১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চুকনগর গণহত্যাকে পরিস্কার ’হিন্দু হলোকাস্ট’ না বলে উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম হত্যাকান্ডগুলো অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে নতুবা সাধারণ গণহত্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
‘হিন্দু’ পরিচয়ে একটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহৃ করে দেয়ার চেষ্টাকে স্রেফ ‘বাঙালী গণহত্যা’ বলে চালানো যায় কি? একটা জাতি অন্যটা সম্প্রদায় ইস্যু। বাঙালি একটা জাতি যেখানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই থাকতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুধু বাঙালী মারতে এসেছিলো বললে তখন সেটার যে অর্থে দাঁড়ায় সেটা কি হিন্দু নিধন করতে আসছে বললে একই অর্থ দাঁড়ায়? পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে কলেমা পড়িয়ে মুসলিম কিনা নিশ্চিত করত। অনেক হিন্দু সেসময় বাঁচার জন্য কলেমা মুখস্ত করেছিলো মুসলিম প্রমাণের জন্য। এতবড় একটি অনুসঙ্গ থাকার পরও বাংলাদেশের ’মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিও’ তাদের ইতিহাসে কেন হিন্দুদের উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদী নিধনের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নয়? বছরখানেক আগে আমি যখন লিখলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে “হিন্দু হলোকাস্ট” হয়েছিলো তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকজন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলো! আমাকে বিজেপি আরএসএস ইত্যাদি বলে গালাগালি করছিলো। তাদের সাবেক বড় ভাই পশ্চিম পাকিস্তান যেভাবে তাদেরকে এক সময় ভারতের দালাল বলে খিস্তি করত তারাও অবিকল বিরুদ্ধ মতবাদীদের ভারতের দালাল বলা শুরু করেছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গণহত্যার জন্য যে ক্যাটাগরিগুলোকে বেছে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্ত ব্যক্তিবর্গরা সেখানে স্পষ্ট করে একটি ক্যাটাগরি ছিলো ‘হিন্দু’। পাকিস্তান অখন্ড রাখতে হলে এদেশে একটিও হিন্দুকে বেঁচে থাকতে দেয়া হবে না। এরকম একটি যুদ্ধ যে সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো সেটাকে ‘হিন্দুহলোকাস্ট’ বলা যাবে না কেন?
‘হিন্দু’ পরিচয়ে একটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহৃ করে দেয়ার চেষ্টাকে স্রেফ ‘বাঙালী গণহত্যা’ বলে চালানো যায় কি? একটা জাতি অন্যটা সম্প্রদায় ইস্যু। বাঙালি একটা জাতি যেখানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই থাকতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুধু বাঙালী মারতে এসেছিলো বললে তখন সেটার যে অর্থে দাঁড়ায় সেটা কি হিন্দু নিধন করতে আসছে বললে একই অর্থ দাঁড়ায়? পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে কলেমা পড়িয়ে মুসলিম কিনা নিশ্চিত করত। অনেক হিন্দু সেসময় বাঁচার জন্য কলেমা মুখস্ত করেছিলো মুসলিম প্রমাণের জন্য। এতবড় একটি অনুসঙ্গ থাকার পরও বাংলাদেশের ’মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিও’ তাদের ইতিহাসে কেন হিন্দুদের উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদী নিধনের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নয়? বছরখানেক আগে আমি যখন লিখলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে “হিন্দু হলোকাস্ট” হয়েছিলো তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকজন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলো! আমাকে বিজেপি আরএসএস ইত্যাদি বলে গালাগালি করছিলো। তাদের সাবেক বড় ভাই পশ্চিম পাকিস্তান যেভাবে তাদেরকে এক সময় ভারতের দালাল বলে খিস্তি করত তারাও অবিকল বিরুদ্ধ মতবাদীদের ভারতের দালাল বলা শুরু করেছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গণহত্যার জন্য যে ক্যাটাগরিগুলোকে বেছে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্ত ব্যক্তিবর্গরা সেখানে স্পষ্ট করে একটি ক্যাটাগরি ছিলো ‘হিন্দু’। পাকিস্তান অখন্ড রাখতে হলে এদেশে একটিও হিন্দুকে বেঁচে থাকতে দেয়া হবে না। এরকম একটি যুদ্ধ যে সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো সেটাকে ‘হিন্দুহলোকাস্ট’ বলা যাবে না কেন?
চুকনগর এমন একটি গণহত্যা যেখানে একদিনে দশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো যাদের ৯৯ ভাগই ছিলো হিন্দু এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটা সচেতনভাবে জেনেই অপারেশ সাজিয়েছিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে একদিনে এত বেশি মানুষ হত্যার দ্বিতীয় কোন নজির নেই। এই দিনটি হতে পারে বিশ্ববাসীর জন্য ‘গণহত্যা দিবস’। কিন্তু রহস্যজনকভাবে চুকনগর হত্যাকান্ডের কথা ৯০ দশকের আগে কোন মুক্তিযুদ্ধের গবেষকেই জানতেন না! এই না জানানোর কারণ কি কেঁচো খুড়তে সাপ বের হওয়ার ভয়। এখানে শুধুমাত্র হিন্দু জনগোষ্ঠির খোঁজে একটি দেশের সেনাবাহিনী অপারেশন চালিয়ে একদিনে দশ হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছিলো সেটা জানতে পারলে মুক্তিযুদ্ধে ‘হিন্দুহলোকাস্টের’ কথাটা স্বীকার করতে নিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো আসলে দ্বিজাতিতত্ত্বের দুটি গ্রুপের মধ্যে। এটা আমরা যতদিন মেনে নিতে পারব না ততদিন অনেক হিসেবেই মেলানো যাবে না।
খুলনা ছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হিন্দু অধ্যুষিত বিভাগ। দেশভাগের সময় খুলনা ভারতে চলে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু মুসলিম লীগের সবুর খান বলতে গেলে একাই খুলনাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিতে বাধ্য করেন। সবুর খানের এই অবদানের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে স্বীকার করা হয়েছে। এই সবুর খান ছিলো হিন্দুদের জন্য ত্রাস। ৭১-এ রীতিমত কসাইয়ের ভূমিকা নিয়েছিলো। মে মাসের দিকে খুলনার হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোভাব বুঝতে পেরে খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়ার আশায় ভারতে যাবার সবচেয়ে নিরাপদ রুট ডুমুরিয়ার চুকনগর আসতে শুরু করে। খবর পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখান অতর্কিত হামলা হালায়। লাশের চাপে ভদ্রা নদীর স্রোতরেখা আটকে যায়! হত্যাকান্ডের পর লাশ উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত ওয়াজেদ আলী সরদার ও শের আলী সরদার তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “চিত্তনন্দীর বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে পাট দিয়ে দড়ি বানিয়ে ও বাঁশের বাঁক তৈরী করে এলাকার ৩০ থেকে ৪০ জন লোক লাশ ফেলার কাজ আরম্ভ করি। আমাদের যতদূর মনে আছে, ৪ হাজারের মত লাশ গণনা হয়েছিল। তারপর আর লাশ গোনা হয়নি।”
মুনতাসির মামুন লিখিত “১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা” বইয়েও এই ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। সেখানে আরেক জায়গায় আলাদীপুর গ্রামের শিবপদ রায়ের ছেলে মুকুন্দ বিহারী রায়ের বক্তব্য উল্লেখ আছে। যেখানে বলা আছে, “এক জনের নাম আমি জানি তিনি এই জায়গার প্রাক্তন চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। গোলাম হোসেন বাঁইচা আছে কিনা এইডা আমি সঠিক জানিনে। তিনি খান সেনাদের নিকটতম লোক ছিলেন। এই গোলাম হোসেনরাই খান সেনাদের ঐ সাতক্ষীরা লাইনে থেকে যোগাযোগ করে নিয়ে আসে। আমাদের অর্থ সোনা-দানা যা আছে তা লুটতরাজ করে নেয়ার জন্য।”
এই হচ্ছে ইতিহাস! চুকনগর হতে পারত বিশ্ববাসীর কাছে চিরস্মরণীয় জেনোসাইডের একটি উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদী নিধনকে অস্বীকার বিকৃত করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। সারা পৃথিবী জানে হিটলার ইহুদীদের নিশ্চহৃ করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। আর বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিন্দুদের প্রতি সেই একই চেষ্টা করার পরও খোদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরাই সেটার বিরোধীতা করে! চুকনগরের কথা বিশ্ববাসী দূরের থাক বাংলাদেশের ইতিহাস সচেতন শিক্ষিত মানুষই জানে না! কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের গণহত্যা সেরকমই আরেকটি হিন্দু অধ্যুষিত গণহত্যার জায়গা যার কথাও কেউ জানে না। ঢাকার শাঁখারী পট্টিতে স্রেফ হিন্দু নিধনের উদ্দেশ্যে যে পৈশাচিক আক্রমন চালানো হয়েছিলো সেটাকেও বাংলাদেশের প্রগতিশীলরা সাধারণ গণহত্যা হিসেবেই দেখিয়েছে। অথচ ওটা হিন্দু প্রধান এলাকা। পাকিস্তানীরা সেই এলাকাকে বেছে নিয়েছিলো পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস কিংবা পুলিশ ব্যারাক আক্রমন যেমন ছিলো প্রতিরোধ যুদ্ধ যাতে সংঘঠিত হতে না পারে- তেমনি হিন্দুদের উপর আক্রমন ছিলো কার্যকারণ সমৃদ্ধ। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রেজ্যুলেশন ২৬০ এর ৩ অধিনে বলা হয়েছে, গণহত্যা হচ্ছে এমন একটা কর্মকান্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিকে সম্পূর্ণ বা আশংশিকভাবে নিশ্চিহৃ করে দেয়ার চেষ্টা। তাহলে বলুন, ৭১-এ ”হিন্দু হলোকাস্ট’ বলা হলে আপনি এত তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন কেন?
#সুষুপ্ত_পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................