প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামিক আগ্রসন এবং ভারতীয় রাজাদের সফল প্রতিরোধ।

প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামিক আগ্রসন এবং ভারতীয় রাজাদের সফল প্রতিরোধ
================================================
সিন্ধু নদের তীরে অন্তিম রনাঙ্গনে
========================
একদিকে আরব সেনাপতি ইমাদউদ্দিন মহম্মদ বিন কাশিম সদলবলে ঝড়ের গতিতে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং জয়ী হলেন একাধিক ছোটখাটো যুদ্ধেও। কিন্তু রাজা দাহিরের সাথে তখনও তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। অবশেষে রাজা দাহির ব্রাহ্মণাবাদ বা তৎকালীন আলোর থেকে রাওয়ারে এসে হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁর পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সিন্ধি সেনা।

রাজধানী আলোর অবরোধ হলো। একমাস দুর্গ অবরোধ চলে কিন্তু আত্মসমর্পনের লক্ষণ দেখা যায় না। বিন কাসেম ফিরে যাবেন কিনা ভাবছেন এই সময়েই মূল ঘটনাটি ঘটে। ভারতবর্ষের মাটিতে সবচেয়ে ভালো ফলে দেশদ্রোহের ফসল। এক বৌদ্ধ সামন্ত গিয়ে হাজির হন শত্রুশিবিরে। যেহেতু দাহিরের পূর্বজ চাচ বৌদ্ধ রাজাদের সরিয়ে একজন বৈদিক হিসেবে রাজা হন তাই রাজা দাহিরের সিংহাসনে থাকার অধিকার নেই। সামন্ত গিয়ে আরবদের বলেন রাজা দাহির আলোতে নেই রাখতে রয়েছেন।
অনতিবিলম্বে আরবরাও সেখানে এসে উপস্থিত হল। দুপক্ষই প্রস্তুত কিন্তু আগ বাড়িয়ে কোন পক্ষই আক্রমণ করতে অগ্রসর হল না।

রণভূমিতে রাজা দাহির তাঁর বাহিনীর পদাতিক সেনাদের প্রথম সারির মধ্যভাগে রাখলেন। তাঁদের দুই পাশে মোতায়েন করা হলো তীরন্দাজ বাহিনীকে। এরপর পেছনের দ্বিতীয় সারির মধ্যভাগে নিজ নিজ অশ্বারোহী বাহিনী সমেত মোতায়েন রইলেন সিন্ধু প্রদেশের দুই প্রধান সেনাপতি। তাঁদের দুই পাশে নিজ নিজ রণহস্তী বাহিনী সমেত মোতায়েন রইলেন রাজা দাহির নিজে স্বয়ং আর তাঁর রণহস্তী বাহিনীর আরেক সেনাপতি। অপরদিকে উমেদ খলিফা বাহিনীতে রণহস্তীর অস্তিত্ব ছিল না। খলিফা সিপাহি সালহার মহম্মদ বিন কাশিম তার বাহিনীর প্রথম সারিতে মোতায়েন করলেন পদাতিক সেনাদের। পদাতিক সেনাদের দুই পাশে মোতায়েন করা হলো তীরন্দাজ আর হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী। তাদের পেছনে দ্বিতীয় সারিতে নিজ নিজ ভারি অশ্বারোহী বাহিনী সমেত মোতায়েন রইলেন সিপাহি সালহার মহম্মদ বিন কাশিম আর অনান্য খলিফা সেনাপতিরা।

একসময় খলিফা বাহিনীর ঘোষক তার বাম হস্তে ধরা চাঁদ তাঁরা আর কল্মা অঙ্কিত খলিফা বাহিনীর ইসলামিক ধ্বজ শূন্যে উত্থোলিত করে ভৈরব কণ্ঠে “আল্লাহ আকবর” রবে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা করলেন। সাথে সাথে সিন্ধু বাহিনীর ঘোষকরাও তাঁদের রাজকীয় ধ্বজ শূন্যে উত্থোলিত করে শঙ্খ আর কাঁসর ধ্বনি ও “হর হর মহাদেব” রবে পাল্টা যুদ্ধের ঘোষণা করলেন। এরপর দুই পক্ষের বাহিনী উল্কারবেগে ধেয়ে এলো একে অপরের দিকে। শুরু হলো এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বহিরাগত যবন খলিফা বাহিনীর নিকট এটি ছিল তাদের পবিত্র ধর্মযুদ্ধ তথা ইসলামিক জিহাদ। অপরদিকে সিন্ধু বাহিনীর নিকট এই যুদ্ধ ছিল বিজাতীয় ম্লেচ্ছ বাহিনীকে রুখে দিয়ে নিজ মাতৃভূমির স্বতন্ত্রতা আর কয়েক হাজার বছর প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা ও সংস্কৃতির রক্ষা করা। পিছু হটতে রাজি নয় কেউই। দুপক্ষেরই সমান জেদ। কার সামরিক শক্তি অধিক তা অনুমান করা অসম্ভব। ঝনঝন বাজতে লাগলো তরবারি, শনশন বেগে বাতাস কেটে ছুটতে লাগলো অসংখ্য শূল আর বাণ, ঝকমক করে জ্বলতে লাগলো সহস্র বিদ্যুৎ শিখা। তরবারি ও বর্শায় ঠোকাঠুকির শব্দ, যোদ্ধাদের ভৈরব গর্জন, মত্ত হস্তীদের বৃংহণধ্বনি, অশ্বদের হেস্রারব আর আহত সেনানীর আর্তনাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল সিন্ধু নদের তীর। দেখতে দেখতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দ্বিপ্রহর শেষ হয়ে বিকেলের আগমন ঘটলো। যুদ্ধের পরিণাম যখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত তখনই ঘটে গেল একটি অঘটন।

মাকরানের যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও আরব বাহিনীর তীরন্দাজরা জ্বলন্ত তুলো জড়ানো তীর নিক্ষেপ করছিল। মাকরানের যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রাজা দাহিরের সেনাবাহিনী এবারেও খলিফা বাহিনীর সেই একই ফাঁদে পা দিল। এবারেও আচমকা একটি অগ্নিবাণ এসে লাগল রাজা দাহিরের হাতির গায়ে। তীরের শাণিত ফলার সাথে সাথে জ্বলন্ত অগ্নি হলকার বিষম স্পর্শ পেয়ে হাতি দাহিরকে নিয়ে উন্মত্তের মত পাশের সিন্ধু নদের অভ্যন্তরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। স্বয়ং মহারাজের সেই দশা দেখে তাঁর নেতৃত্বাধীন সিন্ধী বাহিনী যুদ্ধ স্তগিত রেখে সমরভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করা শুরু করলো। কিন্তু এহেন বিপরীত পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র দমলেন না বীরবড় মহারাজ দাহির। অভিজ্ঞ মাহুতের সাহায্যে প্রথমে তিনি তাঁর আহত হাতিকে শান্ত করালেন। তারপর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের সেনানায়ক সম্রাট হেমুর ন্যায় তিনি ফের রনাঙ্গনে প্রত্যাবর্তন করে তাঁর পলায়নরত সেনাদের একত্রিত করে পুনরায় সিংহ বিক্রমে ভিনদেশি স্মেচ্ছ আরবী শত্রুদের সংহার শুরু করলেন। ক্রমে বিকেল গড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো সন্ধ্যাকাল। এবারে সিন্ধু রাজ্যের উন্মত্ত রণহস্তী বাহিনীর দাপটে প্রবল আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে প্রায় ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম হলো খলিফা বাহিনীর। এক সময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত খলিফা সেনাপতি কাশিম তার বাহিনীকে পশ্চাৎপশরনের আদেশ দিলেন। পলায়নরত খলিফা বাহিনীকে দেখে উল্লসিত সিন্ধু বাহিনী আর রাজা দাহির মূর্খের মতো সেই চিরাচরিত মহাভুল করে বসলেন যা পরবর্তীকালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে করে ভারতবর্ষকে বিদেশি লুণ্ঠক তুর্কি বাহিনীর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিছিলেন আজমির নরেশ রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান।

রাজা দাহিরের নির্দেশে সিন্ধু বাহিনী তাঁদের যাবতীয় রণব্যূহ পরিত্যাগ করে তরবারি আর ভল্ল উঁচিয়ে “হর হর মহাদেব” রবে পিছু ধাওয়া করলেন চম্পটরত খলিফা বাহিনীর। কিন্তু প্রাচীন সনাতনী রণনীতিতে অভ্যস্ত রাজা দাহির বিন্দুমাত্র পরিচিত ছিলেন না মধ্যপ্রাচ্যের চতুর বিজাতীয় খলিফা বাহিনীর ছল-কপটতা পূর্ণ রণনীতির সাথে। যদি সিন্ধু প্রদেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি সম্মুখ সমরে বিজয় লাভ করতে ব্যর্থ হয় খলিফা বাহিনী তাহলে মহম্মদ বিন কাশিমের দ্বিতীয় রণকৌশল অনুসারে তিনি আগে থেকেই কিছুদূরে রণভূমির দুই পাশে লুকিয়ে রেখেছিলেন খলিফা বাহিনীর অন্তর্গত ভারি অশ্বারোহী বাহিনীর আরও দুটি বিভাগকে। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের চতুর রণকৌশল থেকে সম্পূর্ণ রূপে বিচ্যুত সিন্ধু বাহিনী মূর্খের মতো কাশিমের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হলেন ঠিক সেই স্থানে যেখানে তাঁদের উপর হামলার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল খলিফা বাহিনীর লুকনো অশ্বারোহী বাহিনী। সিন্ধু বাহিনী অকুস্থলে উপস্থিত হতেই আচমকা তাঁদের দুই পাশ থেকে “আল্লাহ আকবর” শ্লোগান দিতে দিতে তরবারি, ভল্ল আর অগ্নিবাণ সমেত ঝাঁপিয়ে পড়লো ওই দুই লুকনো অশ্বারোহী বাহিনী।

এই আচমকা আর অপ্রত্যাশিত হানাদারির জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সিন্ধু বাহিনী। যুদ্ধে তাঁদের পক্ষে নিহতের সংখ্যা দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। তবুও রণহস্তী বাহিনীর সাহায্যে ঘুরে দাঁড়ানোর এক অন্তিম প্রয়াস করলেন রাজা দাহির। কিন্তু তাঁকে কোনোরকম সুযোগ দিতে নারাজ মহম্মদ বিন কাশিম এবারে তার বাহিনীর সমেত উল্কাবেগে ধেয়ে এসে সিন্ধু বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের কচুকাটা করতে লাগলেন। একসময় খলিফা তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত পরপর কয়েকটি তীর এসে বিদ্ধ হলো সিন্ধী কেশরী দাহীরের শরীরে। শরাঘাতে হস্তী পৃষ্ঠ থেকে ভূমিতলে ঠিকরে পড়ে প্রবল যন্ত্রণায় অর্ধ অবচেতন অবস্থায় অসহায়ভাবে কাতরাতে লাগলেন রাজা দাহির। সেই সময় ভূপাতিত দাহিরের নিকটে বক্র অসি হস্তে এগিয়ে এলেন মহম্মদ বিন কাশিম। বিভিন্ন লোকগাথা অনুসারে সেই সময় মৃত্যুপথ যাত্রী তৃষ্ণার্ত রাজা দাহির কাশিমের নিকটে জলপানের কাতর আকুতি জানালেন। প্রত্যুত্তরে কাশিম ক্রূর হাসি হেসে “আল্লাহ আকবর” ধ্বনি সহকারে তার বক্র শামসিরের এক ঘায়ে নির্মমভাবে ছেদন করলেন রাজা দাহিরের মস্তক।

রাজা দাহিরের মৃত্যুর সাথে সাথেই যবনিকাপাত ঘটলো যুদ্ধের। এরপর আত্মসমর্পণকারী সিন্দু প্রদেশের অবশিষ্ট কাফের সেনাদের নির্মমভাবে গণহত্যা করলো বিজয়ী খলিফা বাহিনী। সিন্ধু প্রদেশের আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে উঠল আরবদের পাশবিক জয়ল্লাসে। রাজা দাহিরের মৃত্যুর সাথে সাথেই আরব বাহিনীর পদতলে পতন হল সিন্ধের। হতভাগ্য রাজা দাহির বরণ করে নিলেন বীরের মৃত্যু এবং ঐতিহাসিকগত ভাবে বহু শতাব্দী প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার ধারক ও বাহক সিন্ধু প্রদেশের ঐতিহাসিক ভূমিতে সেদিনই সর্বপ্রথম কায়েমি হয়ে অর্ধ-চন্দ্রাঙ্কিত ইসলামি ধ্বজ।

রানি লাদিদেবীর জহরব্রত পালন ও যুদ্ধ পরবর্তী সিন্ধু প্রদেশের দুর্দশা
================================================
একসময় দূত মারফৎ সিন্ধুদেশের রাজধানিতে সেই চরম দুঃসংবাদ এসে পৌঁছল রাজা দাহিরের প্রধান মহারানি লাদিদেবীর নিকট। নিজের পতির মৃত্যু আর স্মেচ্ছ আরবদের বিজয়ের সংবাদ শুনে শোকস্তব্ধ রানি লাদিদেবী প্রথমে বিষপান করে আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু দূত তাঁকে জানালেন যে স্মেচ্ছ আগ্রাসনকারীরা এতটাই বর্বর যে রাজপ্রাসাদ অধিকার করবার পর তাঁরা রানি লাদিদেবীর মরদেহকেও অসম্মানিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবে না। তখন রানি লাদিদেবী সিদ্ধান্ত নিলেন বিধর্মী স্মেচ্ছরা তাঁদের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করবার পূর্বেই অগ্নিদেবের পবিত্র স্পর্শে নিজের সম্পূর্ণ শরীরটাই ভস্মীভূত করে ফেলবার। এরপর তিনি তাঁর সখীদের নিয়ে ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম জহরব্রত পালন করে আরব শত্রুদের কবল থেকে নিজেদের সম্ভ্রম আর মর্যাদা রক্ষা করলেন। রানি লাদিদেবী জহর পালন করতে সফল হলেও দুর্ভাগ্যের গ্রাসে পড়লেন প্রয়াত রাজা দাহিরের দুই কন্যা সূর্য দেবী আর প্রেমালা দেবী। জহর পালন করার বা পলায়নের সুযোগ না পেয়ে স্মেচ্ছ সেনাপতি মহম্মদ কাশিমের হাতে বন্দি হলেন তাঁরা।

এরপর সিন্ধের অবশিষ্ট বাহিনী আরবদের প্রতিহত করে বামনাবাদকে রক্ষা করবার অন্তিম প্রয়াসে ফের আরেকবার বামনাবাদ নগরীর বাইরের যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তাঁরা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করেও ব্যর্থ হলেন আগ্রাসী আরব সেনা স্রোতকে প্রতিহত করতে। সেই যুদ্ধে আত্মবলিদান দিলেন প্রায় ছাব্বিশ হাজার সিন্ধী সেনা। আরবদের হাতে এবারে পতন হল বামনাবাদের। রাজধানি নগর অধিকার করেই শুরু হল অবাধ লুণ্ঠন আর গণহত্যা। এরপর আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সিন্ধু দেশের হিন্দুরা। রাজা দাহিরের মৃত্যু এবং সিন্ধের পতনের পর আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন খলিফা বাহিনীর সেনাপতি মহম্মদ বিন কাশিম। এরপর সাবেক সিন্ধু প্রদেশের বহু অংশে হানাদারি চালিয়ে সেসব অঞ্চলের স্থানীয় হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভারতীয়দের উপর চড়া হারে জিজিয়া কর চালু করলেন। যেসব প্রজারা স্বইচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন তাদের উপর থেকে চড়া হারের জিজিয়া কর প্রত্যাহার করে স্বল্প হারের জাকাত কর চালু করা হলো আর তাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাও করা হলো। কিন্তু সিন্ধু প্রদেশের যেসব সিংহভাগ প্রজারা ইসলাম কবুল করলেন না তাঁদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য কাশিমের আদেশে খলিফা সেনারা বিভিন্ন সনাতনী হিন্দু ও জৈন মন্দিরে প্রবেশ করে নিষিদ্ধ গোমাংস আর গোরক্ত ছড়িয়ে প্রথমে কাফেরদের সেইসব উপাসনালয় গুলি অপবিত্র করে পরে সেগুলি গুঁড়িয়ে বেশ কিছু মসজিদ নির্মাণ করলেন। এরপর প্রচুর স্থানীয় অধিবাসীদের কণ্ঠদেশে তরবারি স্পর্শ করে তাঁদের বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হলো। অল্প কিছুকালের মধ্যেই সম্পূর্ণ সিন্ধু প্রদেশকে খলিফা বাহিনীর পদানত করে এবারে কাশিম পত্র মারফৎ হিন্দের অবশিষ্ট রাজাদের নিকট সরাসরি নির্দেশ প্রেরণ করলেন হয় আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহন করে মহামান্য খলিফার অধিনস্ত সামন্ত রাজা হয়ে নিজ নিজ রাজ্য শাসন করো, অন্যথায় ইসলামের তরবারির সম্মুখীন হও। নবাগত খলিফা বাহিনীর ভয়াবহ ধর্মীয় জিহাদের সম্মুখীন হয়ে প্রাথমিক ভাবে সিন্ধু আর মুলতান সহ উত্তর আর পশ্চিম ভারতের বেশ কিছু ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য নিরুপায় হয়ে ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হলেও একসময় খলিফা বাহিনীর আদেশ পালন করতে সরাসরি অস্বীকার করলেন কোনৌজ, কাশ্মীর আর প্রতিহার সাম্রাজ্য।

মহম্মদ বিন কাশিমের মৃত্যু রহস্য
=========================
অপরদিকে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধের যুদ্ধের পর আরও প্রায় বছর তিনেক ভারতবর্ষে ছিলেন কাশিম। ৭১৪ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিম পর্বে মৃত্যু হলো কাশিমের মূল পৃষ্ঠপোষক তথা ইরাকের প্রাদেশিক সামন্ত খলিফা আল হাজাজের। এরপর ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যু হলো আরবের মূল উমেদ খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদ ইবান আল মালিকের। এই দুজনের প্রয়াণের সাথে সাথে সৌভাগ্যের দিন শেষ হয়ে দুর্ভাগ্যের দিন ঘনিয়ে এলো কাশিমের জীবনে। প্রথম আল ওয়ালিদের মৃত্যুর পর সপ্তম উমেদ খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হলেন তার ভাই সুলেমান ইবান আবিদ আল মালিক। এনার শাসনকালেই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানি কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেও খ্রিষ্টান সেনাদের অভিনব গ্রীক ফায়ারের তাপে দগ্ধ হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করতে বাধ্য হয় মাসলামার নেতৃত্বাধীন খলিফা বাহিনী। আরবী ঐতিহাসিক আল বালাদুরির লেখনী অনুসারে নতুন খলিফা হয়েই তার কট্টর শত্রু ইরাকের প্রাদেশিক খলিফা আল হাজাজের যাবতীয় বিশ্বস্ত সেনাপতি ও পরামর্শদাতাদের হত্যা করতে শুরু করেন নতুন খলিফা সুলেমান। এক সময় মহম্মদ বিন কাশিমকেও তিনি ভারত থেকে ইরাকে ডেকে পাঠান। ইরাকের ভূমিতে পদার্পণ করতেই খলিফার আদেশ অনুসারে কাশিমকে বন্দি করে হত্যা করেন খলিফা বাহিনীর জল্লাদরা।

অপরদিকে চাঁচনামা গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে নতুন উমেদ খলিফাকে খুশি করে তার প্রিয় পাত্র হবার লোভে চতুর কাশিম তার হারেমে বন্দি শহীদ সিন্ধি নরেশ রাজা দাহিরের দুই রূপবতী রাজকন্যা সূর্য দেবী আর প্রেমালা দেবীকে উপঢৌকন হিসেবে খলিফার দরবারে পেশ করার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব শুনে খুশি হয়ে কাশিমকে নিজ দরবারে ডেকে পাঠান খলিফা। কিন্তু খলিফার দরবারে উপস্থিত হবার পর নিজেদের পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য দুই বন্দি রাজকুমারী ষড়যন্ত্র করে কাশিমের দ্বারা তাঁদের দেহ উপভোগের অভিযোগ পেশ করলেন খলিফার নিকটে। এই অভিযোগ শুনে খলিফা যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন মহম্মদ বিন কাশিমকে।

কাশিম পরবর্তী ভারতীয় যোদ্ধাদের প্রতিরোধ পর্বের সূচনা
=========================================
৭১৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধে মহম্মদ বিন কাশিমের মৃত্যুর পর ইয়াজিদ ইবান আবি কাবসা আল সাসাকি সিন্ধু প্রদেশের পরবর্তী শাসক হিসেবে নির্বাচিত হলেন। সেই সময় মাসলামা ইবান আবিদ আল মালিকের নেতৃত্বে খলিফা বাহিনীর সিংহভাগ অংশ ব্যাস্ত হয়ে পড়লো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানি কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করতে। আগের পোস্টেই জেনেছেন প্রায় ৩ বছর ধরে চলেছিল কনস্টান্টিনোপলের সেই মহাযুদ্ধ। এই সময়ে ভারতবর্ষের ভূমিতে বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লো খলিফা বাহিনী। সেই সুযোগ নিয়ে ইয়াজিদ ইবান আবিকে পরাজিত করে সিন্ধু প্রদেশের রাজধানি বামনাবাদ সাময়িকভাবে মুক্ত করতে সফল হলেন শহীদ রাজা দাহির শাহের এক সন্তান হুলি শাহ। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই প্রবল খলিফা বাহিনীর আগ্রাসনের সম্মুখে ভীত ও সন্ত্রস্ত্র হয়ে কাপুরুষের ন্যায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে খলিফা সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি। এদিকে বাইজেন্টাইন বাহিনীর বিরুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবার পর ফের একবার উমেদ খলিফার শ্যেন দৃষ্টি এসে পড়লো অবশিষ্ট ভারতবর্ষের উপর। কিন্তু এবারে রাজা দাহিরের মতো কোন মামুলি ভারতীয় শাসক নন, বিজাতীয় ম্লেচ্ছ খলিফা বাহিনীকে কড়া টক্কর দেবার জন্য রণভূমিতে এগিয়ে এলেন কোনৌজ সম্রাট যশবর্মণ, কাশ্মীর সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তাপিড়, মেবারের সেনাপতি বাপ্পাদিত্য রাওয়াল, শাকম্ভরী চৌহান রাজবংশের সামন্ত শাসক প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান, প্রতিহার সম্রাট প্রথম নাগভট্টের মতো উত্তর আর মধ্যভারতের শক্তিশালী মহান রণনায়কগণ আর চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য, রাষ্ট্রকূট সম্রাট দান্তিদুর্গ ও নবসারির সামন্ত শাসক অবনীজনাশ্রয় পুলোকেশির মতো দাক্ষিণাত্যের মহান ও শক্তিধর ভারতীয় রণপণ্ডিতরা।
(পরবর্তী পর্বে ভারতীয় সম্রাটদের পাল্টা প্রত্যাঘাতের সম্মুখে ভারতবর্ষের ভূমিতে কোমর ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়লো আরবের খলিফা জিহাদি বাহিনী)

দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্কঃ

তথ্যসূত্র: ১) An Advanced History of India, Part II by R. C. Majumdar, H.C. Roychandra and Kalikinkar Ditta
২) Tareekh-Sind, by Mavlana Syed Abu Zafar Nadvi
৩) The Early Islamic Conquests by Donner, Fred
৪) Ancient India (Eighth ed.) by R. C. Majumdar
৫) Indian Studies No. I: Slow Progress of Islam Power in Ancient India by D. R. Bhandarkar
৬) History and Culture of Indian People by R. C. Majumdar
৭) Ancient history of Saurashtra: being a study of the Maitrakas of Valabhi V to VIII centuries A. D. by Virji, Krishnakumari Jethabhai

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted