বাংলাদেশ যে চির অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ এটা বলার প্রতিযোগীতা চলছে।

Stay Conneted

আমি ভাবি ঋতিক ঘটক পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য রাস্তায় রাস্তায় পয়সা তুলেছিলেন কেন? তার কি দেশ ত্যাগের জন্য এতটুকু রাগ ক্ষোভ ছিলো না পূর্ববঙ্গের মানুষদের উপর?

আহমদ ছফার একটা উপন্যাস আছে ‘অলাতচক্র’। সেখানে আছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া তরুণরা যারা বিভিন্ন মেসে থাকত, কলতলায় স্নান করতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে স্থানীয়রা বলত, পূর্ব পাকিস্তান থেকে কিভাবে তার বাবা মা পালিয়ে এসেছিলো। কিভাবে ঠাকুরদাকে মুসলমান চেয়ারম্যান কুপিয়ে মেরেছিলো। কত বড় বাড়ি মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে। উপন্যাসের নায়ক দানিয়েলের এসব শুনতে খুব লজ্জ্বা করত।


সত্য হচ্ছে, পূর্ববঙ্গ ছেড়ে যাদেরকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো সেইসব মানুষদের পূর্ববঙ্গের জন্মভূমির প্রতি সীমাহীন টান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু হারাতে হয়েছে টানটা তাই বেশি। কিন্তু এখানে পূর্ববঙ্গে যে মুসলিম জাতীয়তাবাদ তারা দেখে গেছে তার প্রতি স্বাভাবিক উষ্মা থাকবে না? পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭১ সালের দূর্গা পুজার থিম হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমান বহু পুজা মন্ডবে। সেখানে অসুর হয়েছিলো ইয়াহিয়া খান। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে গোপালগঞ্জে হিন্দু মহাসভার ছেলেদের সঙ্গে রক্তারক্তি মারামারি হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের মুসলিম লীগের ছেলেদের সঙ্গে। ৮০ ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত গোপালগঞ্জ থেকে হিন্দুদের দেশত্যাগের পর মাত্র ২৩ বছরের মধ্যেই মুজিবের প্রতিকৃতি তৈরি করে দুর্গাপুজা করা অভাবনীয় বৈকি। যদি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা, প্রফেসর রাজ্জাক, আবুল ফজলদের কথা ভাবি, যদি তাদেরকে ঋতিক ঘটকের মত দেশ ছাড়তে হত হিন্দুত্ববাদী চেতনার কাছে পরাজিত হয়ে তারা কি তখন এভাবে অর্থ তুলতে রাস্তায় নামতে পারতেন সেই হিন্দুত্ববাদীদের জন্য যারা একদিন তাদেরকে দেশছাড়া করতে বাধ্য করেছিলো?

আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পোস্টের নিচে কোলকাতার শিক্ষিত বাম সেক্যুলার প্রগতিশীলদের কমেন্টগুলো দেখছিলাম। তারা বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর বিবরণকে বলছে এগুলো লেখা হচ্ছে বিজেপিকে সুবিধা করে দেয়ার জন্য! আজকে প্রথমা প্রকাশনীতে দেখতে পেলাম নতুন বই বের হয়েছে, ‘কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান’ নামের একটি বই। লেখকের নাম মিলন দত্ত। এরকম বহু বই ভারতের লেখকরা সেথানকার সংখ্যালঘুদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে লিখেন। লেখক মিলন দত্ত সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। কিন্তু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে তার স্বজনদের কেউ না কেউ বাংলাদেশ ফেরত। বাংলাদেশের হিন্দুদের দেশত্যাগ, নির্যাতন, বৈষম্য নিয়ে কোলকাতার কেউ লেখে না পাছে তাকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ এরকম অপবাদ দিয়ে ফেলে। অথবা সেই বই বিজেপিকে সুবিধা করে দেয়। অথবা কেউ সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ খাতা থেকে তার নামটা কেটে দেয়! জনপ্রিয়দের ভয় হচ্ছে এসব লিখলে বাংলাদেশের পাঠকরা তাদেরকে বয়কট করতে পারে। তখন বই বিক্রি কমে যাবে। এ কারণেই সুনীল সমরেশ শীর্ষেন্দু কেউ বাংলাদেশের মুসলিম জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখেননি। বলেননি এখানে যারা প্রগতিশীল বলে পরিচিত তারা সকলেই মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তারা সকলেই ‘বাঙালী মুসলমান লেখক কবি সাহিত্যিক’। কিন্তু প্রবলভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদ নিয়ে চিন্তিত!

নির্মেলেন্দু গুণ, রামেন্দু মজুমদার, পিযূষ বন্দোপাধ্যায় ইনারাও দেশপ্রেমিক অসাম্প্রদায়িক হিন্দু বাংলাদেশী হওয়ায় এদেশে ঘটে যাওয়া হিন্দু জেনোসাইড নিয়ে টু শব্দটি করেন না। উল্টো বাংলাদেশ যে চির অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ এটা বলার প্রতিযোগীতা করেন। আমির খান থেকে সাইফ আলী খান- ভারতের জনপ্রিয় সুপার স্টাররা ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বিজেপির রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেন। ভারতকে যে বিজেপি হিন্দুত্ববাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট করে বলেন। কিন্তু বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় চঞ্চল চৌধুরী একটি ঘটনাতেও প্রতিবাদ করেছেন? তিনি কি বলেছেন মুসলিম জাতীয়তাবাদের আস্ফলনে অমুসলিম সম্প্রদায় বাংলাদেশে অস্তিত্বহীন অনুভব করছে? বলেনি। বলে না বলেই এখানে কয়েক ধরণের সাম্প্রদায়িক জাস্টিফাই তৈরি হতে পেরেছে। যেমন বামপন্থিদের তরফ থেকে: বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মুসলমান কাজেই নির্যাতিত হিসেবে হিন্দুরা নয় মুসলমানরাই বেশি হয়। প্রগতিশীলদের তরফ থেকে: বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাংলাদেশে যে ঘটে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এগুলো ঘটলে ওপারে বিজেপির সুবিধা হয়। কাজেই বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক ঘটনার পিছনে ভারতের বিজেপির হাত রয়েছে...।

আমি অনেক বছর থেকেই বলেছি, পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম অঞ্চল থেকে অমুসলিম তাড়ানোর কোন ইতিহাস যেমন নেই সেটা বাংলাদেশেও থাকবে না। কেন থাকবে না সেটাই উপরে আলোচনা করলাম। এখানে কৌশলগুলো ইউনিক। যেমন চুকনগর হত্যাকান্ডের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বড় ম্যাসাকার। একদম ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারার মত সেখানে হিন্দুদের মেরে নদীতে ফেলা হয়েছিলো। লাশের চাপে নদীর স্রোত পর্যন্ত থমকে গিয়েছিলো। সেখানে স্রেফ হিন্দুদেরই হত্যা করা হয়েছিলো। সংখ্যাটা হাজারের ঘরে। তবু এটাকে কেউ হিন্দু ম্যাসাকার বললে সে বিজেপির দালাল! সাম্প্রদায়িকতা উশকে দেয়া চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে...!

#সুষুপ্ত_পাঠক

Post a Comment

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................