#মূর্তি_পূজাকে_যজ্ঞের_সমমর্যাদা_দেওয়ার_প্রসঙ্গে!
শুরু করছি বিবেকানন্দের স্বীয় উক্তি উপস্থাপন এর মাধ্যমে। চিকাগো বক্তৃতায় হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বলেছেন, মূর্তি পূজা হল নিম্মস্তরের(বাণী ও রচনা,খন্ড ১,হিন্দু ধর্ম,পৃষ্ঠা ১১)। কিন্তু অবাক হই তখন, যখন দেখি কিছু কথিত ফিলোসোফার শুধু মাত্র আমাদেরই সমালোচনা করে থাকেন! আমরা সকলেই জানি স্বামীজী ও ওনার গুরুদেব রামকৃষ্ণ মূর্তি বা প্রতিমা পূজারি তথা প্রতিমায় ঈশ্বরের পূজা করতেন। আমরা তা কখনোই অস্বীকার করিনা, বরংচ আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জীর রচিত সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থের চতুর্দ্দশ সমুল্লাসের ৩১নং পয়েন্টে ৫২৫নং পৃষ্ঠায় মহর্ষি যবনদের সাথে কথোপকথনের সময় এই প্রসঙ্গে বলেছেন-
"তোমরা যাদেরকে পৌত্তলিক মনে কর তারাও নানা প্রকার মূর্তিকে ঈশ্বর মানে না, কিন্তু তাদের সম্মুখে পরমেশ্বরেরই পূজা করে। তোমরা মূর্তি ভঞ্জক হইলে সেই সব বড় মূর্তি(*) ভঙ্গ কর নাই কেন?" এবং শেষ পর্যন্ত এটাই বলেছেন যে-
"অবশ্য তোমরাও যদি আমাদের ন্যায় বৈদিক ধর্ম অবলম্বন কর তাহলে মূর্তিপূজাদি কুকর্ম হইতে অব্যাহতি পাইতে পার, নতুবা নয়।"
তাই কথিত ফিলোসোফারদের বলতে চাই যে, যারা না জেনে অথবা সত্যি জেনেও অযথা আর্যদের নামে মিথ্যা রটাচ্ছেন বা তাদেরকে মুসলমানদের এজেন্ট বলে বা কদাচারী বলে জন সমাজে উপস্থাপন করছেন তারা এর থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবেন বলে আশাকরি।
এখন কথা হলো সেই সকল ফিলোসোফারদের দৃষ্টিতে আমরা কথিত মুসলিম এজেন্টরা নাকি তাদের তত্ত্ব দর্শন বুঝতে পারি না। কিন্তু কথা হল এই তত্ত্বটি এলই বা কোথা হতে? বিবেকানন্দকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়(ওনার মুখ থেকেই শুনুন)-
"বৌদ্ধগণ প্রাণী হিংসা নিন্দা করিতে গিয়া বৈদিক যজ্ঞ_সমূহের_ঘোর_বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিল। পূর্বে প্রত্যেক গৃহে এই সকল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইত, গৃহকোণে যজ্ঞ কুন্ডে অগ্নি প্রজ্বালিত থাকিত, ইহাই ছিল উপাসনার যা-কিছু সাজসজ্জা। বৌদ্ধদের প্রচারে এই যজ্ঞগুলি লোপ পাইল, তৎপরিবর্তে বিরাট বিরাট মন্দির, জাঁকালো অনুষ্ঠান পদ্ধতি, আড়ম্বরপ্রিয় পুরোহিত দল এবং বর্তমান কালে ভারতে আর যাহা কিছু দেখিতেছ, সেইগুলির আবির্ভাব হইল।... তাহারা জানে না যে, বৌদ্ধ ধর্মই ভারতে পৌরোহিত্য ও প্রতিমা পূজার সৃষ্টি করিয়াছে।" স্বামী_বিবেকানন্দের_বাণী_ও_রচনা,
৫ম খন্ড, ভারতীয় মহাপুরুষগণ, পৃষ্ঠা ১২১.
অর্থাৎ ওনার কথায় এটা পরিষ্কার যে, মূর্তি বা প্রতিমা বা প্রতিমায় ঈশ্বর পূজা আর যাই হোক না কেন, তা মূল সনাতন ধর্মের আবশ্যিক কোন অঙ্গই নয়। তা পরবর্তীকালে সৃষ্ট একটি সাধন পথ, তাও অন্য একটি মতাবলম্বী সম্প্রদায় হতে আগত। যাদেরকে কিনা হিন্দুদের মূল যজ্ঞ কেন্দ্রিক জীবন ধারার অধঃপতনের মূল কারণ রূপে বর্তমানে অধিকাংশ হিন্দুরাই মান্য করে। আর আপনারা কথিত ফিলোসোফাররা সেই মূর্তি পূজাকেই যজ্ঞের সাথে তুলনা করছেন। সাথে এটাও বলছেন যে, আমরা নাকি তত্ত্ব দর্শন বুঝতে পারছি না! ওহে আমার ফিলোসোফার ভাইয়েরা আপনারা কি সনাতন দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছেন নাকি বৌদ্ধ দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছেন? কেননা আপনারা তো বৌদ্ধদের মতই হিন্দুদেরকে তাদের সনাতন যজ্ঞ কেন্দ্রীক জীবন ব্যবস্থা হতে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে, সমগ্র ভাবে মূর্তি পূজা কেন্দ্রীক জীবন ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। কেননা আপনারা দুটোকেই সমান রূপে তুলনা করেছেন। গৌতম বুদ্ধ ওনার সময়ে বহুবার বহু যজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং প্রাণী হিংসা রহিত যজ্ঞের বহু প্রশংসা ত্রিপিটকে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোন ধরনের মূর্তি পূজা করতে আদেশ দেয়নি। কিন্তু তারপরও তার মূঢ় শিষ্যরা তার মূর্তি তৈরি করেই যত সব আচার অনুষ্ঠান ও পূজা পদ্ধতি তৈরি করলো এবং তা হিন্দু সমাজে মিশে গেল। বিবেকানন্দও মূর্তি বা প্রতিমা পূজারি বা প্রতিমায় ঈশ্বর পূজারি হওয়ার পরেও এটা বলেছেন যে, এই মূর্তি পূজা নিম্নস্তরের। একই সাথে তিনি একে সাধনার প্রাথমিক স্তর বলেও ঘোষণা করেছেন ওনার বাণী ও রচনাবলী গ্রন্থে। কিন্তু আপনারা তথাকথিত ফিলোসোফাররাতো দেখি মূর্তি পূজাকে নিম্ন স্তরের বা সাধনার প্রাথমিক বলেও প্রচার করেন না। তাহলে আপনাদের আদর্শিক শিষ্যরা ভবিষ্যতে এই মূর্তি পূজা নিয়ে কতটা অনর্থ ঘটাতে পারে তার কি কোন ধারণা আপনারা রাখেন বা অনুমান করতে পারেন? এই মূর্তি পূজার পক্ষে ঘোরতর ভাবে সাফাই গাইতে গিয়েই কিন্তু আজকাল বিভিন্ন পেনিস আকৃতির মূর্তিকে ও যোনি আকৃতির মূর্তিকে আমরা দেখতে পাই। এছাড়াও দেখতে পাই বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি তথা সাংসদের প্রতিকৃতি স্বরূপ মূর্তিকে দেবী দুর্গার প্রতিমা বলে চালিয়ে দেওয়া।। এই সকল ক্রিয়াকলাপ সমাজে হিন্দুদের মথা উচু করতে সাহায্য তো করেই না বরংচ তা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে আমাদের ধর্মটাকেই হাঁসির খোরাক বানিয়ে দেয় ও ঘটে ধর্মান্তরকরণ এর মত ঘটনা।
আমরা সকলেই জানি এবং অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বামী বিবেকানন্দ প্রতীকের সাহায্যে পূজা করার পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, তিনি বেদের দোহাই দিয়ে এই পক্ষ অবলম্বন করেননি বরংচ কল্পণা বলেই স্বীকার করে বলেছেন, তিনি বলেছেন-
"বেদে মূর্তিপূজার উল্লেখ নাই। স্রষ্টা এবং সখারূপে ঈশ্বরের অভাববোধের প্রতিক্রিয়া হইতেই শ্রেষ্ঠ আচার্যগণের মূর্তিকে ঈশ্বর কল্পনা করিয়া লওয়া হইয়াছে"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, দ্বিতীয় খণ্ড, জ্ঞান যোগ কথা)
আমরা এটাও জানি যে, আমাদের একটি সর্বোচ্চ লক্ষ্য রয়েছে। আর সেটি হলো মোক্ষলাভ। মোক্ষ অর্জনে সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে পৌঁছতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-
"এই মূর্তিপূজা আমাদের সকল শাস্ত্রেই অধমাধম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পঞ্চম খন্ড, আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম)
এখন কথা হলো, এই অধমাধম উপায় নিয়েই কি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌছতে পারব? পারব না, স্বামীজীরই কথাতে তা স্পষ্ট-
"যাহা হউক স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এই প্রতীক-পূজা আমাদিগকে কখনই মুক্তি দিতে পারে না;"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাবলী,
চতুর্থ খণ্ড, প্রতীকের কয়েকটি দৃষ্টান্ত)।
অর্থাৎ প্রতীকের সাহায্যে উপাসনাকে তিনি সর্বোচ্চ উপায় বলেননি।
অপরদিকে এই প্রতীকের সাহায্যে উপাসনাতে বিপদের আশঙ্কা করে বলেছেন-
"দ্বিতীয়তঃ ইহাতে বিশেষ বিপদাশঙ্কা আছে। বিপদ এই যে, প্রতীক বা সমীপকারী সোপান-পরম্পরা যতক্ষণ পর্যন্ত আর একটি অগ্রবর্তী সোপানে পৌঁছিবার সহায়তা করে, ততক্ষণ উহারা দোষাবহ নয় বরং উপকারী, কিন্তু আমাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জন সারা জীবন প্রতীকোপাসনাতেই লাগিয়া থাকে।...লোকে মুখে বলিবে যে, এগুলি সোপান মাত্র—এই-সকল সোপানের মধ্য দিয়া তাহারা অগ্রসর হইতেছে, কিন্তু বৃদ্ধ হইলেও দেখা যায়, তাহারা সেই-সকল সোপান অবলম্বন করিয়াই রহিয়াছে।"(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, প্রতীকের কয়েকটি দৃষ্টান্ত)।
সুুুুতরাং স্বামীজীর মতে যারা বয়স্ক তাদের কি করা উচিত তা এখানে স্পষ্ট কিন্তু এ কথা কি কেহ শুনবে!! নাকি স্বামীজীর স্বীকার করা অধমাধম সোপানেই সারাজীবন পার করবে? তুলনা করলে দেখা যায়, বেদে পরমপিতা পরমেশ্বর স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন যজ্ঞের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হওয়া যায়। বেদ মন্ত্রে বলা হয়েছে-
"যজ্ঞেন যজ্ঞময়জন্ত দেবাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যসন্।তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত য়ত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তিদেবাঃ।। ঋগবেদ ১০/৯০/১৬.
অর্থাৎ সত্য নিষ্ঠ বিদ্বানেরা যজ্ঞের দ্বারাই পরমেশ্বরের পূজা করেন। যজ্ঞে সব শ্রেষ্ঠ ধর্মের সমাবেশ হয়। মহান ব্যক্তিরা যজ্ঞ দ্বারা ভগবানের পূজা করে দুঃখরহিত হয়ে মোক্ষ লাভ করেন। সাধন সাধন সম্পন্ন ও জ্ঞান সম্পন্ন বিদ্বানেরা যেখানে পূর্ব হতেই বাস করছেন।
এই সবই উপরোক্ত মন্ত্রের উল্লেখ যোগ্য বিষয়। এখানে বুঝতে হবে যে 'যজ্ঞ' শব্দ 'যজ্' ধাতু থেকে তৈরি হয়েছে। যার তিনটি অর্থ ধাতু পাঠে বর্ণিত আছে- ১.দেবপূজা, ২.সংগতিকরণ ৩.দান। এর মধ্যেই আমাদের সকল কর্তব্য নিহিত আছে। এই জন্য শতপথ_ব্রাহ্মণ ১/৭/৩/৫. এ বলা আছে- "যজ্ঞো_বৈ_শ্রেষ্ঠতমং_কর্ম।" আবার তৈত্তিরীয়_সংহিতা ৩/২/১/৪. নং এ আছে- "যজ্ঞো_হি_শ্রেষ্ঠতমং_কর্ম। এই সব ক্ষেত্রে যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠতম কর্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে, গীতাতেও এরূপই বলা আছে। আর যারা যজ্ঞ করে না তাদের কি দুর্গতি ও অধপতন হয় সেই বিষয়ে বেদ বলে-
"ন য়ে শেকুর্য়াজ্ঞিয়াং নাবমারুহম্ ইর্মেব তে ন্যবিশন্ত কেপয়ঃ।" ঋগঃ ১০/৪৪/৬. অথর্বঃ ২০/৯৪/৬.
অর্থাৎ যে ব্যক্তিরা যজ্ঞময়ি নৌকায় আরোহন করতে সক্ষম হয় না, তারা কুৎসিৎ অপবিত্র আচরণকারী হয়ে এই লোকেই ক্রমশঃ অধপতিত হতে থাকে।
কিন্তু আপনারা তথাকথিত ফিলোসোফাররা যখন শাস্ত্র বিধান না মেনে কথিত তত্ত্ব দর্শন এর খিচুড়ি হিন্দু সমাজকে খাওয়াতে চাইছেন, তাদের ব্যাপারে গীতার বাণীই স্মরণ করতে চাই। কেননা গীতায়ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জী নানা রকমের যজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছে, কিন্তু নানা রকমের মূর্তি পূজার বর্ণনা দিয়ে যায় নি। যদি এই সকল মূর্তি পূজা তখনও থাকতো এবং সেগুলো যজ্ঞের সমমর্যাদার ও সম-সুফলপ্রদ হতো তাহলে তিনি কয়েক রকমের মূর্তি পূজার বর্ণনাও দিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি তা না দিয়ে বরং বলেছেন-
"শাস্ত্র বিধান না মেনে, অন্ন ও দান না করে, যথাযথ মন্ত্র উচ্চারণ না করে, দক্ষিনা না দিয়ে, শ্রদ্ধাহীন ভাবে যে যজ্ঞ করা হয় তাকে তামস_যজ্ঞ বলা হয়।" গীতা ১৭/১৩.
"যজ্ঞ করাই কর্তব্য এই ভাবে মন স্থির করে ফলাকাঙ্ক্ষা না করে শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুসারে যে যজ্ঞ করা হয় তাই সাত্ত্বিক_যজ্ঞ।" গীতা ১৭/১১.
মনে রাখা উচিত-
"বেদমুখে এরূপ বহুবিধ যজ্ঞ বিহিত হয়েছে। সে সকলই কর্ম জাত বলে জানবে, এরূপ যেনে মুক্তি লাভ করবে। দ্রব্য যজ্ঞ অপেক্ষা জ্ঞানরূপ যজ্ঞ প্রশস্ততর। সকল কর্ম নির্বিশেষে জ্ঞানে গিয়েই শেষ হয়।" গীতা ৪/৩২,৩৩.
"সকল পাপী অপেক্ষাও যদি তুমি অধিক পাপী হও, তা হলেও জ্ঞনরূপ ভেলার দ্বারা তুমি পাপ সমূদ্র অতিক্রম করতে পারবে। এই জগতে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই নেই। নিজের চেষ্টাকৃত যোগ বলে দীর্ঘ কাল পর নিজের আত্মাতেই সেই জ্ঞান লাভ করে থাকেন।"
গীতা ৪/৩৬,৩৮.
উপরে উক্ত শাস্ত্র বিধান বলতে যদি আপনারা ধরে নেন পৌরাণিক বিধান তাহলে মহাবিপদ হতে পারে বৈকি। কেননা বিবেকানন্দ নিজেই কিন্তু পুরাণগুলোকে শতভাগ স্বীকার করেনি বরংচ এটাই বলেছিলেন যে, "বেদ ও পুরাণের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বেদের মতই গ্রহণ করতে। এবং পুরাণ গুলো নষ্ট বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের লেখা বলেও উল্লেখ করেছেন।" যেখানে আপনারা কথিত ফিলোসোফাররা স্বীয় জ্ঞান বলে এটাই স্বীকার করতে চাইছেন না যে মূর্তি পূজা হল আমাদের হিন্দু সমাজে মিশে যাওয়া একটি নিম্ন স্তরের সাধন প্রণালী, সেখানে আপনাদের তত্ত্ব দর্শন বা জ্ঞানের আলোকে সেই মূর্তি পূজাকে যজ্ঞের সমমর্যাদা চিন্তা করাটাও তো মহাপাপ। ধরে নিলাম দ্রব্য সামগ্রীর অপ্রতুল্যতার হেতু আপনারা দ্রব্য যজ্ঞ করতে পারছেন না। কিন্ত কোন জ্ঞান বলে যজ্ঞকে মূর্তি পূজার সাথে তুলনা করেন? দ্রব্যময় যজ্ঞে যে আহুতি দেওয়া হয় তা পুড়ে পরিবেশে মিশে যায়, ফলে বায়ু ও জল শুদ্ধ হয় এবং দূর্গন্ধ নাশ হয়, কিন্তু মূর্তি পূজায় পরিবেশের কোন উপকার হয়?
আচার্য_আদি_শংকর ওনার পরাপূজা গ্রন্থে বলেছেন-
"সর্বব্যাপকের আবাহন কিভাবে করা যেতে পারে? বসানোর আসন, পা ধোয়ানোর জন্য পাদ্য, মুখ ধোয়ানোর জন্য অর্ঘ এবং নিত্য শুদ্ধকে আচমন করার জন্য জল কিভাবে দেওয়া যেতে পারে?" শ্লোক২.
"যিনি সদা নির্মল, তার স্নানের কি প্রয়োজন? যার উদরে সম্পূর্ণ ব্রহ্মান্ড সমাবিষ্ট হয়ে রয়েছে- তাকে বস্ত্র কিভাবে পরাবে?" শ্লোক৩.
"নির্লেপ ভগবানের জন্য গন্ধ কোথায়? তার সুগন্ধির প্রতি কামনা নেই তিনি হাতে পুষ্প নিয়ে কি করবেন? যিনি নির্বিশেষ তাঁর বেশভূষা কেমন ভাবে হবে?" শ্লোক৪
"যিনি নিরঞ্জন, তার ধূপের কি দরকার? যিনি সকলের সাক্ষী দাতা, তাঁকে দেখার জন্য প্রদীপের প্রকাশের কি দরকার? যিনি হলেন আনন্দ স্বরূপ ও পূর্ণরূপে তৃপ্ত, তাকে নৈবদ্যের অপেক্ষা কেন?" শ্লোক৫
এরূপ আরো অসংখ্য প্রশ্ন আচার্য শংকর আপনাদের মনোজগতের উদ্দেশ্যে খুব সুন্দর ভাবেই রেখে গিয়েছেন। তারপরও আপনারা তথাকথিত ফিলোসোফাররা বলেন যে, এগুলো সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ এর বিষয় ও জড়জাগতিক বিষয় নয়, মনোজাগতিক বিষয়। হ্যাঁ, আমিও এই কথাই বলি যে এগুলো মনোজগতের বিষয়, যখন মনোজগতে এই সকল জড়জাগতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় তখন সকলে সেই নিত্য, শুদ্ধ, পবিত্র, নিরঞ্জন, নির্মল, সর্বব্যাপক পরমেশ্বরেরই স্মরণ নেয়, কোন জড় জাগতিক মূর্তির নয়। তখন সেই সকল জড়জাগতিক মূর্তি বা প্রতিমা বিকল হয়ে যায়, যা কিনা স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় প্রাথমিক সোপান ছিল মাত্র। কিন্তু আপনারা কথিত ফিলোসোফাররা নিত্য, শুদ্ধ, পবিত্র, নিরঞ্জন, নির্মল, সর্বব্যাপক পরমেশ্বরেকে নির্বুদ্ধিতার কারণে জড়জাগতিক মূর্তি বা প্রতিমা বা প্রতিকের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখে দিতে চান আজীবন। তারাপরও সত্যকে স্বীকার করেন না যে, এই সকল জড়জাগতিক মূর্তি বা প্রতীমা বা প্রতীকের সাহায্যে যত সাধন পদ্ধতি আছে সেগুলো সবগুলোই প্রাথমিক স্তরে সাধনার সাহায্যের জন্য অনেকে ব্যবহার করে। কেননা এতে ধর্ম ব্যবসা যে চলে ভালো ভাবে, সুনাম যে অর্জন করা যায় তাড়াতাড়ি। অথচ সনাতন ধর্ম ও দর্শনে এর চেয়েও অতি উত্তম পন্থা আছে বটে। যেগুলো অনুসরণ করলে হিন্দু সমাজকে আর যাই হোক হীনমন্যতায় ভুগতে হবে না, নানা রকম আপত্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। তাই কাজ যেহেতু সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ে হিতেই করতে চাইছেন, সেহেতু একটু সঠিক বিচার বিবেচনা ও মোহ মুক্ত হয়ে কাজ করলেই কিন্তু সমগ্র হিন্দু সমাজেরই মঙ্গল হয় বৈকি।
আমরা আমাদের বেশ কিছু ভালোগুণ ও অনবদ্য সামাজিক ব্যবস্থা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের বিরাট স্বপ্ন ছিল। নিজেদের ওপর, নিজেদের কর্মদক্ষতার ওপর প্রচন্ড আস্থা ছিল। আরেকটি অসাধারণ গুণ নির্ভীকতা, আমরা হারিয়েছি। আমাদের সব মহৎগুণগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। আমরা এতই সুব্যবস্থিত ছিলাম যে, পার্থিব কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক কল্যাণের দিকেও দৃষ্টি রাখা হত। কুশল ব্যবস্থাপনা অন্যেরা আমাদের থেকে ধার নিয়েছিল। দুর্ভাগ্য বশত আমরা কলাকৌশল হারিয়ে ফেলেছি। এখন ব্যক্তিত্বের ঘোরপ্যাঁচ ছেড়ে আমাদের আচরণের মাধ্যমে আমাদের সমাজকে একত্রিত করতে হবে এবং আমাদের স্বীয় গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে।
নমস্কার 🙏
✍️ আর্য প্রতিনিধি সভা বাংলাদেশ ✍️
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................