হারিয়ে যায় ভিটেমাটি, হারিয়ে যায় হৃদয় :
------------------------------------------------
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, তার লেখা বাংলাদেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ডর ৪৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘মহাত্মা গান্ধী ও তাহার উত্তরাধিকারীদের অদ্ভুত অসঙ্গত ও অস্বাভাবিক মুসলমান প্রীতি যে ভারতের বিশেষতঃ বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাবের কি গুরুতর অনিষ্ট সাধন করিয়াছে —একদিন ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা তাহার বিচার করিবে।'
পাঠক, আশাকরি বলে দিতে হবেনা যে, একথা তিনি লিখেছেন ভারতভাগ ও তার ফলস্বরূপ বাস্তুহারা বা উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষদের ভোগান্তির পরিপ্রেক্ষিতে । অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু, ধর্মীয় নির্যাতনের ফলে জন্মভূমি ত্যাগ করতে শুরু করে ১৯৪৬ থেকে । সুদীর্ঘ এত বছর পরে আজও চলছে তাদের ভিটে ছাড়ার পালা। কী এর কারণ? কেন আমার দাদু, দিদা, ঠাকুমাকে চলে আসতে হয়েছিল ভিটেমাটি ত্যাগ করে ? লিখছি তার অন্তরকথা পর্যায়ক্রমে :
পাঠক, আশাকরি বলে দিতে হবেনা যে, একথা তিনি লিখেছেন ভারতভাগ ও তার ফলস্বরূপ বাস্তুহারা বা উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষদের ভোগান্তির পরিপ্রেক্ষিতে । অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু, ধর্মীয় নির্যাতনের ফলে জন্মভূমি ত্যাগ করতে শুরু করে ১৯৪৬ থেকে । সুদীর্ঘ এত বছর পরে আজও চলছে তাদের ভিটে ছাড়ার পালা। কী এর কারণ? কেন আমার দাদু, দিদা, ঠাকুমাকে চলে আসতে হয়েছিল ভিটেমাটি ত্যাগ করে ? লিখছি তার অন্তরকথা পর্যায়ক্রমে :
মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের মত একটি ভাওঁতার হিড়িক তুলে ভারত ভাগ দাবি করেছিল, কিন্তু ভাওঁতাটার উৎস কোথেকে ? এই ভাওঁতা হলো ইসলামের মৌলিক তত্ত্ব। ইসলাম অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীর মানুষ দু'ভাগে বিভক্ত : বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী আর এরই নাম দ্বিজাতিতত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে মুসলমানরা ইসলামে চিহ্নিত অপবিত্র পৌত্তলিক হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে না। এটাই প্রধান কারণ, যার জন্যই ভারত ভাগ হয়েছে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু-বৌদ্ধরা দলে দলে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে । ১৯৪৬-৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান নামক তথাকথিত পবিত্র ভূমিতে এবং অধুনা ইসলামী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিধর্মীদের উপর নিপীড়ন ও অত্যাচার হয়েই চলেছে, কখনও তীব্র আবার কখনও বা মডারেট ভাবে । এর স্বপক্ষে বহুবার বহু লেখায় তথ্য দিয়েছি, তথ্যগুলো আমার মনগড়া নয়, প্রকাশিত ও ব্যক্ত তথ্য । ১৯৫০ এ কুলাঙ্গার বাঙালি মুসলমানদের তাণ্ডবে পূর্ব পাকিস্তান রক্তাক্ত হয়েছিল, চলেছিল পরিকল্পিত একতরফা সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু নিধনযজ্ঞ । পাঠক, এই মারণ খেলার কারণ কি ? কারণ এই সংখ্যালঘু হিন্দু,পৌত্তলিক অথচ পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গের এই সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু নিজেদের শ্রমে ও অর্থে, বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে, শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে বাংলাকে 'সােনার বাংলা' করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল । ভারত স্বাধীন করার জন্য এরা আত্মত্যাগ করেছিল, কিন্তু ভারতভাগের পরে এই সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত পবিত্র ভূমিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়েছিল । যাদের আত্মত্যাগে ভারত স্বাধীন হয়েছিল সেই সর্বত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও তৃতীয় শ্রেণির কয়েদী হতে হয়েছিল । যারা এদের বন্দী করেছিল সেইসব কুলাঙ্গার বাঙালি মুসলমানের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান ছিল না । বন্দীদের অপরাধ, এরা হিন্দু, পৌত্তলিক !
জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক শাখার বিধান অনুসারে উদ্বাস্তু জনগণকে তাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে হবে। অনিচ্ছুক কোন উদ্বাস্তুকে তার জন্মভূমিতে ফেরত পাঠানাে যাবে না। দেশভাগের সময় থেকেই স্বাধীন ভারতের কুলাঙ্গার রাজনৈতিক নেতা ব্যাক্তিরা এ সব তথ্য অন্ধকার কুঠুরীতে বন্ধ রেখে নানাপ্রকার নাগরিকত্ব বিল এনেছে একের পর এক সর্বস্বহারা এই বাস্তুহারা মানুষগুলোর ভারতে ঢোকা বন্ধ করতে অথচ আজকের দিনে অসমের 'এন আর সি' ছানবীন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অসমে ব্যাপক সংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গের মুসলমান অনুপ্রবেশকারী রয়ে গেছে যারা অধিকাংশই বাংলাভাষী । কি বুঝলেন পাঠক ? অবাক পৃথিবী আমাদের আরও আরও অবাক করে চলেছে প্রতিদিন । আমার দাদু, দিদা, ঠাকুমাকে হিন্দু হওয়ার অপরাধে চরম নিপীড়ণের আতঙ্কে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এপার বাংলায় পাড়ি জমাতে হয়েছিল । পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গের মৌলবাদী কুলাঙ্গার মুসলমানের একতরফা সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে এরকম অগুনতি মানুষ, কেবলমাত্র দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কিছু আবশ্যিক সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে, জলের দরে ভিটেমাটি, বাড়িঘর বেচে এপার বাংলায় পালিয়ে এসেছিল শুধু একটা আশা আঁকড়ে ধরে : তারা প্রাণে বাঁচবে, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পাবে । এপারে পা রাখার সাথে সাথেই এই সর্বস্ব খোয়ানো মানুষগুলো বুঝতে পারলো এই দেশের কর্তাব্যক্তি, নেতাদের বেশিরভাগের কাছেই তারা
অবাঞ্চিত । এই রাজনৈতিক কুলাঙ্গারগুলো চায়না তারা এদেশে এসে বাঁচুক, বেশ কিছু ক্ষেত্রে এবাংলার আমজনতার অনেকেই সেদিন এই উদ্বাস্তু মানুষগুলোর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ।
পাঠক, সেদিন এই মানুষগুলোর কেবল বাস্তু হারায়নি, হৃদয়ও হারিয়েছিল........................
রেফ : বাংলাদেশের ইতিহাস- রমেশ চন্দ্র মজুমদার ।
প্রসঙ্গ অনুপ্রবেশ- অমলেন্দু দে।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................