তিতুমীরকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস লিখেছেন। তাহলে নোয়াখালীর গোলাম সারোয়ারকে নিয়ে কেন উপন্যাস লেখা হলো না? বাঘমারার ’বাংলা ভাইকে’ নিয়েও উপন্যাস লেখা উচিত। লাদেনকে নিয়েও নিশ্চয় উপমহাদেশের কোন বামপন্থি একদিন উপন্যাস লিখবে! তিতুমীরকে নিয়ে প্রায় দেড়শো বছর পর মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস লিখেছেন। আমার তো মনে হয় নোয়াখালী দাঙ্গার নায়ক গোলাম সরওয়ারকে নিয়ে বাংলাদেশী কোন লেখক আগামী দশ পনোরো বছরের মধ্যে লিখে ফেলার মত সাহস পেয়ে যাবে। কেন এতটা বলতে সাহস করলাম তার কারণ তিতুমীরকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস। ১০৪ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটা আগে পড়া ছিলো না। এক ফেইসবুক বন্ধু ইনবক্সে এক বামপন্থি ভদ্রলোকের লেখা দিলেন। হাজি তিতুমীরকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস লিখেছেন। তাকে মহান কৃষক নেতা ও মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদ, প্রলেতরিয়েতদের সংগ্রামী কমরেডের স্বীকৃতি কেন এদেশে এখনো হলো না সেই আক্ষেপ তার। অগত্যা মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসটা পড়তে হলো। অন্য একটা লেখা বাদ দিয়ে বইটা পড়ে শেষ করলাম। বইটা পড়েই মনে হলো বাঘমারার বাংলাভাইকে নিয়ে তো একই রকম উপন্যাস লেখা যায়! আর নোয়াখালির গোলাম সরওয়ারকে নিয়ে তো রীতিমত রুশ বিপ্লবের মত উপন্যাস লেখা যায়। জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীকে ‘জার’ ও গোলাম সরওয়ারকে লেলিন ধরলে হয়! লাদেনকে নিয়ে ভারতের অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাস লেখা উচিত। লাদেন পুরো আমেরিকাকে অস্থির করে রেখেছিলো।
তার আদর্শ যাই হোক, সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামই এখানে ধাতব্যের তাই না? না হলে কি করে মহাশ্বেতা দেবী সৈয়দ আহমদের হাতে দীক্ষিত তিতুমীরের মধ্যে সংলাপে অবলীলায় লিখেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওহাবীদের ‘ধর্মযুদ্ধ’! ওহাবীদের নাম শুনলেই ইংরেজ নীলকর আর হিন্দু জমিদাররা ভয়ে কাঠ হয়ে যেত। কারা ওহাবী? যারা বলত আল্লার খিলাফত কায়েম করবে। দাড়ি রাখবে আর বাদ্য গানবাজনা বন্ধ রাখবে। মহাশ্বেতা দেবী কেন বাকীটা লিখলেন না? হিন্দুদের মত নাম (মানে বাংলায়!) রাখা যাবে না, হিন্দুয়ানী সমস্ত ত্যাগ করতে হবে, ঈদের নামাজ পড়া যাবে না যতদিন না ইংরেজ আর হিন্দু জমিদারদের হটিয়ে ইসলামের খিলাফত কায়েম না হয়। এই কথাগুলো এড়িয়ে গেলেন কেন তিনি?
তার আদর্শ যাই হোক, সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামই এখানে ধাতব্যের তাই না? না হলে কি করে মহাশ্বেতা দেবী সৈয়দ আহমদের হাতে দীক্ষিত তিতুমীরের মধ্যে সংলাপে অবলীলায় লিখেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওহাবীদের ‘ধর্মযুদ্ধ’! ওহাবীদের নাম শুনলেই ইংরেজ নীলকর আর হিন্দু জমিদাররা ভয়ে কাঠ হয়ে যেত। কারা ওহাবী? যারা বলত আল্লার খিলাফত কায়েম করবে। দাড়ি রাখবে আর বাদ্য গানবাজনা বন্ধ রাখবে। মহাশ্বেতা দেবী কেন বাকীটা লিখলেন না? হিন্দুদের মত নাম (মানে বাংলায়!) রাখা যাবে না, হিন্দুয়ানী সমস্ত ত্যাগ করতে হবে, ঈদের নামাজ পড়া যাবে না যতদিন না ইংরেজ আর হিন্দু জমিদারদের হটিয়ে ইসলামের খিলাফত কায়েম না হয়। এই কথাগুলো এড়িয়ে গেলেন কেন তিনি?
রাজশাহীর বাঘমারাতেও বাংলাভাই ‘ইনসাফ’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুসলমানদের কঠরভাবে ইসলাম মেনে চলা ও ইসলামী খিলাফত কায়েম করতে বর্তমান সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। নোয়াখালীতে গোলাম সরওয়ার হিন্দু জমিদার যারা বংশপরম্পরায় শাসক ছিলো, তাদের পতন, নোয়াখালীর মুসলমানদের নিজেদের দেশ, নিজেদের ‘হক’ প্রতিষ্ঠার জন্যই তো সরওয়ার মুসলিম লীগ করত। শত শত সাধারণ মুসলমানই জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর বাড়িতে আক্রমণ চালিয়েছিলো। এটাকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রলেতরিয়েতদের শ্রেণী সংগ্রাম না? নোয়াখালীর শ্যামপুর দায়রা শরীফের পীরজাদা গোলাম সরওয়ার তার মুরিদ ও অনুসারীদের নিয়ে হিন্দুদের কচুকাটা করেন। জমিদারকে উৎখাতের ডাক দিয়ে তিনি জনতাকে জমিদার রাজেন্দ্রলালের মন্ডু কেটে আনতে বলেন। তারা করেও সেটা। হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকান পাট লুট হয়। এইসব ব্যবসায়ীরা তো সব ‘মহাজন’ ছিলো তাদের মন্ডু কাটলে দোষ কি? নোয়াখালীর রায়পুরের জমিদার চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরী মুসলিম লীগে রাজনৈতিক উত্থানকে মেনে নিতে পারছিলেন না। পূর্ববঙ্গের প্রলেতরিয়েতদের নেতা তখন পীরজাদা গোলাম সরওয়ার। তার সঙ্গে বিরোধ বাধে। তার বাড়িতেও হামলা হয়। তিতুমীরের ৪৬ সালের ভার্সন ছিলো গোলাম সরওয়ার। যদি তিতুমীরকে নিয়ে উপন্যাস লেখা যায় তাহলে গোলাম সরওয়ারকে নিয়ে ’পাকা পায়খানা তালুকদার’ উপন্যাস লিখতে এখন লজ্জ্বা পেলেও আমার মনে হয় তিতুমীরের মত দেড়শো বছর লাগবে না তাকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে।
ওহাবী, ফারাজী, খিলাফত আন্দোলনগুলি কোনটাই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিলো না। সবগুলো ছিলো ভারতকে দারুল ইসলাম করার ইসলামী আন্দোলন। খোদ মুসলিম লীগের নেতা ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন মুসলমানরা কোনকালেই ভারতের স্বাধীনতা চায়নি, খেলাফত বা ওহাবী আন্দোলন ছিলো ধর্মীয়। আশ্চর্য লাগে ভেবে, আফ্রিকাতে বোকো হারাম পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে ও সেখানকার পশ্চিমা শাসকদের পছন্দের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে, তাহলে কি মহাশ্বেতা দেবী বোকো হারামকে সমর্থন করেছেন? মিশেল ফুকো ইমাম খোমিনির বিপ্লবকে প্রলিতরেয়িতদের বিপ্লব বলেছিলেন এবং খোমিনির রাজনৈতিক বিশ্বাস কি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন বলেছিলেন।
’তিতুমীর’ উপন্যাসটা মহাশ্বেতা দেবীর অন্যান্য উপন্যাসের মত সাহিত্য রসের কোন ছাপ নাই। তার আদিবাসীদের পাহাড়ের অধিকার, প্রকৃতি কোড়ে বসবাসের বাস্তব চিত্রায়ন ও তাদের সংগ্রাম যে ন্যাচারাল সাহিত্য ভাষায় উঠে আসে 'তিতুমীরে' সেটা হয়নি। এটা মনে হয় তার সাহিত্যের চাইতে রাজনৈতিক অভিলাষের উপন্যাস। মুসলমানদের ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাম্প্রদায়িক কৃষক বিদ্রোহের নায়ক ইত্যাদি করে তুলে আনাটা তার রাজনৈতিক তাগিদ ছিলো। মুসলমানদের গোড়া ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গি করে তোলার পিছনে ওহাবী আন্দোলন ছিলো ভূতের উল্টো পায়ে চলা যা মুসলমান সমাজকে আরো পশ্চৎপদ করে তুলেছে। তিতুমীর সফল হলে মহাশ্বেতা দেবীদের ৪৭ সালের আাগেই দেশ ছাড়তে হত আর বেগম রোকেয়া বহু আগেই ১৪ সন্তানের মা হয়ে সূতিকা রোগে ভুগে মারা যেতেন। নারী শিক্ষা আর অগ্রগতি? তিতুমীর আর শরীতুল্লাহ জয়ী হলে মহাশ্বেতা দেবীই বামপন্থি হতেন না! ইংরেজ জয়ী হয়েছিলো বলেই রোকেয়া সময়ের বিপরীতে লড়তে পেরেছিলেন। আমি ইংরেজদের সুনাম করছি না। আমি বলছি ভারতকে ভারতীয়রাই শাসন করবে কিন্তু সেরকম ভারতীয়দের তখন জন্ম হয়নি। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় জিজিয়া কর দিয়ে যদি বাঁচতে হত তাহলে আজকে এত কথা মুখ দিয়ে বেরুত না।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................