ফিরে দেখা।। ১৯৭১
একাত্তরের কুখ্যাত দালাল শর্ষিনার পীর আবু জাফর সালেহ
'বাঙ্গালী হিন্দু নারীরা পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের জন্য মালে গণিমত। সাচ্চা ঈমানদার পাকিস্তানী ভাইদের জন্য হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা জায়েজ।'
.
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় এমন ফতোয়া দিয়েছিলো শর্ষীনার পীর আবু জাফর সালেহ। স্বরূপকাঠির মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলো এই শর্ষীনার পীর আবু জাফর সালেহ। শর্ষীনা এখন ছারছিনা নামে পরিচিত বেশী।
.
মুক্তিযুদ্ধের সময় শর্ষীনা মাদ্রাসায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সেই মাদ্রাসায়। মুক্তিযুদ্ধের বহু গণহত্যার পরিকল্পনা হয়েছে শর্ষীনার পীরের অনুমতিতে।
.
শর্ষীনা মাদ্রাসার প্রায় ৫০০ ছাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ টির বেশী গ্রামে হামলা চালিয়েছিলো। কেবল নারীদের অপহরণ ই না, বাড়ি ঘর ও বাজার লুট করে কয়েক কোটি টাকার সোনা লুট করে শর্ষিনা পীরের হাতে তুলে দিয়েছিলো।
এছাড়া হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কয়েক হাজার নিরীহ সনাতন ধর্মাবলম্বীকে পীরের নির্দেশে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিলো সেই মাদ্রাসার ছাত্ররা।
.
মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাসের শেষদিকেও ১ হাজারের বেশী নারী ও শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করেছিলো হানাদারেরা। স্বরুপকাঠির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্র ইন্দরহাটের বড় বড় হিন্দু মহাজনরা ব্যবসা করত। পীরের নির্দেশে বাজারটি মাটিতে মিশে দেয়া হয়। যে পরিকল্পনা মূল হোতা ছিলো এই শর্ষিনা পীর।
.
শর্ষীনার পীরের ভয়াবহ নৃশংসতার কথা উঠে এসেছিলো ৭২ এর ৫ই জানুয়ারি তারিখের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল অষ্টম খন্ডে বীরাঙ্গনা ভারতী রানী বসু বর্ণনা করেছিলেন কি ভয়াবহ নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালিয়েছিলো সেই কুখ্যাত পীর ও পীরের বাহিনী।
.
অথচ এই ঘৃণ্য কৃতকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ শর্ষীনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোঃ সালেহকে ১৯৮০ সালে জনসেবায় প্রথমবার স্বাধীনতা পদক ও ও ১৯৮৫ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে কথিত অবদানের জন্য দ্বিতীয়বার তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। শুধু এটাই না, এই কুখ্যাত রাজাকারকে একুশে পদক ও দেয়া হয়েছিলো।
.
একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে শর্ষীনা পীরের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তির সমালোচনা করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তখন পত্রিকাতে একটি নিবন্ধ লিখেও পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সেই লেখা তখন কোন পত্রিকা প্রকাশ করেনি।
.
বীরাঙ্গনা ভারতী রানী বসুর সেই সাক্ষ্যটি তুলে দিলাম।
ভারতী রাণী বসু
গ্রাম – স্বরুপকাঠি
জেলা – বরিশাল
.
২৭শে এপ্রিল আমি কাঠালিয়া থানার মহিষকান্দি গ্রামে যাই আত্মরক্ষার জন্য। তখন চারদিকে সব বিচ্ছিন্ন অবস্থা। হিন্দু বাড়ি বিভিন্ন স্থানে লুট হচ্ছে, হত্যা চলছে। ওখানে পৌছানোর পরপরই স্থানীয় কিছু লোক হিন্দু বাড়ি লুট শুরু করে দেয়। ২০/২৫ জনের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সকালে, দুপুরে, রাতে, ভোরে যখন তখন বল্লম, দা এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি আক্রমণ করে সব লুট করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি স্বরুপকাঠিতে ফিরে আসি ৫ই মে। সেদিন ছিলো হাটবার। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা লুট করে নেয় দুষ্কৃতিকারীরা।
.
৬ই মে সকালে পাক সেনা প্রথম স্বরূপকাঠিতে যায়। ওখানকার পীর শর্ষিনার বাড়ীতে গিয়ে পাক বাহিনী ওঠে। ওখান থেকে থানায় আসার পথে শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত (সাহাপারা) সমগ্র হিন্দু বাড়ী প্রথমে লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে পাক বাহিনীর একটা দল অলঘারকাঠির দিকে গিয়ে ঘর বাড়ী জ্বালানো ও সেই সাথে মানুষ হত্যাও শুরু করে। আর একটা দল স্বরূপকাঠি এসে শুধু হিন্দু বাড়ী বেছে বেছে সকল হিন্দু বাড়ী লুট করে পুড়িয়ে দেয়। কালী প্রতিমার উপর অসংখ্য গুলি চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহুজনকে হত্যা করে। তারপর পাক বাহিনী ফিরে যায়। তারপর থেকে ক্রমাগত সাত দিন পাক বাহিনী স্বরূপকাঠিতে যায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে আর লুট করেছে। স্থানীয় কিছু লোক এবং পীরের দল পাক বাহিনীর সাথে থাকতো। লুট করতে বলে তারা যখন লুট করতে আরম্ভ করে তখন পাক সেনারা ছবি তুলতো।
.
কুড়িয়ানা আটঘর, জলাবাড়ী, সমুদয়কাঠি, জুলুহারা, নান্দিঘর, সোহাগদল, ইন্দ্রিরহাট, মণিনাল, বাটনাতলা ইত্যাদি গ্রামসহ ৯টি ইউনিয়নে পাক বাহিনীরা গ্রামের প্রতিটি কোনাতে ঘুরে সব ধ্বংস করেছে, লুট করেছে।
.
কুড়িয়ানা আটঘরে পিয়ারার বাগানে বহুজন আশ্রয় নিয়েছিল। পাক বাহিনী হঠাৎ করে ঘিরে ফেলে অসংখ্য লোককে হত্যা করে। এক মেয়েকে পিয়ারা বাগান থেকে ধরে এনে সবাই মিলে পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর তিনদিন যাবৎ ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। অশেষ যন্ত্রণা লাঞ্ছনা দেওয়ার পর মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটি ম্যাট্রিক পাশ ছিল। অন্য একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে অধিকাংশ লোককে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্য করে হত্যা করেছে। শত শত লোককে এই এলাকাতে হত্যা করেছে।
.
কাউখালি স্টেশনে আমি নিজে দেখেছি একজনকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে রাজাকাররা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। স্বরূপকাঠিতে টিকতে না পেরে মহিষকান্দিতে যাই। ওখানে গেলে আমাকে সবাই মুক্তিবাহিনীর চর মনে করলো এবং অস্ত্র আছে বললো। আমি ওখান থেকে রাতে পালিয়ে যাই রাজাপুরে।
.
রাজাপুর থানাতে হামিদ জমাদার সমগ্র থানাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে, হত্যা করেছে। হিন্দু কোন বাড়িঘর ছিল না। সব ধ্বংস করেছিল। ওখানে শুক্কুর মৃধা শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ছিল। আমি সহ আরো তিনজন তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন রকম সেবারের মতো বাঁচি। আমি তখন কুমারী ছিলাম। সবাইকে মুসলমান হতে হবে এবং মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে সুনীল কুমার দাস নামে এক ভদ্রলোককে আমি বিয়ে করি সে সময় দুষ্কৃতিকারীর হাত থেকে বাঁচবার জন্য। সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ অথবা জুলাই প্রথম।
.
রাজাপুরে আছি স্বামীসহ। ভোরবেলা রাজাকার, পুলিশ মিলে প্রায় ৩০/৪০ জন আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। স্বামীকে লুকিয়ে রাখি। ওরা এসে সব কিছু লুট করে গালাগালি করে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার এসে আর যা ছিলো সব নিয়ে অত্যাচার চালায়। পাশের একটি লোককে হত্যা করলো।
.
নৈকাঠি রাজাপুর থানা গ্রামে শতকরা ৯৮ জনকে হত্যা করে। ওখানকার সব হিন্দু। ৯৮% মহিলা আজ বিধবা। নৈকাঠির প্রায় সব পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে হামিদ জমাদার ও তার দল। ঐ বিপদের মাঝে জঙ্গলে জঙ্গলে এ বাড়ি ও বাড়ি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার সব কিছু লুটে নেয় রাজাকার আর পাক বাহিনী। আমি কোন মতে পালিয়ে বাহিরচরে যাই জুলাই মাসের ১৭ তারিখে। আমি আমার কাজে যোগ দেই। তার পরপরই আমাকে সাসপেন্ড করে রাখে তিন মাস । বাহিরচরে সমগ্র এলাকা খুন, ডাকাতিতে ভরা। সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।
.
অক্টোবর মাসে কুদ্দুস মোল্লাকে (মুক্তিবাহিনী) চিকিৎসা করার জন্য কর্নেল আমাদের সবাইকে ডেকে লাঞ্ছনা দেয়। যাবার পথে গানবোট থেকে আমাদের হাসপাতালে শেল ফেলে। আমরা দারোয়ান পাহারা রেখে মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা করেছি। আমাদের ডাঃ শামসুল হক মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গোপনে গিয়েও তাদের চিকিৎসা করেছেন। আমরা সবাই সবকিছু দিয়ে তাদের সাহায্য করতাম।
.
বাহিরচরে পাক বাহিনীরা মেয়েদের উপর চালিয়াছে অকথ্য নির্যাতন। বোয়ালিয়া, কাঁদপাশা, রাজগুরু, বাবুগঞ্জ থানা, দুয়ারিকা ইত্যাদি এলাকা থেকে বহু মেয়ে ধরে এনে ভোগ করেছে। আমার জানা এক হিন্দু মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধরে নিয়া যায়। মহিলা খুব সুন্দরী ছিল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চারদিন ক্রমাগত অকথ্য দৈহিক নির্যাতন চালায়। অসহ্য যন্ত্রণায় মহিলা ছটফট করেছে। চারদিন পর মহিলা ছাড়া পায়। আমরা তার চিকিৎসা করে ভালো করি।
আমি স্বামীসহ বাস করছিলাম। আমার সর্বস্ব যাওয়া সত্ত্বেও স্বামী নিয়ে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার স্বামী স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। আমাকে প্রায় বলতেন ডিসেম্বর মাস যদি বাঁচি জানুয়ারীর মধ্যে নিশ্চয় স্বাধীনতা পেয়ে যাবো।
.
৯ ই ডিসেম্বর গৌরনদী থানার মাহিলারার ব্রিজের উপর দিয়ে আমার স্বামী যাচ্ছিলেন। তখন পাক বাহিনী প্রায় আত্মসমর্পণ করে এমন অবস্থায় ব্রিজে ডিনামাইট স্থাপন করে রেখেছিলো। সেই ডিনামাইট ফেটে ব্রিজ ধ্বংস হয়। আমার স্বামী ওখানেই নিহত হন। সব হারিয়ে একমাত্র স্বামী ছিলো তাও স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে হারাতে হলো।
.
আমি বাহিরচর থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠিয়েছি। রাতে যখন তখন আমার ওখানে তারা এসে থাকতো, যেতো। আমার স্বামী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে মাঝে মাঝে যেতেন। আমার স্বামীর বড় সাধ ছিলো স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাস করা। তার সে সাধ পূর্ণ হলো না।
স্বাক্ষর/-
ভারতী রাণী বসু
১৮/৮/৭৩
.
৫ই জানুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিলো "গণহত্যার ঘৃণ্য নায়ক শর্ষিনার পীর গ্রেফতার।"
.
এরপর লেখা হয়েছিলো, 'শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর ধরা পড়েছেন। গত শনিবার পয়লা জানুয়ারি শর্ষিণা থেকে তাকে গ্রেফতার করে বরিশাল সদরে নিয়ে যাওয়া হয়।
গত ১২ই নভেম্বর ৫ শতাধিক রাজাকার, দালাল ও সাঙ্গপাঙ্গসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তখন থেকে পীর সাহেবকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।'
.
পরবর্তীতে কয়েক বছর জেলে ছিলো শর্ষীনার পীর আবু জাফর সালেহ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীতে মুক্তি দেয়া হয় তাকে।
.
বই ও তথ্য সূত্র- বীরাঙ্গনা ভারতী রানীর সাক্ষ্য- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (৮ম খন্ড)
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণা- ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা/ রশীদ হায়দার সংকলিত।
৫ই জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................