১১ই আগস্ট ভোর ছ'টায় মোজাফফরপুর জেলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হল।

১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল রাত্রি সাড়ে-আটটায় মোজাফফরপুরে বোমা পড়ল-বাঙ্গলায় প্রথম বোমা।

বোমাটা ফাটল একটা ফিটন গাড়ীর মধ্যে।গাড়ীখানা চুরমার হয়ে গেল।সইস,কোচম্যান দু'জনেই জখম হল।গাড়ীর মধ্যে ছিলেন মোজাফফরপুরের শ্বেতাঙ্গ উকীল মিঃ কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা।মিস কেনেডি এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলেন,মিসেস কেনেডি দু'দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরে মারা যান।বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন তরুণ ক্ষুদিরাম এবং তার এক সহযোগী। 

মোকামঘাট স্টেশনে একটি কাণ্ড ঘটে গেল।মোজাফফরপুরে যখন বোমা ফাটে, তখন ক্ষুদিরামের সঙ্গে ছিল সহযোগী দীনেশ।বোমা ফাটবার অব্যবহিত পরেই ক্ষুদিরাম ও দীনেশ আলাদা পথে পদব্রজে মোকামঘাট স্টেশনের দিকে রওনা হন।পরদিন সকাল আটটার সময়ে মোজাফফরপুর থেকে পনের মাইল দূরে ওয়ানি স্টেশনে এক মুদীর দোকানে  উনিশ বছরের তরুণ ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে।ক্ষুদিরামকে গ্রেপ্তার করেছিল ফতে সিং ও শিউপ্রসাদ সিং নামে দু'জন কনস্টেবল। ক্ষুদিরামের দেহ তল্লাশি করে একটা ভারী রিভলবার এবং ত্রিশটা কার্তুজ পাওয়া যায়। 

অন্যদিকে দীনেশ ২রা মে ধরা পড়ার উপক্রম হলে নিজেই নিজের মস্তক ও কন্ঠনালীতে গুলী করে আত্মহত্যা করেন।এই দীনেশ আর কেউ নন,প্রফুল্ল চাকী।

আসলে মুজাফফরপুরের অত্যাচারী জেলা জজ ডি.এইচ..কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য যুগান্তর দলের পক্ষ থেকে ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকীকে পাঠানো হয়েছিল।কিন্তু ভুলবশত তাদের বোমার আঘাতে মিস কেনেডি এবং মিসেস কেনেডি নিহত হন।

ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্রেটহাউড ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট জবানবন্দীতে ক্ষুদিরাম সব কিছুই স্বীকার করল।ক্ষুদিরাম জানান," আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল কিংসফোর্ডকে হত্যা।"তারা মোজাফফরপুরে এসে কিশোরীমোহন ব্যানার্জির ধর্মশালায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে মামলায় সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন মানুক ও পাটনার সরকারি উকীল বিনোদবিহারী মজুমদার। স্থানীয় উকীল কালিদাস বসু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ক্ষুদিরামের পক্ষ সমর্থনে দাঁড়ান।পরে রংপুরের কুলকোমল সেন ও নগেন্দ্রলাল লাহিড়ী এবং সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী নামক আর একজন উকীলও ক্ষুদিরামের পক্ষ সমর্থন করেন।বাবু নাথুনিপ্রসাদ ও বাবু জনকপ্রসাদ নামে দু'জন এসেসরের সাহায্যে মামলার বিচার করা হয়।এই মামলায় চব্বিশ জন সাক্ষ্য দান করেছিল।

১০ ই জুন কিংসফোর্ডের গাড়োয়ান কালীরাম এবং   তহশীলদার খান,ফয়েজুদ্দীন ও ইয়াকুব আলি-এই তিনজন কনস্টেবলের সাক্ষ্য নেওয়া হল।১১ ই জুন সাক্ষ্য দিল ফতে সিং ও শিউপ্রসাদ মিশির।

এজলাসে ক্ষুদিরামকে কিছু প্রশ্ন করা হয়ঃ

প্রশ্ন- তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?

উঃ- আমি একবার মেদিনীপুর যেতে এবং আমার দিদি ও তার ছেলেমেয়েকে দেখতে চাই।

প্রশ্ন- জেলে তোমার ওপর কিরকম ব্যবহার করা হচ্ছে?

উঃ- মন্দ নয়।জেলের খাবার খারাপ বলে আমার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে,তবে আমার প্রতি অন্য কোনও খারাপ ব্যবহার করা হয়নি।আমাকে দিনরাত নির্জন সেলে আটকে রাখা হয়।একা থাকা অত্যন্ত ক্লান্তিকর হয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন- তোমার মনে কি কোনও ভয় হয়েছে?

উঃ- না,ভয় পাব কেন(হাস্যমুখে)?

প্রশ্ন-তুমি কি গীতা পড়েছ?

উঃ- হ্যাঁ, আমি গীতা পড়েছি।

ম্যাজিস্ট্রেট ব্রেটহাউটের নিকট ক্ষুদিরাম যে বিবৃতি দিয়েছিল,তা ১২ ই জুন তাকে পড়ে শোনান হল।১৩ ই জুন সরকারপক্ষের সওয়াল শেষ হলে কালিদাস বাবু ক্ষুদিরামের পক্ষে সওয়াল করতে উঠলেন।কালিদাস বাবু ক্ষুদিরামের তরুণ বয়সের প্রতি জজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন যে,অপরের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েই সে এই কাজ করেছে।সওয়াল শেষ হলে জজ এসেসরদের মামলা বুঝিয়ে দিলেন।এসেসররা ক্ষুদিরামকে দোষী বলে ঘোষণা করলেন।জজ তাদের সঙ্গে একমত হয়ে ক্ষুদিরামের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।

রায় দিয়ে জজ ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞাসা করলেন যে,তাকে যে দণ্ড দেওয়া হয়েছে তা সে বুঝতে পেরেছে কি?উত্তরে ক্ষুদিরাম বলে যে,হ্যাঁ সে বুঝতে পেরেছে(অবিচলিতচিত্তে)।

এরপরে হাইকোর্টে আপীল করা হয়েছিল।আপীল করেছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী নরেন্দ্রনাথ বসু।১৩ ই জুলাই বিচারপতি ব্রেট ও বিচারপতি রাইভস আপীল অগ্রাহ্য করে মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখলেন।১১ই আগস্ট ভোর ছ'টায় মোজাফফরপুর জেলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হল।

আজ সেই ১১ ই আগস্ট, বিনম্রচিত্তে ভারতবীর ক্ষুদিরাম বসুকে স্মরণ করবার দিন।

✍️✍️✍️ সন্দীপ মুখোপাধ্যায়। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার- শ্রী সুধীরকুমার সেন।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted