বাংলাদেশে এখন অসংখ্য ছোট ছোট ‘হুমায়ূন আহমেদে’ ভরে গেছে! এরাই নাটক লিখছে টিভির জন্য, গল্প উপন্যাস লিখছে। প্রতি বছর বইমেলায় বই বের করছে। এদের গল্প হুমায়ূন আহমেদের বানানো ফ্রেমের বাইরে যেতে পারে না। এদের চরিত্ররা সংলাপ বলে হুবহু হুমায়ূনীয় ভঙ্গিতে। এদের নায়িকারা হুমায়ূনীয় নায়িকাদের মত আসমানী রঙের শাড়ি পরে ছাদে একাকী হেঁটে বেড়ায়। এদের লেখা পড়তে গিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ি। হুমায়ূনকে সচতনে অবচেতনে এই যে নকল করে যাচ্ছে সেটা পড়ে আমি লজ্জ্বা পাচ্ছি এরা পায় না? তাছাড়া হুমায়ূন আহমেদ কেমন লেখে সেটা তো আমরা জানিই, তাহলে কষ্ট করে ‘নকল হুমায়ূন’ পড়তে যাবো কেন?
এগুলো ঘটেছে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য। আমাদের সময় থেকেই মানে সেই ৯০ দশক থেকেই ধারণা গজিয়ে ছিলো হুমায়ূন আহমেদের স্টাইলে লিখলেই জনপ্রিয়তা নিশ্চিত। তবে তখন দু-চারজন এরকম করে লিখত। তারা এখন হারিয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে সেটা মহামারী আকারে নিয়েছে। ছোটবেলায় যারা ডায়পার পরেছে এমন প্রজন্মের লেখকরা চোখকান বন্ধ করে হুমায়ূন আহমেদের নকল করে যাচ্ছে। এরা মনে হয় সকলেই সচেতনভাবে করছে না, অবচেতনেও সেটা করে যাচ্ছে। মানে এদের লেখক হিসেবে নিজস্ব কন্ঠস্বর, ভাষা এখনো তৈরি হয়নি। অগ্রজ লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটা সব লেখকের প্রাথমিক জীবনে ঘটে থাকে। পরে তারা নিজের ভাষাটা পেয়ে যান। যখন লেখকের নিজস্ব ভাষাটা এসে যায় তখনই তার লেখাটা আসলে মূল লেখক হিসেবে পাঠক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখন এইসব নকলনবিশরাই সাহিত্য অঙ্গ জেঁকে বসে আছে!
লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্কটা কি রকম? আমি অনেকদিন থেকে খেয়াল করে আসছি বর্তমানে লেখক ও পাঠকদের সঙ্গে দোকানদার আর ক্রেতার সম্পর্ক। লেখক হচ্ছে ভালো ও মধুর ব্যবহারের দোকানদার যিনি পাঠককে তার বইটি কিনতে বিনয়ে কোমড় বাঁকিয়ে ফেলছেন! প্রি-অর্ডার করে টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে বই ডেলিভারি করে পাঠককে বলছেন, আমি অভিভূত আপনাদের এই ভালোবাসায় যা আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব! যে লেখক এভাবে তার পাঠকের কাছে ঋণি ও কৃতজ্ঞ সে কি লিখবে? সে সেটাই লিখবে যা পাঠক খায়! সে সব সময় খেয়াল করবে তার কাস্টমার কষ্ট পেতে পারে বা তাকে প্রত্যাখান করতে পারে এমন কিছু লেখা যাবে না। লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্কটা তাহলে কেমন হওয়া উচিত? ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ‘আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা,কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েন্ট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে উঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে উঠেন, আমার প্রোটেস্টটাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা’।
লেখকের সঙ্গে তার পাঠকের সম্পর্কটা ঠিক এরকম হতে হবে। লেখক তার বই কেনার জন্য পাঠকের কাছে হাতজোড় করে দাঁড়াবে না। বরং অদৃশ্য এক চাবুক হাতে লেখক তার পাঠকের পিঠে চাবুক চাবকে দিবে। পাঠকের বিশ্বাসে, আস্থায়, আদর্শে, মিথে, পৌরাণিকে, কিংবদিন্ততে লেখক চাবুক মেরে পাঠককে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করবে। বলাই বাহুল্য জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ সেরকম করে লিখতেন না। তার ভক্তরা যারা এখন লিখছেন তারাও সেভাবেই শিখে আসছে। যে লেখক তার বই বের হলে ‘আলহামদুরিল্লাহ’ বলে, ‘আল্লার রহমতে’ শব্দ দিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সে লেখক তার পাঠককে কি ভরসা দিবে যে কিনা নিজেই অদৃশ্য কারোর খেয়াল খুশির উপর নিজের নিয়তিতে বিশ্বাস করে?
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................