টিকা বা ভ্যাক্সিন আসার আগে এই পৃথিবী ছিলো মানুষের বসবাসের জন্য খুবই অযোগ্য।

‘ইন্ডিয়ার টিকা’ বলতে কিছু নেই ফরহাদ মজহার! যেমন ’সাম্রাজ্যবাদী টিকা’ বলতেও কোনকালে কিছু ছিলো না। কিন্তু সেই ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার যখন গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কার করলেন তখন ভারতেও এই টিকা দেয়ার সময় তখনকার ’ফরহাদ মজহাররা’ বলেছিলো এই টিকা দিয়ে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মেরে ফেলবে নয়ত জাদু করে বশ করে ফেলবে! ব্রিটিশ সরকার বিশাল ভারতবর্ষে টিকার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে সেটা যাতে ভেস্তে না যায় তাই মহীশূরের রাজা কৃষ্ণরাজার স্ত্রী দেভাজাম্মানিকে বেছে নেন। এই ভদ্রমহিলা গুটি বসন্তের টিকা নেন এবং তার টিকা দেবার ছবি প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে সবাইকে আশ্বস্ত করা হয়েছিলো যে এই টিকা নিরাপদ। কারণ ছড়িয়ে পড়েছিলো বসন্তের জীবাণু শরীরের ঢুকিয়ে আরো বেশি করে মারার চক্রান্ত করা হচ্ছে। টিকা নেয়ার পর মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়ায় গুজব আরো তেঁতে উঠে। মজাটা হচ্ছে ভ্যাক্সিনের কাজটাই কিন্তু এভাবেই হয়।এডওয়ার্ড জেনার বসন্তের ভাইরাস শরীরে ঢুকিয়েই চিকিৎসা করেছিলেন। সংক্ষেপে কাহিনীটা না বললে বুঝা যাবে না ভ্যাক্সিন কি করে কাজ করে। এডওয়ার্ড জেনার দেখলেন গরুর খামারে যারা কাজ করে তাদের বসন্ত হওয়ার ঘটনা একদমই নেই! রোগটি যেন তাদের এড়িয়ে চলে। তিনি একদিন এক গোয়ালিনির বাড়ি গেলেন স্বচোক্ষে দেখতে। গিয়ে দেখেন খামারের গরুগুলোর গুটি বসন্ত হয়েছে। জেনার অনুমান করলেন গরুর শরীরের ভাইরাসটি মানুষের দেহে গিয়ে তেমন ক্ষতি করতে পারে না উল্টো মানুষের বসন্ত রোগের ভাইরাসকে দুর্বল করে দেয়। এটা পরীক্ষা করে দেখতে তিনি এক বালকের শরীরে প্রথমে গরুর বসন্তের জীবাণু প্রবেশ করান। তখন সে সামান্য অসুস্থ হয় এবং সেরে উঠে। পরে মানুষের বসন্তের জীবাণু প্রবেশ করান আর দেখতে পান ছেলেটির গুটি বসন্ত হলো না। অর্থ্যাৎ গরুর বসন্ত জীবাণু তাকে মানুষের ভয়ংকর বসন্তের জীবাণু থেকে রক্ষা করেছে। মানে গরুর বসন্তের জীবাণু মানুষের ভয়ংকর বসন্তের ভাইরাস ‘ভ্যারিওলা’কে দুর্বল করে ফেলেছে!

এই পদ্ধতি আবিস্কার করেই ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে লুই পাস্তুর জলাতংকের টিকাও আবিস্কার করেছিলেন। টিকা বা ভ্যাক্সিন আসার আগে এই পৃথিবী ছিলো মানুষের বসবাসের জন্য খুবই অযোগ্য একটা জায়গা। নানা রকম ভাইরাস প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষকে মেরে ফেলত। বহু বড় বড় বীর সামান্য একটা প্যারাসিটমল ট্যাবলেটের অভাবে মারা গেছেন! হামের মত রোগে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের আগে প্রতিবছর ২৬ লক্ষ মানুষ মারা যেত! এখন শিশুদের এই রোগের টিকা দেয়ার কারণে এটি এখন মামুলি একটি রোগ! কলেরা প্লেগের মত রোগগুলোর টিকা আবিস্কারও মানুষকে এই পৃথিবীতে বসবাসের উপযোগীতা দিয়েছে যা একান্তই মানুষের প্রচেষ্টা। মিশরের মমিতেও গুটি বসন্তের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেই রোগটি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে টিকা আবিস্কারের পরও নির্মূল হতে দুইশো বছর লেগেছিলো মানুষের মাঝে নানা রকম গুজবের কারণে। আর এই গুজবগুলো কারা রটায় কি কারণে রটায় সেটাই বলব। ফরহাদ মজহারদের রোগটাই বা কি সেটাও জানা দরকার।

এই পৃথিবীটা যে ঈশ্বর মানুষের উপযোগী করে সৃষ্টি করেননি এটা যদি মানুষ বুঝে যায় তাহলে কথিত ঈশ্বরের নাম ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার ভয়ে চিরকালই ধর্মবেত্তারা ভীত হয়েছে। রোগশোক দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা বা অভিশাপের মত অস্ত্র এইসব টিকার মাধ্যমে বিনাশ হয়ে গেলে মানুষ ভয়ডরহীন হয়ে যাবার আশংকা করে ধর্মালয়গুলো। করোনার সময় যে টাটকা অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে ফলে ইতিহাস থেকে আর উদাহরণ দিলাম না। এদের ছাড়াও ভ্যাক্সিন নানা রকম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের ভয়ের কারণ ছিলো। তারা মনে করত এর মাধ্যমে সরকার জনগণের সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়ে সফল হয়ে যাবে। যেমন ফরহাদ মজহার অহেতুক ভয় পাচ্ছে ভারত টিকা দিয়ে বাংলাদেশকে যেভাবে অন্যান্য দেশ থেকে অনেক আগে টিকা প্রদানের সুযোগ করে দিয়েছে তাতে দেশের জনগণের ভারতবিরোধী মনেভাবে ভাটা পড়ে যেতে পারে। মহামারীর সময়ই একমাত্র আমরা ধর্ম জাতি বর্ণ নিবির্শেষে যে মানব সন্তান সেই সত্যটা বেরিয়ে আসে। তখনই এইসব বিভাজন ভাঙ্গিয়ে যারা খায় তাদের ভয় চলে আসে। ভ্যাক্সিন যে সৌহাদ্যের বার্তা নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সেই আবহে রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা একটা বড় ঝাঁকি খায়। জেনার ইংরেজ বলে কি তার আবিস্কার সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক বলা লোক অগ্রাহ্য করেছে? লুই পাস্তুর অমুসলিম বলে কি বড়হুজুরের ছেলেকে কুকুর কামড়ালে টিকা নিবে না?

বসন্তের টিকা আবিস্কার হওয়ার পরও পৃথিবী থেকে এই রোগ বিদায় নিতে দুইশো বছর লেগেছিলো এরকম প্রতিবন্ধিকতার কারণে। এসব কাজে চিরকালই দেখা গেছে এক শ্রেণীর দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, প্রফেসররা বড় ভূমিকা রেখেছেন। উলিয়াম পেলের একটি ক্যামেরা থাকলে ক্যামেরার সৃষ্টিকর্তাও থাকবে- এই বক্তব্য পরবর্তীকালে গোড়া মুসলিম যুক্তিবাদীরাও আউড়িয়েছে বা তাকে বিরাট বিজ্ঞানী সাজিয়ে কোট করেছে। যেমন অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড নামের একজন ডাক্তার ভুয়া একটা গবেষণাপত্রে ভুল তথ্য দেন যে হাম রুবেলার টিকা দিলে শিশুদের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তার এই কথায় ব্যাপক সাড়া পড়ে। ব্রুকলিনে অতি-কট্টর ইহুদি মহল্লায় ইহুদী ধর্মগুরুরা প্রচার চালায় হাম রুবেলা টিকা দিলে শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হয় কারণ এটা ঈশ্বরের উপর খবরদারি আর বিজ্ঞান সেটা প্রমাণ করে দেখিয়েছে! ভয়ংকর কথা হচ্ছে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে এ ধরণের প্রচারণায় শিশুদের এই টিকা দেয়ার হার একদম কমে যায়। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প হামের টিকার বিরোধীতা করে অটিজমের কথা বলেন এইসব কথিত গবেষণাপত্রের মাধ্যমে ছড়ানো গুজবে। অথচ অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ডের গবেষণা ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হওয়ায় তার মেডিকেল ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু সর্বনাশ যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এই যেমন করোনার টিকার কথাই ধরা যাক। মানুষের টিকা নিয়ে রাজনীতি, ব্যবসা, ধর্ম রক্ষার কারণে হয়ত বহুদিন লাগবে এই ভাইরাস নির্মূল হতে। ভারতের র’ এই টিকায় গোপন মাইক্রচিপ বসিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করবে- বলে এদেশের অশিক্ষিত হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে চাঙ্গা করতে গিয়ে ভাইরাস নির্মূল হতে হয়ত দেরি হবে, কিন্তু একদিন এইসব বিরোধীরাই লাইন দিয়ে করোনা টিকা নিতে যাবে।

এদেরকে গরু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম যখন জানলাম ভ্যাক্সিন শব্দটা এসেছে  ল্যাটিন শব্দ 'ভ্যাক্সা' থেকে যার অর্থ গরু! কাজেই গরুর মত প্রয়োজনীয় উপকারী প্রাণীকে আর অপমান করতে মন চাইল না!

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted