বন্যা আহমেদ, কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় মোহিত রায় যে সম্পাদকীয় লিখেছেন তা শতভাগ সঠিক। এতটাই সঠিক যে এগুলোর কোনটাই এড়ানো যায় না বলে যারা এই ইতিহাসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে আনে তাদেরকে ‘হিন্দুত্ববাদী’, বিজেপি আরএসএস এজেন্ট বলে গালি দেয়া ছাড়া ভিন্ন উপায় থাকে না। যদিও আফসান চৌধুরী এই বিষয়ে লিখেছেন। নির্মম সত্য তুলে ধরে আলাদা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘হিন্দু জেনোসাইড’ হিসেবে আলাদা একটা চ্যাপ্টার যে দাবী রাখে সেটি পরিস্কার করেছেন। কিন্তু আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের হাতে ‘হিন্দু হলোকাস্ট’ হয়েছিলো বললাম ওমনি ‘দাস পার্টি খোঁজে’ বইয়ের লেখক হাসান মুর্শেদ আমাকে বিজেপির এজেন্ট, হিন্দুত্ববাদী বলতে আর কিছু বাকী রাখেনি। বন্যা আহমেদ লিখেছেন, “আনন্দবাজারের এই সম্পাদকীয় (অপ-এড?) পড়ে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পিছনে যেন একমাত্র বা প্রধাণ কারণ ছিল 'হিন্দু-নিধন'! হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল ইহুদি-নিধনের জন্য বলার মত লাগলো অনেকটা যেন”!
কী আশ্চর্য দেখুন! মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এদেশে যে হিটলাবের মতই ইহুদী বিদ্বেষের হুবহু অনুকরণে হিন্দু নিধন ঘটেছিলো সেটাকে মনে হচ্ছে অবিশ্বাস্য! বন্যা একই পোস্টে এটাও লিখেছেন, “'৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী ডিস্প্রোপরশানেটভাবে বা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশই নেই”। তাহলে হিটলের ইহুদী নিধনের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা বাড়িয়ে বলা হবে কেন? আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পড়ে কোনভাবেই মনে হওয়ার কথা নয় “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পিছনে যেন একমাত্র বা প্রধাণ কারণ ছিল হিন্দু-নিধন”। কিন্তু পাকিস্তানীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করত, হিন্দুরা পাকিস্তানের জন্য হুকমি স্বরূপ। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা বাঙালী সংস্কৃতির দিকে ফের ঝুঁকে পড়ছে হিন্দুদের ষড়যন্ত্রে। কারণ ছায়ানট, উদীচীর মত শিল্প সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পিছনে হিন্দুদের হাত দেখে তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, যে দ্বিজাতিত্ত্ব আদর্শে বাঙালী মুসলমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বড় অবদান রেখেছিলো সেখান থেকে তারা হিন্দুদের পাল্লায় পড়ে সরে আসছে। তাই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে হলে হিন্দুদের এদেশ থেকে তাড়াতে হবে। বন্যা আহমেদ ইতিহাস ঘেটে দেখুন, দেশভাগের সময় এদেশে মুসলমানরা নোয়াখালীতে হিন্দু জেনোসাইড ঘটিয়েছিলো কিনা? সেটার দায় কিন্তু পাঞ্জাবীদের নয়, বাঙালী মুসলমানের। কারণ তাদের দল মুসলিম লীগ এই জেনোসাইড ঘটায়। শিক্ষিত জ্ঞানী ধনী সংস্কৃতিবাণ হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করে চলে যাবার পর যে ১৫ শতাংশ দরিদ্র তথাকথিত নিন্মবর্ণের হিন্দুরা থেকে গিয়েছিলো তাদের উপর ১৯৫০, ৬৪, ৬৫ সালে স্রেফ ‘হিন্দু হলোকাস্ট’ চালানো হয়েছিলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এগুলো কখনই আলোচিত হয় নাই। এদেশের সুবিধাভোগী হিন্দুরাও নিজেদের হালুয়া রুটির ভাগ ঠিক রাখতে কখনো এগুলোর চর্চা করেনি। ফলে আজকে যখন কেউ বলছে, বাংলাদেশে 'হিন্দু জেনোসাইড' হয়েছিলো তখন সেটাকে হিন্দুদেরই রাজনৈতিক প্রোপাগন্ডা মনে হচ্ছে! বাঙালী মুসলমান নিজের হাতের রক্ত ধুয়ে মুছে সাফ করতে নোয়াখালী হিন্দু জেনোসাইড প্রায় ভুলিয়ে রাখতে চায়। পাকিস্তান আমলের হিন্দু জেনোসাইডগুলোও সতর্ককতার সঙ্গে ‘বাঙালী গণহত্যা’ বলতে চায়। কেন?
এই বিষয় নিয়ে আমি একাধিক লেখা লিখেছি, সেখানে যাবতীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি কেন আলাদা করে বলতে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘হিন্দু হলোকাস্ট’ ঘটেছিলো। আগ্রহীদের জন্য কমেন্ট বক্সে সেই লেখাগুলোর লিংক থাকবে। কিন্তু বারবার কেন ইতিহাসের সত্যগুলোকে এড়ানোর চেষ্টা হয়? বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর পূর্তি করার আগে দেশপ্রেমিকদের জানা উচিত এদেশের জন্ম দিতে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছে। তাদের ৯৫ শতাংশ জনগোষ্ঠি শরণার্থী হয়েছিলো। বিপরীতে ৭ কোটি জনগোষ্ঠির মুসলিমদের মাত্র ৬ লাখ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। কলেমা পড়তে জানলে, মুসলমানিত্ব প্রমাণ ও পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় ঈমান থাকলে তাদের বিপদ ছিলো না। কিন্তু হিন্দু হলে তাদের কোন ছাড় নেই। অবরুদ্ধ ঢাকায় কয়টি হিন্দু ফ্যামিলি ছিলো? একটিও পাওয়া যাবে না। চুকনগর গণহত্যায় হাজারখানেক হিন্দু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো স্রেফ তারা হিন্দু ছিলো বলে। এটি অন্য কোন দেশ হলে এই ঘটনা নিয়ে সিনেমা তৈরি হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী নিধন ও তাদের উপর চালানো অমানবিক ঘটনাগুলো নিয়ে বিশ্বখ্যাত সব সিনেমা তৈরি হয়েছে। আর এখানে ভারতে একটি সম্পাদকীয় লেখা হলে আমরা সন্দেহ করি এসব লিখে কি বিজেপিকে সুবিধা করে দেয়ার চক্রান্ত করা হচ্ছে নাকি? হিন্দু নির্যাতন নিয়ে এখন তো যেই লিখছে তাদেরকে বিজেপির আইটি সেলের ভাড়ায় খাটা লোক বলা হচ্ছে। কোন অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক নাকি এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে সুবিধা করে দিবে না। দেশের কোমলমতি মুসলমানদের নাজুক ঈমান দ্বন্ডেও আঘাত করাটা নাকি নরেন্দ্র মোদীর এজেন্টদের কাজ। তাই মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরাও দিনদুপুরে বিজেপির ভূত দেখে চিত্কার করে উঠে। পাকিস্তানীরা যে ভূত দেখে পূর্ব পাকিস্তানকে কোনদিন বিশ্বাস করতে পারেনি, সেই একই অসুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকজন আজ আক্রান্ত! কি করে যেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ফিরে ফিরে আসে। রক্তের ভেতর শিরায় শিরায় দ্বিজাতিতত্ত্ব।
#সুষুপ্ত_পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................