদ্ধের নানা রকম কৌশল নৃত্য করিয়া দেখানো হইত। পরিশেষে কুরুদের পলায়ন দৃশ্য দিয়া নৃত্যের সমাপ্তি হইত।–-ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই মহাভারত!  শোনা যায়, পূর্ব কালে  সৈন্যরা যুদ্ধ করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া গেলে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি কাটাইতে সৈন্যদের একাংশ নৃত্য গীতের আয়োজন করিত। তাহা হইতেই সামরিক নৃত্যের উৎপত্তি। অর্থাৎ পুরুষরা শুধুমাত্র যুদ্ধই করিত না, দল বাঁধিয়া নৃত্যও করিতে পারিত! তাহা হইলে ইহাদের মহাভারতের অর্জুনের অবতার কেন বলিবেন না?     
--আপনি তো আবার কোন জন্মে যেন রাঢ়বঙ্গে জন্মাইয়াছিলেন। এইবার আপনি বীরভূম জেলার যে নৃত্যের কথা বলিয়াছেন তাহা বলিতেছি আপনি যে এমন নৃত্য করিতেন কী করিয়া জানিব!--- আপনাদের রাঢ়বঙ্গের ঐ নৃত্যের নাম রায়বেঁশে, কেহ কেহ রাইবেশে বলিয়া থাকে! বাংলার বীরভূম জেলার রাজনগর ও তার পার্শবর্তী অঞ্চলে ভল্ল জাতির মধ্য এই নৃত্য প্রচলিত ছিল। ‘ভল্ল’ শব্দ বলিতে বোঝানো হয় বল্লম জাতীয় অস্ত্রকে।। ‘রায়’ অর্থাৎ পাকা, ‘রায় বাঁশ’ অর্থাৎ পাকা বাঁশ লইয়া যে নৃত্য করা হয় তাকে বলে রায়বেঁশে নৃত্য। ‘রায়বেঁশে’ নামে একশ্রেণীর সৈন্যের কথাও জানা গিয়াছে। সাধারণত ইহারা প্রাচীন কালে নিম্নশ্রেণী অথবা নিপীড়িত শ্রেণী হইতে আসিত। কাহারও মতে পূর্বে পর্তুগিজ জলদস্যুদের ও অন্যান্য বিদেশিদের কু দৃষ্টি হইতে নিজ সমাজের নারীদের রক্ষা করিবার জন্য গ্রামের পুরুষরা এই পাকা বাঁশের লাঠিকে অস্ত্র করিয়া নিরাপত্তা বাহিনী গড়িয়া তুলিয়াছিল। ইহারাই পরবর্তীতে নৃত্য করিয়া শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করিত। ইহারাই জলদস্যুদের শিক্ষা দিবার কারণে কোনও একজন পুরুষ ‘রাধা’(রাই)র বেশ ধারণ করিয়া জলের কাছে থাকিত। অন্য লাঠিয়ালরা কাছাকাছি জঙ্গলে লুকাইয়া থাকিত। দস্যু নকল রাধার নিকট আসিলে সকল লাঠিয়াল বাহির হইয়া আক্রমণ করিয়া উপযুক্ত শিক্ষা দিত। সেই কারণে এইনৃত্য কে রাইবেশে নৃত্য বলা হয়।-- ইহা হইতে বর্তমান পুরুষরা শিক্ষা লইতে পারে। ইহারা তো নিজের দেশের নারীকে নিজেরাই অত্যাচার করিয়া, হয় নারীর নাড়িভুঁড়ি টানিয়া বাহির করিয়া আনে,না হয় জীবন্ত পুড়াইয়া মারে।---নীরব থাকিব কেন ? সে তো জীবিতাবস্থায় ছিলাম। এখন আমার কথা কেহ শুনিতে পাইবে না। এইক্ষণে উচ্চস্বরে বলিলেও ক্ষতি নাই। -- ওহ বিতর্কিত কথাটি বলা হইলো না!  লোকসংস্কৃতির গবেষক পুলকেন্দু সিংহের মতে, দিল্লির মসনদে যখন আকবর বাদশাহ ছিলেন, তখন অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানাঞ্চলে ফতেসিং পরগনায় ফতে হাড়ি নামক এক স্বাধীনচেতা সামন্তরাজা রাজত্ব করিতেন। তাঁহার সৈন্যসামন্ত, দুর্গ, গড় সকলই ছিল, আর ছিল তাঁহার হস্তী বাহিনী। তিনি দিল্লির শাসন মানিতেন না। ওই সময়ে ফতেসিং পরগনা সংলগ্ন অধুনা খড়গ্রাম থানার শেরপুর নামক দুর্গে দুর্গরক্ষক ছিলেন ওসমান খান। তিনি ছিলেন সুলতানি শাসকদের প্রতিনিধি। ইহারাও দিল্লির শাসন মানিতেন না। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মান সিংহকে আকবর এই অঞ্চলে পাঠাইয়া ছিলেন এঁদের দমন করিতে এবং মুঘল শাসন কায়েম করিতে। মান সিংহের সঙ্গে আসেন তাঁর সহকারী সেনাধ্যক্ষ সবিতা রায় দীক্ষিত। তাঁর সঙ্গে ছিল দুর্ধর্ষ  ভীল সৈন্যদল, অর্থাৎ ভল্ল বা বল্লমধারী যোদ্ধা।
মান সিংহ ওসমান খাঁকে পরাভূত করিয়া  এই অঞ্চলে মুঘল শাসন কায়েম করিয়া ছিলেন। সবিতা রায় দীক্ষিত মান সিংহের নির্দেশে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী মুণ্ডমালা নামক স্থানে হাড়ি রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করিয়াছিলেন । পুরস্কারস্বরূপ দিল্লির বাদশাহের অনুমতি লইয়া তাঁকে ফতেসিং পরগনার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। গড় নির্মাণ করিয়া  তিনি এই স্থানে থাকিয় যান। জেমো-বাঘডাঙার রাজপরিবার সবিতা রায়ের উত্তরাধিকারী। রাজস্থান থেকে আগত ভল্লধারী যোদ্ধাবৃন্দও বাধ্য হইয়া  এইস্থানে  রহিয় যান। তাঁহরাা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হলেও চাষ-আবাদের কাজ জানিত না। শেষ পর্যন্ত তাঁহারা লাঠিয়াল, পাইক-বরকন্দাজের জীবিকা গ্রহণ করিত। অনেকে আবার লুঠতরাজও করিত। উহারা রাঢ় বাংলায় ছড়াইয়া বসবাস করিয়াছিল। নিম্নশ্রেণীর মানুষদের বিশেষ করিয়া হাড়ি, বাগদি, ডোম, বায়েন দের  লইয়া রায়বেঁশে দল গঠণ করিয়াছিল। বুঝিয়াছি, ‘মরাল অফ দ্য স্টোরি‘ ইহা দাঁড়াইল যে এই নৃত্যের পশ্চাতে বাদশাহ আকবরের পরোক্ষ অবদান রহিয়াছে। 

এই নৃত্যে নর্তকরা মুখে হাত দিয়া আওয়াজ করিতে করিতে লাফাইয়া রঙ্গস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইত। মালকোঁচা দিয়া ধুতি পরিয়া,  পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া, ঢাকের বাজনার তালে তালে নৃত্য করিত। ইহাতে করতাল, কাঁসর, ঘন্টা ইত্যাদি বাজানো হইত। বাজনার তালে তালে কাঁধ ও বক্ষ ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে তাহারা নৃত্য শুরু করিত।
পরবর্তীতে  বাজনার লয় বৃদ্ধি  পাইত এবং তাহাদের কসরত্ নৃত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাইত। হাতে পাকা বাঁশ বা লাঠি লইয়া নৃত্য করিত।-রায়বেঁশে নৃত্য তো ‘মার্শাল আর্ট’কে স্মরণ করাইতেছে! বাঁশের কথা শুনিয়া আমার আর একটা নৃত্যের কথা স্মরণ হইল- 
মিজোরামের চিরাউ নৃত্য। সামরিক লোক নৃত্য না হইলেও বাঁশ লইয়া নৃত্য করিতে হয়। ছয় অথবা আটজন পুরুষ মিলে দুটো করিয়া লম্বা বাঁশ লইয়া তালে তালে বাঁশ জোড়া ও ছাড়া করিয়া থাকে। খানিকটা হাতে তালি দিবার মত। নারীরা তাহার তালে তালে বাঁশের ফাঁকে পা রাখিয়া নৃত্য করে। ইহা  মিজোরামের সর্বাধিক জনপ্রিয় লোকনৃত্য। বিবাহ ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে চেরাউ নৃত্য প্রদর্শন করা হইয়া থাকে। ফিলিপিন্সরা একই নৃত্য করিয়া থাকে, ভিন্ন নামে। তাহারা এই নৃত্যকে টিংক্লিঙ বলিয়া থাকে। বর্তমানে বসিয়া বসিয়া ফেসবুক না ঘাটিয়া নৃত্য গুলি প্রতিবেশী লইয়া অভ্যাস করিতে পারেন। তবে সাবধান! ভাবের ঘোরে তাল কাটিবেন না। একবার তাল কাটিলে  দুই দিক হইতে বাঁশের আঘাত খাইতে হইবে কিন্তু! প্রতিবেশী লইয়া নৃত্য করিতে গিয়া ঘরের মানুষকে প্রতিবেশী বানাইবেন না, আর প্রতিবেশীকে অধিক প্রশ্রয় দিয়া ঘরে আনিবেন না। দুই পক্ষের সহিত ভিন্ন তালে নৃত্য করিবেন। তাহা না হইলে  দুইদিক হইতে বাঁশের আঘাত খাইতে হইবে, জীবন মৃত্যু  কেহই ছাড়িবে না।
আজ এই পর্যন্ত, পরের দিন আবার আপনার পূর্বজন্মের গল্প শুনিব এবং উদ্গিরণ করিব। এসকল গল্প আপনিই শুনায়াছেন, সুতরাং তথ্যসূত্র দিবার দায়িত্ব আমার নয়।

**************************
তথ্য সূত্রঃ 
1)নৃত্য বিতান- অনুপ শঙ্কর অধিকারী 
2) নৃত্যে ভারত-ডঃ মঞ্জুলিকা রায় চৌধুরী
3)http://www.onlytravelguide.com/mizoram/arts-crafts/cheraw-dance.php
4)আনন্দবাজার পত্রিকা -সম্পাদক সমীপেষু, 13নভেম্বর 2017..পুলকেন্দু সিংহ।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted