বিদ্যাসাগর বিধাব বিবাহ আইন পাশ করার পর কুলিন ব্রাহ্মণদের বহু বিবাহ বাতিল করতে সরকারের আছে আর্জি পেশ করলেন। এক একজন ঘাটের মরা ব্রাহ্মণ ১০০০টি পর্যন্ত বিয়ে করেছে এমন তথ্য বিদ্যাসাগর সংগ্রহ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় এই বামুদের বিবাহ বাণিজ্য নিয়ে লিখেছিলেন ‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসটি। সে যাই হোক, বিদ্যাসাগর বামুদের বহু বিবাহ তথা হিন্দু বহু বিবাহ বন্ধ করতে যখন দৌড়ঝাঁপ করছেন তখন বঙ্কিমচন্দ্র কাগজে কলাম লিখলেন এই বিষয়ে। তিনি লিখেছিলেন, যে আজকাল হিন্দুদের বহু বিবাহ উঠে যাচ্ছে, শিক্ষাদীক্ষা যখন বেড়ে যাবে তখন আপনাআপনি এসব সমাজ থেকে দূর হয়ে যাবে...। তারপরই তিনি অস্বস্তিকর একটা বিষয় তুলে ধরলেন এভাবে-
“...একটি কথা এই যে, এ দেশে অর্দ্ধেক হিন্দু, অর্দ্ধেক মুসলমান। যদি বহুবিবাহ নিবারণ জন্য আইন হওয়া উচিত হয় তবে হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্বন্ধেই সে আইন হওয়া উচিত। হিন্দুর পক্ষে বহুবিবাহ মন্দ, মুসলমানের পক্ষে ভাল এত নহে। কিন্তু বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া, মুসলমানের পক্ষেও তাহা কি প্রকারে দন্ডবিধি দ্বারা নিষিদ্ধ হইবে? (বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড)।
ঘটনা হচ্ছে বিদ্যাসাগর শাস্ত্র থেকেই দেখাচ্ছিলেন বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু মুসলমানদের শাস্ত্রে সেটাই স্পষ্ট করে বৈধ করা আছে। তাহলে বহুবিবাহ আইন করে হিন্দুদের ঠেকানো হবে কিন্তু একই দেশে মুসলমান দিব্যি বহু বিবাহ করবে আইন তাকে ছুবে না এ কেমন কথা? বঙ্কিম যে প্রশ্ন তুলেছেন তাতে যুক্তি যে আছে বোধসম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারছেন। কিন্তু এরকম বিতর্ক পালে হাওয়া পেলে হিন্দু বহুবিবাহের জালে পড়ে হাজার হাজার হিন্দু মেয়ে বাল্য বিবাহের শৃঙ্খলে শতাব্দী থেকে শতাব্দী যে নিপীড়িত হচ্ছিল সেটি জিইয়ে যায়। বিদ্যাসাগরের মত বিচক্ষণ মানুষ বাঙালীদের মধ্যে আগেও যেমন জন্মায়নি ভবিষ্যতেও তার সমতুল্য কেউ জন্মাবে বলে মনে হয় না। তিনি জানতেন বহুবিবাহের আগুনে মুসলিম নারীরাও জ্বলেপুড়ে মরছে। কিন্তু সে জায়গায় হাত দেয়ার মত সময় ও পরিস্থিতি তার নেই। এখানে হাত দিতে হবে মুসলিম সমাজে জন্ম নেয়া কেউ। সেযুগে বিদ্যাসাগর মুসলিমদের শাস্ত্রসম্মত এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে মুসলিম জমিদাররা গুন্ডা ভাড়া করে তাঁকে মেরেই ফেলতেন। বিদ্যাসাগর জানতেন তিনি যে যুগসন্ধিকালে জন্মেছেন সেকালে তাকে তার মত করেই এগুতে হবে।
তারপর তিন চারশো বছর কেটে গেছে মুসলমান সমাজে তেমন কেউ জন্মায়নি। কোন মুসলমানই মনে করে না তার শাস্ত্র জনজীবনকে নিপীড়িত করছে। বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেছে এমন কোন মুসলিম দেশের কথা জানা নেই। কারণ ওটা কুরআন দ্বারা সিদ্ধ। বিদ্যাসাগর কাজ করেছেন হিন্দু সমাজ নিয়ে। শরৎচন্দ্র উপন্যাস লিখেছেন লম্পট বিয়ে বাণিজ্য করা বামুনদের নিয়ে। হিন্দু সমাজের জাতপাত নিয়ে রবীন্দ্রনাখ লিখেছেন “গোড়া”। বিপরীতে কেউ মুসলমানদের নিয়ে লিখলেও বলে আপনি খালি মুসলমানদের নিয়ে লিখেন কেন? হিন্দুদের নিয়ে আপনার লেখা নেই? এবার একটু হিন্দু ধর্ম নিয়ে লিখুন। আপনি কি নাস্তিক নাকি ইসলাম বিদ্বেষী?...
যদি আপনি বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকান, সেখানে মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা লেখকরা কি তাদের সমাজ ও শাস্ত্র নিপীড়ন নিয়ে লিখেছেন? উল্টো তারা গর্বে গদগদ হয়ে লিখেছেন মুসলমান সুফিদের চাকরবাকর নিয়ে একসঙ্গে নামাজ পড়া দেখে কি করে নিন্মবর্ণের হিন্দুরা ইসলামে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়েছিলো। তাহলেই বুঝেন, পরিবর্তন হবে কিভাবে? আমি আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর চাবুক চাবকে জাগাতে চাইছি তখন কেউ বলছে ভারসাম্য রেখে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করুন! বঙ্কিমের কথা শুনলে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ বিল সমানে আনতে পারতেন না। “হিন্দুরাও খুব খারাপ” বলে মুসলমান সমাজের সংস্কারের কথা কেন লিখতে হবে বলুন তো? কার জন্য? কার কাছে নিরপেক্ষ সাজতে হবে?
-সুষুপ্ত পাঠক
#সুষুপ্তপাঠক
#SusuptoPathok
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................