বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক বুদ্ধিজীবী ঐতিহাসিকদের দেশভাগে পূর্ববঙ্গের সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠির সম্পদ পেশা দেশ হারানোকে অতি সাধারণ করে দেখানোর প্রাক্টিস

দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গে হিন্দু মুস লমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশী বই সংবাদপত্র রেফারেন্স হিসেবে যেমন দুর্বল তেমনি বাঙালী মুস লমান লেখকরা এক্ষেত্রে চরম অবিশ্বস্ত! একটা উদাহরণ দেই, নোয়াখালীতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর ঘটা ‘হিন্দু ম্যাসাকার’ বিষয়ে বাংলাদেশের তখনকার কোন সংবাদপত্র একটি নিউজও ছাপা হয়নি! চারদিন পর ১৪ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রাদেশিক সরকার মামুলি একটা প্রেসনোটে খুবই লঘু করে ‘দাঙ্গার’ কথা জানালে তারই ভিত্তিতে কমিউনিস্টদের পত্রিকা ‘স্বাধীনতায়’ নোয়াখালী নিয়ে প্রথম নিউজ ছাপা হয়। 


নোয়াখালীতে মানবেতিহাসে কতবড় ধর্মীয় ম্যাসাকার ঘটেছিলো সেটা বুঝা যায় গান্ধির নোয়াখালী সফর ও নেহেরুর লর্ড ওয়াভেলকে চিঠি লিখে নোয়াখালীকে বাঁচানোর তাগিদ জানানোর মাধ্যমে। কিন্তু ঘটনাকে আড়াল করতে তখনকার ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'মর্নিং নিউজ' নোয়াখালীর ঘটনাকে ‘স্থানীয় হাঙ্গামা’ ও কমিউনিস্টদের পরিচালিত স্বাধীনতা পত্রিকাসহ কোলকাতার অমৃতবাজার, শনিবারের চিঠি প্রমুখ পত্রিকাগুলিকে ‘হিন্দুদের পরিচালিত’ পত্রিকা আখ্যা দিয়ে বলা হয় তারা অতিরঞ্জিত করে নিউজ প্রকাশ করছে। (তথ্যসূত্র: সংবাদভাষ্যে সেদিনের নোয়াখালী, শাকের আনোয়ার, বণিকবার্তা, ৯ জুলাই, ২০২১)।

এখন কোন গবেষক যদি কেবলমাত্র বাংলাদেশী সংবাদপত্র থেকে নোয়াখালী ‘দাঙ্গা’ নিয়ে কিছু লিখতে চায় সে দেখতে পাবে নোয়াখালীতে তেমন কোন কিছুই ঘটেনি! মনে করুন ৯০-এর দশকে বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের যে ভায়াবহ হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিলো এবং দেশত্যাগের হিড়িক পড়েছিলো সেসব নিয়ে যদি বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও এখানকার বাঙালী মুস লমান লেখকদের লেখা পড়ে তথ্য নিতে যায় সে দেখবে তেমন কোন কিছুই ঘটেনি! আহমদ ছফা সেসময়ের ঘটনা বিষয়ে বলেছিলেন, কিছুই ঘটেনি বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া! শুধুমাত্র তসলিমা নাসরিন সেসময়ের ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লেখার পর সেই বাঙালী প্রগতিশীল মুস লমান লেখক ও ‘লেখিকারা’ বলেছিলো, তসলিমা ভারতের বিজেপির টাকায় ‘লজ্জ্বা’ উপন্যাসটা লিখেছিলো। এখন যখন কেউ দেশভাগের আগে বাংলাদেশের মুস লিম লেখক গবেষকদের বই থেকে সেসময়কার গরু কুরবানী দেয়া নিয়ে রেফারেন্স দেন যে তখন হিন্দুদের ভয়ে মুস লমানদের গরু কুরবানী হতো না সেগুলো যে চরম মুসলিমবাদী হয়ে লেখা মিথ্যাচার বলাই বাহুল্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কেন মুস লমানদের জন্য জরুরী সেটা বুঝাতে তখনকার বহু প্রগতিশীল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুস লমান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় হিন্দু পরিবার থেকে সাম্প্রদায়িক জাতপাতের অপমানের স্মৃতি তুলে ধরে যেসব ইতিহাস লিখেছেন তার সঙ্গে মুসলিম কমিউনিটিতে গরু কোরবানীর দেয়া বা মুসলিমদের প্রথা পার্বন হতে না পারার কোন প্রামাণ্য দলিল নেই। তাজিয়া মিছিলের এদেশের ইতিহাস বহুপ্রচীন। ‘হোসিনি ব্রাহ্মণ’ বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ব্রাহ্মণ গোষ্ঠির কথা জানা যায় যারা ইমাম হোসেনের সৈন্য দলে হোসেনের হয়ে যুদ্ধ করতে ভারত থেকে যোগ দিয়েছিলেন...। যাক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক বুদ্ধিজীবী ঐতিহাসিকদের দেশভাগে পূর্ববঙ্গের সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠির সম্পদ পেশা দেশ হারানোকে অতি সাধারণ করে দেখানোর প্রাক্টিস ‘পাকিস্তান’ জন্মগ্রহণকে নিষ্কলুষভাবে দেখানোর লক্ষ্যে। দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গে যে একতরফা হিন্দুদের উপর সন্ত্রাস, রাহাজানি, ধর্ষণ, ধর্মান্তকরণ ইত্যাদি ঘটিয়ে তাদের দেশত্যাগের মত সিদ্ধান্ত নিতে সহজ করে দিয়েছিলো সেটা অস্বীকার করে ‘মুসলমানদের শাসনে থাকতে হিন্দুদের আপত্তি’ এরকম একটা চিত্র দেখানোর চেষ্টা হয়। আমার একজন ফেইসবুক বন্ধু বললেন আবুল মকসুদ তার একটি বইতে দেখিয়েছেন সাহিত্যিক বু্দ্ধদেব বসুকে ঢাকায় বসবাসের অনুরোধ করা হলেও তিনি ঢাকার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি কোলকাতাকে বেছে নেন। আবুল মকসুদের সেই বইটি আমি পড়িনি। বিস্তারিত তাই বলতে পারছি না। তবে এরকম যুক্তি বাংলাদেশের প্রগতিশীল মহলে বেশ জনপ্রিয়। যেমন জ্যোতিবসুর উদাহরণ দেয়া যায়। বলা হয় তিনি ঢাকায় না এসে কোলকাতায় থেকে গেছেন। এসব দিয়ে সাধারণ জনমানুষের দেশত্যাগে বাধ্য হওয়াকে জাস্টিফাই করা হয়। বুদ্ধদেব বসু দেশভাগের পর বাংলা সাহিত্যের জন্য নিজেকে যদি কোলকাতায় সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে করেন সেটা কি দোষের? রাজনীতিতে যদি কোন নেতা ঢাকা ও কোলকাতা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা থেকে থাকে তাহলে তিনি সেটাই বেছে নিবেন যেখানে তিনি মন্ত্রী প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন। বলতে চাইছি রাজনীতিতে তার যেখানে ভবিষ্যত আছে তিনি সেখানেই থাকবেন। দেশভাগ যখন হয়ে গেলো তখন স্পষ্টত ঢাকা ও কোলকাতায় কিছু বাস্তবতা গড়ে উঠল হিন্দু মুস লমানকে কেন্দ্র করে যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের দেশত্যাগের যে জুলুম তার সঙ্গে মেলানোর কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের অভিনেতা রাজ্জাক কোলকাতার মানুষ। তিনি ঢাকা এসেছিলেন তার অভিনয় গুরুর পরামর্শে কারণ কোলকাতায় উত্তম সৌমিত্র বিশ্বজিত বসন্ত কুমারদের রাজ্যত্ব চলছে সেখানে রাজ্জাকের রাজ্জাক হয়ে উঠার সম্ভবনা খুবই সামান্য। তার জন্য ভালো হবে ঢাকায় নতুন যে সিনেমা পাড়া গড়ে উঠেছে সেখানে গিয়ে চান্স নেয়া। এখন রাজ্জাকের এই বাস্তবতা দিয়ে কি দেশভাগের ইতিহাস রচনা করলে চলবে? চলবে না। ঢাকা, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী কিংবা খুলনার একজন জেলা শহরের প্রসারওয়ালা উকিল, বড় কাপড়ের মোকামের মালিক, আড়তদার, শিক্ষক এরকম পেশার সাধারণ হিন্দু যারা পশ্চিমবঙ্গে গেলে নিজেদের প্রসার, পেশা হারাবেন তাদের বাস্তবতার সঙ্গে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর কি তুলনা চলে? হাসান আজিজুল হক পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। খুলনা, রাজশাহীর মানুষের বড় একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুর থেকে এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাগুলিতে এখনো মুস লিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যদি আপনি তানভীর মোকাম্মেলের ‘সীমান্তরেখা’ তথ্যচিত্রটি দেখেন (ইউটিউবে সহজলভ্য) দেখবেন এসব জেলা থেকে ভারতীয় মুস লিমরা এসেছিলেন ‘পাকিস্তান’ নামের “মুস লমানদের” স্বপ্নের দেশে বাস করতে। সেসময় চলে আসা মানুষজনদের ইন্টারভিউতে তারা সকলেই বলেছেন কোন রকম দাঙ্গার আঁচ তারা পাননি। তারা এসেছেন কৌতুহল থেকে, নতুন জায়গায় তাদের অনেক উন্নতি হবে শুনে। পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ববঙ্গ শরণার্থী বস্তিগুলোর সেই সময়ের মানুষজনের যে চিত্র তানভীর মোকাম্মেলের ক্যামেরায় উঠে এসেছে তা মর্মান্তিক, ভয়াবহ! প্রতি পরিবারের কারো বাবাকে নিজের চোখের সামনে হত্যা হতে দেখেছে, কেউ বাড়ির মেয়েদে রেপ হতে দেখেছে।, মা বোনকে হত্যা হতে দেখে। এক বৃদ্ধাকে পাওয়া গেলো যার পরিবারের সকলকে মারা হয়েছিলো, তখন তার বয়স ছিলো দশ বছর। সে বাকী প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। তানভীর মোকাম্মেলের মত কাজ খুব বেশি বাংলাদেশে কেউ করেনি। আশ্চর্য যে পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া লেখক কবি সিনেমা পরিচালক কেউ এসব নিয়ে কোন কাজ করেননি। যেকারণে দেশভাগের সাধারণ বাঙালী হিন্দুদের একক আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রায় মুছে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এই আত্মত্যাগের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা সংগত কারণেই। কারণ মুসলিম লীগের পাপের চিহ্ন কেন তারা রাখতে চাইবে? আপনি দেখান পৃথিবীতে কমিউনিস্টরা, ইস লামিস্টরা তাদের শাসনের অন্যায়গুলোকে ইতিহাস লিখে অমর করতে চেয়েছে কোথাও? আরো সহজ উদাহরণ দেই, আওয়ামী লীগ বিএনপির বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকরা কি তাদের পার্টি শাসনামলের কোন কুকীর্তিকে স্বাকীর করে কিছু লিখে? তাই সংগত কারণেই মুসলিম লীগের খুন খারাবী, হুমকি, অত্যাচার, গণহত্যা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ কিছু লিখবে না।

#সুষুপ্তপাঠক
#susuptopathok

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted