“ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার প্রথম সংগ্রাম”
ইসলামিক জিহাদ ও সিন্ধু রাজ দাহির---
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
মুহাম্মদ –বিন –কাসিম সিন্ধুর দ্বার প্রান্তে এসে পৌছায় ৭১২ সালের প্রথম দিকে। স্থল পথে কিছু সৈণ্য আসে। বেশী আসে নৌপথে। বর্তমান ‘করাচী’ র কিছু দূরে সাগরে নৌবহর ঘাটি গাড়ে। করাচীর তৎকালীন নাম ছিলো “দেবল”। এখানে রাজা দাহিরের একটি দুর্গ ছিলো। সেই দুর্গের যে বিবরন পাওয়া যায় সেই অনুসারে এর চারিদিকের দেয়াল ছিলো প্রায় ৪০ গজ (১২০ ফুট) উচু এবং প্রায় সমান উচু বিরাট একটি গম্বুজ। দুর্গের মাঝে ছিলো একটি হিন্দু মন্দির এবং বৌদ্ধ বিহার। সেই বৌদ্ধ বিহারে থাকতেন বেশ কিছু ‘শ্রমন’।
সেই সময়ে সিন্ধু দেশে চার ধরনের জাতির মানুষ বাস করতো। জাঠ এবং ‘মেডস’। এরা শারীরিক দিক দিয়ে ছিলো খুব শক্ত পোক্ত, কিন্তু শিক্ষা দীক্ষা বিশেষ ছিলো না। আর ছিলো আদিবাসী রা। এই ছাড়া রাজপুত এবং ব্রাহ্মন জাতি। দাহিরের এক জন প্রসাশক এই দুর্গের দ্বায়িত্বে ছিলেন এবং দুর্গ রক্ষার জন্য প্রায় ৬০০০ রাজপুত এবং ৪০০০ হাজার ব্রাহ্মন সৈন্য ছিলো। আগের দুই বারের বিফল ‘রিজিয়া’ তে আরবী দের কাছে এই সব খবর ছিলো। কাসিম উৎকোচ দিয়ে জাঠ এবং মেডস দের কিনে নিলো এবং নিজ সৈন্যদের মধ্যে নিলো ভাড়াটে সৈন্য (mercenary) হিসাবে এবং গুপ্তচর বৃত্তির জন্য। উপজাতিদের কাছে দাহির বা যে কোনো রাজাই একই রকম ছিলো। কে এলো আর কে গেলো এ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না। সামান্য কিছু মদ্য পানীয়ের বিনিময়ে তারা কাসিমের সাকরেদ বনে গেলো। দুর্গ রক্ষার দ্বায়িত্ব এসে পড়লো রাজপুত এবং ব্রাহ্মনদের ওপরে।
কাসিম দুর্গ ঘিরে রাখলো প্রায় ৩ মাস। মাকরানের আরবী প্রশাসক মুহাম্মদ হারুনের দেওয়া ৫ টি পাথর ছোড়ার বিশাল গুলতি (catapult) দিয়ে বিশাল বিশাল পাথর খন্ড ছুড়েও দুর্গের দেওয়ালে সামান্য রকম ক্ষতি করতে পারলো না। ঠিক সেই সময়, কাসিম বৌদ্ধ শ্রমনদের সংগে যোগা যোগ করলো গুপ্তচর দিয়ে। তাদের বলা হলো তারা যদি দুর্গে ঢোকার গুপ্ত দরজা খুলে দেয় তাহলে কাসিম তাদের কোনো রকম ক্ষতি করবে না। ‘অহিংসার পুজারী’ বৌদ্ধ শ্রমন রা ঠিক সেই দুঃষ্কর্ম টা খুব ভালো ভাবেই করলো। রাতের অন্ধকারে, কাসিমের আরবী সৈন্য রা ঢুকে পড়লো দুর্গের মধ্যে। তার পর যা ঘটলো সেটা কোনো সভ্য জগতে ঘটে না। ঘুমন্ত সৈন্য রা কোনোক্রমে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছু করা বা বোঝার আগেই সব শেষ। রক্তের হোলী খেলায়, মহিলাদের ওপরে অত্যাচারের আনন্দে টগবগিয়ে উঠলো আরবী সৈন্য রা। হিন্দু রক্তে ধৌত হলো দেবল দুর্গ এবং মন্দির।
কাসিম খুব খারাপ মানুষ ছিলো না। সে দুর্গ বাসীদের “ইসলাম” কবুল করার সুযোগ দিয়েছিলো। যারা কবুল করলো তারা বেচে গেলো, যারা করলো না তাদের পুরুষ গুলোকে কচু কাটা করা হলো আর মহিলাদের যৌন দাসী বানানো হলো। (Legacy Of Jihad, edited by Andrew G Bostom and published in New York, written by historian K S Lal).
দেবল দুর্গ দখল করে কাসিম ‘নরুন’ (বর্তমান পাকিস্তানের হায়দ্রবাদ) দখল করে। নরুনে দেবলের মর্মুন্তুদ কাহিনী এর মধ্যেই পৌছে গিয়েছিলো। সেই বিভীষিকার হাত থেকে বাঁচার জন্য নরুনের লোকেরা দলে দলে ‘ইসলাম’ কবুল করে নিজেদের জান মাল রক্ষা করলো। (সাম্প্রতিক ইরাকের মসুল শহরের কথা মনে করুন। জীবন বাচানোর জন্য মসুলে একদিনে ১৫ হাজার খ্রীষ্টান ইসলাম গ্রহন করেছে, আই সি আই সি র হাত থেকে বাঁচার জন্য (সেই পুরানো জিহাদী কৌশল)। নরুনের বিখ্যাত “বুধ” মন্দির মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো এবং সে সেখানে তৈরী হলো এক মসজিদ। ইমাম ও নিয়োগ করা হলো। কাসিমের পরবর্তি শিকার হলো ‘সীওয়ান”। এখানে বেশীর ভাগ বৌদ্ধ রা বাস করতো। তারা অহিংসার বুলি আঊড়ে হিংসার হাত থেকে বাচার জন্য মুসলিম হলো। বেঁচে গেলো।
দাহিরের রাজধানী ছিলো ৫০০ মাইল উত্তরে ‘আলোর’ নামে জায়গায়। এই খবর তার কাছে পৌছালে দাহির এক বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে কাসিমের মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসেন। ‘রাওয়ার’এর সমতলে দাহির আর কাসিমের সৈন্য বাহিনী সামনা সামনি দাড়ালো। মুসলিম লেখক,আল বিরাদুরী’ যিনি কাসিমের সংগে ভারতে এসেছিলেন, লিখছেন, “ যে যুদ্ধ শুরু হলো, তেমন ভয়ংকর যুদ্ধ স্মরন কালের মধ্যে কেউ দেখে নি।
‘চাচনামা’ (যার একটি বাংলা কপি আমার কাছে আছে) নামে একখানি বই লেখা হয়েছে, সিন্ধুর ‘রাই বংশ’ এর রাজত্ব শেষে ‘চাচ বংশ’ (রাজা দাহিরের বংশ) রাজত্ব করার থেকে আরবীরা দখল নেওয়া অবধি। লিখেছেন, কাজী ইসমাইল, যাকে কাসিম, কাজী হিসাবে নিয়োগ করেছিলো ‘আলোর’ এ সিন্ধু জয়ের পর। বই টার আর এক নাম “ফতে নামা (জয়) সিন্ধ”। এর পারসী ভাষায় অনুবাদ করেছেন ‘মোহম্মদ আলি বিন হামিদ বিন আবু বকর ‘কুফী’ । এই ‘চাচ নামা’ এই ভয়ংকর যুদ্ধের হুবহু বর্ননা দিয়েছে। চাচনামা বলছে, “ রাজা দাহির তার সাদা হাতীর পিঠে চড়ে এমন ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করলেন যে কাসিমের আরবী সৈন্য ছত্র ভংগ হতে শুরু করলো। চারিদিকের ধুলোতে বিকেলেই রাত হবার জোগাড় হলো। আরবী দের রক্তে মাটি সোঁদা গন্ধ ছাড়তে শুরু করলো। হিন্দু রাজপুত এবং ব্রাহ্মন রা এমন যুদ্ধ করতে পারে সেই কথা আরবী যুদ্ধ বাজ দের জানা ছিলো না”।
কিন্তু, হিন্দুদের সুর্য্য অস্তাচলে যাবার সময় এসে গিয়েছিলো। কাসিম আগেই দাহিরের সভাসদ ‘আলতাফী’ আরবী দের সংগে গোপন চুক্তি করেই রেখেছিলো। “আলতাফী’গোষ্টির নেতা তার কিছু সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসে। কিন্তু, মীরজাফরের মতো চুপ চাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। রাজা দাহির সব বুঝেও সেই মুহুর্তে কিছু করতে পারেন নি। বিকেলে, যখন আরবী সৈন্য রা পলায়ন মুখী হয়ে পড়ে ঠিক সেই সময় কাসিমের নির্দেশে “আলতাফী’ সৈন্যদের মধ্যে একজন, যে দাহিরের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো, সে ‘Nafta’ (গালা) মাখানো একটি তীর দাহিরের হাওদায় ছুড়ে দেয়। দাহিরের হাওদায় আগুন লেগে যায়। রাজা দাহির তখন মাটিতে দাঁড়িয়ে তার শেষ রক্ত বিন্দু অবধি মাতৃ ভুমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে প্রান বিসর্জন দেন।
হাজার বছরের সনাতনি হিন্দু সমাজ চলে গেলো এক ভীন দেশী অপসংষ্কৃতির দখলে, যার থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর কোনো উপায় আছে কি না তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................