হিন্দু নিরর্যাতেন পন্থা ভারত-সংযোগের বিভিন্ন কাল্পনিক অভিযোগ উত্থাপন।

আশির দশকের দ্বিতীয়ভাগ ও নব্বই দশকের প্রথমভাগ জুড়ে আমি বাংলাদেশের একটি মফস্বল শহরে বসবাস করতাম। শহরটির নাম এখানে বলব না। তবে আমি নিশ্চিত- ঐ শহরের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি এই লেখাটি পড়বেন এবং আমি যে ঘটনাবলী বর্ণনা করার চেষ্টা করব, সেই সমস্ত ঘটনার তারা চাক্ষুষ সাক্ষী। প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা ভুক্তভোগী কেউ যদি এখানে কমেন্ট করেন ― সেক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে কমেন্ট করবেন- যাতে কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত না হয়।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনকার সময়ে পাকিস্তানপন্থীদের অপশাসনে, ঐ এলাকার হিন্দুদের জীবনে নেমে এসেছিল নরকের অন্তহীন অন্ধকার। 'অলওয়েজ গভমেন্ট পার্টি'- নামে খ্যাত মাস্তানচক্র, হিন্দুদের দোকান থেকে বারো মাস দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে যেত, দাম চাইতে গেলে চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি-লাথি। পদস্থ কর্তাব‍্যক্তিরা নানাভাবে হিন্দুদের হয়রানি করে - চাপ দিয়ে টাকা আদায় করত। টাকা আদায়ের সহজ উপায় ছিল, ভারত-সংযোগের বিভিন্ন কাল্পনিক অভিযোগ উত্থাপন। যেমন অনেক হিন্দুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হতো- যে তারা ভারতে বাড়িঘর করেছে, অথচ ঐ অভিযুক্ত হিন্দুদের অধিকাংশ জন্মের থেকে ভারতের মাটিতে পাড়া দিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। এছাড়া ভারতে টাকা পাচার, ভারতীয় অবৈধ পণ্যের স্মাগলিং - ইত্যাদি কমন অভিযোগ তো রয়েছেই। তার উপরে অমুক সাহেব তার এলাকায় মাদ্রাসা বানাবে, তমুক সাহেব তার বাড়িতে মসজিদ বানাবে অথবা এতিমখানার টিনের চালা টর্নেডোতে উড়িয়ে নিয়ে গেছে ― ইত্যাদি নানান অজুহাতে হিন্দু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অংকের টাকা আদায় করা হতো।

তৎকালীন বহুল প্রচারিত একটি প্রগতিশীল পত্রিকার এক হিন্দু সাংবাদিক এবং গুরুত্বপূর্ণ অফিসের এক হিন্দু পিয়ন ছিল- এলাকার নিরীহ হিন্দুদের নিকট মূর্তিমান আতঙ্ক। ছুতানাতা পেলে আর কথা নেই, অশুভ শক্তি ব‍্যবহার করে অভিনব সব পন্থায় তারা নিরীহ হিন্দুদের একেবারে ভিটেমাটি ছাড়া করে ছাড়তো।

ঐ হিন্দু সাংবাদিক, তার আপন ভাগনির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। সেই সাংবাদিক ছিল অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। গ্রামের এক পুরোহিত তার স্কুলের পড়ার খরচ যোগান দিয়েছে। সাংবাদিক স্কুল ফাইনালে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, সেই শহরের এক কাপড়ের দোকানের কর্মচারী- জনৈক চক্রবর্তী বাবুর দয়ায় সে শহরে থেকে কলেজে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে।

সেই হিন্দু সাংবাদিক, যে দু'জন ব্যক্তির অনুগ্রহে লেখাপড়া শিখে রিপোর্টার হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছে, দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছে; সেই দুই ব্যক্তির ঋণ সে কীভাবে শোধ করেছে- সেই প্রসঙ্গে দু'-চার কথা না বললেই নয়। উপকারকারী সেই পুরোহিতের নাবালিকা নাতনি- যে কিনা সাংবাদিকের মেয়ের সমবয়সী; সেই মেয়েটিকে ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে, সেই হিন্দু সাংবাদিক মহোদয়, পুরোহিতের বিরুদ্ধে পত্রিকায় এমন এক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে- যার বিষয়বস্তু ছিল ― ঐ পুরোহিত ধর্ম ব্যবসার আড়ালে মাদক কারবার করছে, সে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর এজেন্ট, ভারতীয় চর হিসেবে রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সে যুক্ত...। শেষ পর্যন্ত সেই পুরোহিত বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি ফেলে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়।

অপর উপকারকারী চক্রবর্তী বাবুকে একদিন সাংবাদিক মহোদয় বলে, "আমার কিছু টাকা ইন্ডিয়ায় পাঠানো দরকার।"
চক্রবর্তী বাবু শুধু বলেছিল, "চিন্তা করিস না আমি ব্যবস্থা করে দেবখন।"

সাংবাদিক মহোদয় সেই কথা গোপনে টেপ করে জায়গা মতো পেশ করে এবং অভিযোগ দায়ের করে যে, চক্রবর্তী বাবু একজন হুন্ডি কারবারি। চক্রবর্তী বাবু গ্রেফতার হয়ে যান। কথা আদায়ের জন্য এই বৃদ্ধ লোকটির উপর এমন অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে, বাকি জীবন চক্রবর্তী বাবুকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে, তার কথা জড়িয়ে যেত, ডান হাত দিয়ে ভাত তুলে খেতে পর্যন্ত তার কষ্ট হতো।

চক্রবর্তী বাবু, ছোট ভাইদের মানুষ করতে গিয়ে সারাজীবনে বিয়েথা করতে পারেনি। চক্রবর্তী বাবুর ছোট ভাইয়েরা যে যার পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে এমন মানুষ রয়েছে- তারা দোকান কর্মচারী বড় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সঙ্গত ও সম্মানজনক মনে করে নি।

কৃত্তিবাস ওঝা
১৮/০১/২০২১খ্রিঃ

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted