দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ: আপনি হিন্দু-মুসলমান ইউনিটি বিশ্বাস করেন?

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ: আপনি হিন্দু-মুসলমান ইউনিটি বিশ্বাস করেন?

শরচৎচন্দ্রর চট্টপাধ্যায়: না।

দেশবন্ধু: (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) কিন্তু এ ছাড়া আর কি উপায় আছে বলতে পারেন? এরিমধ্যে তারা সংখ্যায় পঞ্চাশ লক্ষ বেড়ে গেছে। আর দশ বছর পর কি হবে বলুন তো?… 

আজকাল ভাবি, বখতিয়ার খিলজিসহ আফগান তুর্কিরা ভারতবর্ষে এসে লুটপাট করে চলে গেলেও পারত। এখানে তাদের ইসলাম ধর্ম মিশনারী যদি না হত তাহলে কি এই অঞ্চল এতখানি অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক হত? একখা যখনই বলি ওমনি অভিয়োগ উঠে আমার উপর, আমি সব কিছুর জন্য শুধু মুসলমানদের দোষ দেই। তাদেরকে বলি, হিন্দু আর বৌদ্ধরা সেই প্রচীনকালে ধর্মযুদ্ধ বাধিয়েছিলো, আজ কি ইতিহাসের সেই উত্তরাধিকার এই দুই সম্প্রদায় বহন করে চলছে? শ্রীলংকা, নেপাল, ভূটান ভারত তাদের মধ্যে ধর্মগত কোন ঘৃণা অবিশ্বাস কি জিইয়ে আছে? সোজা কথা আফগানিস্থানে কামান দাগিয়ে বুদ্ধ মূর্তি ভাঙ্গায় কোন জাপানিজ চাইনিজ থাই সিংগাপুরী কি জঙ্গি হবার স্বপ্ন দেখেছে? তাহলে মানছেন মুসলিম একটি সতন্ত্র জাতি বিশ্বাসের মিথস্ক্রিয়া?

ভারতবর্ষে “হিন্দু মুসলমান ঐক্য” দেশভাগের বহুকাল আগে থেকে হাজার লক্ষবার আলাপ হয়েছে। আপনি দেখান তো “মুসলিম বৌদ্ধ ঐক্য” কোথায় আছে? “মুসলিম খিস্টান ঐক্য” “মুসলিম ইহুদী ঐক্য” এগুলো কোথায় আছে? ভারতে ইহুদীদের একটি অংশ সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করে আসছে যাদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন প্যালেস্টাইনের অধিবাসী। মুসলিম শাসনের সময় তারা ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। এরকম ইহুদী বসতি কি বাংলাদেশ পাকিস্তান মালদ্বীপে কল্পনা করা সম্ভব? পাকিস্তানের জঙ্গিরা তাজ হোটেলে আক্রমনের পর ইহুদী পাড়ায় হামলা চালিয়েছিলো মনে আছে নিশ্চয়? কেন এই হামলা? কারা তাদের ধর্মীয় বইয়ের গাল গল্পকে ইতিহাস মনে করে তার জেরে শত্রুতা জিইয়ে রাখে?

চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন এই ভারতবর্ষের অন্যতম সেক্যুলার নেতা যিনি হিন্দু মুসলমানকে এক করতে তার রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা ব্যয় করেছিলেন। ভারতীয় মুসলমান তথা বাংলার মুসলমানদের তুরস্কের ইসলামী খিলাফতের খলিফাকে নিজেদের খলিফা দাবী করে আন্দোলন শুরু করা নিয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিলো না। তারা ইসলামী খিলাফত রক্ষা হলেই সন্তুষ্ঠ ছিলো। সেটা যখন হলো না তাদের আগ্রহও চলে গেলো। আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ল। মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা চায়নি আগ্রহও ছিলো না... (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ)।

পুরো ভারতের রাজনীতির নেতারা যখন মুসলিমদের নিজ দেশে এই পরবাসী মানসিকতা বুঝে গেলে ঠিক সেসময়ই দেশবন্ধু হিন্দু মুসলমান ঐক্য নিয়ে “বেঙ্গল প্যাক্ট” চুক্তি করতে এগিয়ে এলেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে কোন উত্সুক ছিলো না যতটা নিজেদের বিভিন্ন সুবিধা আদায় করতে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বেঙ্গল প্যাক্ট করতে তাদের আগ্রহ দেখে। কারণ এখানে রাজনীতি ও সরকারী চাকরিতে লোভনীয় কোঠা সুবিধার চুক্তির কথা বলা হয়। সেই মোতাবেক দেশবন্ধু যখন কোলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন তখন তার ডেপুটি করা হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। বেঙ্গল প্যাক্ট আদৌ হিন্দু মুসলমান ঐক্য নয় বরং বিবাদমান দুটি শত্রুর মাঝে শান্তি চুক্তি হচ্ছে বলেই মনে হয়। বস্তুত এরকম চুক্তি করে কখনোই ঐক্য করা সম্ভব নয়। বেঙ্গল প্যাক্টের চুক্তির এই ধারাগুলির দিকে একটু তাকান-

"মসজিদের সামনে বাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না। খাদ্যের জন্য গরু জবাই নিয়ে আইন সভায় কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। আইন সভার বাইরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। গরু জবাই করার সময় যাতে তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধর্মীয় কারণে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না”। 

এরকম ধর্মীয় সংঘাত রেষারেষি বন্ধ করার চুক্তি ভারতের আরো বিশ পঁচিশটি ধর্মের মধ্যে করতে হয়নি। এককালে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধ মন্দির ভেঙ্গেছে। কিন্তু সেই জের কি শতাব্দী থেকে শতাব্দী বয়ে আজতক এসে ঠেকেছে? সেন আর পাল রাজাদের নিয়ে এখন আর কোন বৌদ্ধ হিন্দু গর্ব করে? কিংবা সেই হিন্দু বা বৌদ্ধ শাসনকে সামনে এনে সেটাকে নিজেদের জাতির ইতিহাস ও নিজেকে রাজার জাত, সেই উত্তরাধিকার হিসেবে পুরো দেশটাকেই নিজেদের দাবী করা এক মুসলমান ছাড়া আর কে করে?

দেশবন্ধুর মত নেতা মুসলিমদের ৫০ লক্ষ সংথ্যা দেখে কি তিনি ভাবীকালের দেশভাগ দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছিলেন? রাজনৈতিক নেতারা নাকি অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পান। তাই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ঐক্য করতে। হয়নি। যে ধর্মটা নিজেই একটা জাতীয়তাবাদ প্রচার করে তার পক্ষে কি করে সহাবস্থান সম্ভব? তাহলে সমাধান কি?

খুব সহজ আবার কঠিন। মুসলমানদের মুসলিম জাতীয়তাবাদ ভুলতে হবে। এটি মুসলমানদেরই সূচনা করতে হবে। তাদেরকে নিজ নিজ জাতিসত্ত্বায় মিশে যেতে হবে। এটা করলে তাকে নামাজ রোজা হজ ছাড়তে হবে না। ইসলামকে কেবল আধ্যাত্বিক ধর্ম হিসেবে নিয়ে যার যার নিজ জাতি ও সংস্কৃতিকে বুকে লালন করতে হবে। এজন্যই এটি খুব সহজ ও কঠিন। কারণ দেখেন বাঙালীদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল দাবী করেন তারাই "বাঙালী মুসলমান স্বাতন্ত্র্য" একটা জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছে। এজন্য কাজটা কঠিন। অসম্ভব নয়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে মুসলমানদেরই।

-সুষুপ্ত পাঠক
#সুষুপ্তপাঠক 
#SusuptoPathok

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted