দুর্গাপূজায় মহিষবলি, নিয়ে সংশয়ের নিরসন।

দুর্গাপূজায় মহিষবলি,
নিয়ে সংশয়ের নিরসন

দেবীপুরাণসহ বিভিন্ন পুরাণে ছাগের সাথে সাথে মহিষ বলির কথা রয়েছে। মহিষ দেখতে অনেকটা গরুর মত। তাই গরু-মহিষের আকার এবং আকৃতিগত সাদৃশ্যের কারণে অনেকেই সন্দিহান যে, শক্তিপূজায় মহিষ বলির কথা কি করে শাস্ত্রে উল্লেখ থাকতে পারে? বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই মনে সন্দেহ। মহিষাসুরের প্রতীক হিসেবে দুর্গাপূজায় মহিষ বলি দেয়া হয়। দুর্গাপূজা যেহেতু রাজসিক পূজা এবং আয়োজনও রাজসিক। তাই জমিদারি প্রথার সময়ে জমিদারগণ অত্যন্ত বর্ণাঢ্য রাজসিকভাবে দুর্গাপূজা করতেন।
 পরবর্তীতে ১৯৪৭ দেশভাগের পরে জমিদারি প্রথার সাথে সাথে মহিষবলির প্রথাটিও লুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়। বর্তমানে বঙ্গদেশে কদাচিত কয়েকটি মন্দিরে কালেভদ্রে মহিষবলি দেখা যায়। মহিষবলি প্রসঙ্গে দেবীপুরাণে বলা হয়েছে:

বরঞ্চ সর্বলোকানাং প্রপদৌ ভয়নাশিনী।।
বলিঞ্চ দদ্যুর্ভূতানাং মহিষাজামিষেণ চ।।
( দেবীপুরাণ: ২১.৪-৫)

"সেই ভয়নাশিনী দেবী সকল লোককেই অভয় প্রদান করলেন। ভূতগণ মহিষ, ছাগ ইত্যাদি বলি দেবীকে প্রদান করলেন।"

জলদান্তে আশ্বিনে মাসি মহিষারিনিবর্হিণীম্‌ ।
দেবী সম্পূজয়িত্বা তু অষ্টমী হ্যর্দ্ধরাত্রিষু ।
যে ঘাতয়ন্তি সদা ভক্ত্যা তে ভবন্তি মহাবলাঃ ।।
( দেবীপুরাণ:২১.৯)


"বর্ষা প্রভাতে আশ্বিন মাসে অষ্টমী অর্ধরাতে দেবীকে নিষ্ঠার সাথে পূজা করে যারা মহিষ, ছাগ বলি প্রদান করেন, জগতে তাঁরা মহাবলশালী হয়ে থাকেন।"

মহাভারতেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন যে দেবীস্তোত্র করে, সেই স্তোত্রে তিনি দেবীকে "সর্বদা মহিষরক্তপ্রিয়ে" বলে সম্বোধন করেছেন।

মহিষাসৃক্ প্ৰিয়ে নিত্যং কৌশিকি পীতবাসিনি ।  
অট্টহাসে কাকমুখি নমস্তেঽস্তু রণপ্ৰিয়ে।।
(মহাভারত: ভীষ্মপর্ব, ২৩.৮)

"সর্বদা মহিষরক্তপ্রিয়ে! কৌশিকি! পীতবসনে! 
অট্টহাসে! কাকবদনে! রণপ্রিয়ে! তোমায় নমস্কার।।"

শাস্ত্রের বিধান অনুসারে সকল বলির পশুই ভক্ষণীয় নয়। পূর্ববর্তী দুর্গাপূজায় মহিষবলির বিবরণ থেকে জানা যায়, সেকালে মহিষ বলি হত সত্য। কিন্তু মহিষের আকৃতির সাথে গরুর আপাতদৃষ্টিতে সাদৃশ্যের কারণে, সেই বলিকৃত মহিষের মাংস কেউ ভক্ষণ করত না। বলির পরে সেই মহিষ জলে বিসর্জন দেয়া হত অথবা মাটিতে পুঁতে দেয়া হত।সমগ্র ভারতবর্ষের কথা সুনিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও; অন্ততপক্ষে বঙ্গদেশের কথা বলা যে, বঙ্গদেশে কেই মহিষের মাংস কেউ খেত না। অবশ্য খাওয়ার প্রয়োজন নেই। মহিষবলি বিষয়টি একটি পুরাতন প্রথা। যে প্রথা বঙ্গদেশ, আসাম নেপালসহ ভারতবর্ষের হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে প্রচলিত। প্রথাটি ধীরেধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত না হলেও বঙ্গসহ ভারতবর্ষের কিছু কিছু অঞ্চলে আজও পরথাটি আচরিত হয়। শক্তিপীঠ আসামের কামাখ্যা মন্দিরেও আজও মহিষ বলি হয়। এখানে স্মর্তব্য যে, শাস্ত্রে উক্ত থাকলেও, মহিষাসুরের প্রতীক হিসেবে মহিষবলি প্রথাটি পুনরায় পূর্বের মত প্রচলিত করা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে এক কথায় বলতে গেলে অনুচিত। কেই যদি দেবীর উদ্দেশ্যে কোন পশু সমর্পণ করতে চায়, পাঠাকেই সমর্পিত করতে পারে।

শাস্ত্রে বিশেষ করে বিবিধ পুরাণ এবং তন্ত্রে যেহেতু মহিষ বলির বিধান রয়েছে, সে বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে মানুষের মনে ব্যাপকভাবে সন্দেহ রয়েছে। অনেক মানুষ আমার কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছে।সেই সকল সন্দের নিরসন কল্পে বলা যায়, গরু এবং মহিষ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটি প্রাণী। গরুর পশ্চিমা প্রজাতি হল 'Bos taurus' এবং ভারতীয় উপমহাদেশের উপপ্রজাতি হল 'Bos taurus indicus'. অন্যদিকে আফ্রিকান মহিষ প্রজাতি হল 'Syncerus caffer' এবং ভারতীয় উপমহাদেশের জলমহিষ হল 'Bubalus bubalis'. গরু এবং মহিষ ভিন্ন দুটি প্রাণি হলেও দেখতে অনেকটা একই স্তন্যপায়ী 'বোভিড রুমিন্যান্ট' বৈশিষ্ট্যের। 'বোভিডিই' তাদের পরিবার এবং 'বোভিনিই' উপপরিবার। ল্যাটিন 'রুমেন' অর্থ গলা। গলাধঃকরণ করা খাদ্য আবার গলায় এনে, পরবর্তীতে যারা পুনরায়  সেই খাদ্যে জাবর কাটে, তাদেরই রুমিনেন্ট বলে।এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল জাবর কাটা।গণ ও প্রজাতির ভিন্নতা দেখেই সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া যায় যে, গরু ও মহিষ একই প্রাণী নয়। যদিও একই পরিবার, উপপরিবার এমনকি একই 'বোভিনি' ট্রাইবের তারা অন্তর্ভুক্ত। ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি ক্যাটেল বোভিডিই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

তবে আপাতদৃষ্টিতে এক মনে হলেও, গরু ও মহিষের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। গরুর ত্বকে পশমের পরিমান অত্যধিক। কিন্তু মহিষের দেহে পশমের পরিমাণ সামান্য এবং বিক্ষিপ্ত। গরুর শিং ছোট, পাতলা এবং সামান্য বাঁকানো। পক্ষান্তরে মহিষের শিং বৃহৎ, মোটা এবং অধিক বাঁকানো।গরুর গলার নিচে চামড়ার থলি 'ডিউল্যাপ' রয়েছে। কিন্তু মহিষের গলার নিচে চামড়ার থলি 'ডিউল্যাপ' নেই। মহিষের পিঠে কোন কুঁজ নেই। কয়েকটি ব্যতিক্রমী প্রজাতি ছাড়া প্রায় ৯৫% গরুর পিঠেই কুঁজ বিদ্যমান। আমরা যদি অভ্যন্তরীণ আঙ্গিক ও মস্তিষ্কগত পার্থক্য বিবেচনা করে বিভিন্ন অঙ্গের বিভিন্ন আকার,একই পেশি ও হাড়ের বিভিন্ন আকৃতি মিলিয়ে গরু এবং মহিষ সম্পূর্ণ আলাদা দুটি প্রাণী হিসেবেই নির্দেশ করে।একই কার্যকরী জিন যা তাদের পূর্বপুরুষ হতে প্রাপ্ত, তাদের অর্থোলোগাস জিন বলা হয়।ঐ ৮৬ টি জিন কার্যকরভাবে গরু এবং মহিষে এক হলেও, সেই সকল জিনের গাঠনিক ভিন্নতা এদেরকে আলাদা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট! গরু ও মহিষের মধ্যে ৩% অর্থোলোগাস জিনের পার্থক্য রয়েছে। তবে এ ৩% পার্থক্যে বলতে ঐ সকল জিনে থাকা লক্ষ লক্ষ বেস পেয়ারের পার্থক্য হয়ে যায়। গরুর দেহে ঘর্মগ্রন্থি বিদ্যমান থাকায় দেহের অধিক তাপ ঘামের সাথে নির্গত হয়।কিন্তু মহিষের দেহের অদ্ভুত বিষয় হল কোন ঘর্মগ্রন্থি নেই। তাই তারা তাপ নির্গমনের জন্য দিনের বেলায় জলে আর রাতে কাদায় ডুবে থাকে। মহিষের শরীরের তাপমাত্রা ৯৯.২-১০৩° ফারেনহাইট। পক্ষান্তরে গরুর শরীরের তাপমাত্রা সর্বদাই প্রায় ১০১° ফারেনহাইটের আশেপাশে থাকে।গরুর কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা ৫৮, অন্যদিকে মহিষের কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৮-৫০ টি,যার মধ্যে উভয়েরই সেক্স ক্রোমোজোম বা লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্রোমোজোম ২ টি।

মানুষ, শিম্পাঞ্জি ও বনোবোস 'হোমোনিডিই' পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলেও এরা সকলেই স্বতন্ত্র। আবার এ তিনটি প্রাণি 'ট্রাইব হোমোনিনি' মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। একই ট্রাইব ভূক্ত হয়ে মানুষ শিম্পাঞ্জি বনোবোস এ কতটুকু পার্থক্য রয়েছে? এখানে উল্লেখ্য যে, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি মধ্যে পার্থক্য মাত্র ১.২%। এ সামান্য ১.২% পার্থক্য মানুষ এবং শিম্পাঞ্জিকে দুটি ভিন্ন প্রাণীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গরু, মহিষ, বিসন, নীলা, ইয়াক (তিব্বতী গাই), গয়াল এরা সবাই বোভিডিই পরিবারের ট্রাইব বোভিনির অন্তর্ভুক্ত। তবুও এরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রাণী।মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জিকে কিংবা গরিলাকে পাশাপাশি রাখলেই যথেষ্ট সাদৃশ্যের সাথে সাথে ব্যাপক বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ৯৮.৮% সাদৃশ্য থাকার পরেও মানুষ শিম্পাঞ্জিকে বা গরিলাকে কি একই প্রাণী? এই প্রশ্নের সরল উত্তর, না একই প্রাণী নয়। বরং ১.২% পার্থক্য মানুষ শিম্পাঞ্জিকে বা গরিলার দেহের অভ্যন্তরে শত শত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের তৈরি করেছে। তবে গরু ও মহিষের মধ্যে ৩% অর্থোলোগাস জিনের পার্থক্য থাকার পরে এরা কি করে একই প্রাণী হয়? এই উভয়ের মধ্যে দর্শনগত আপাতদৃষ্টি সাদৃশ্য থাকলেও, এরা কোনভাবেই একই প্রাণী নয়। কারণ উভয়ের মধ্যে এই ৩% জিনের পার্থক্যে লক্ষ লক্ষ বেস পেয়ারের পার্থক্য হয়ে যায়। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

(আমি যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তাই পোস্টে ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক।সেই ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ হব।)

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted