দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাঙালি মুসলমানের গৌরবময় অধ্যায় (পর্ব ৩):
--------------------------------------------------------------------------
মুসলিম লীগের আরেক নেতা এবং পাকিস্তান আদায়ের এক বলিষ্ঠ নায়ক এ. কে. ফজলুল হক, কলকাতায় তার ঝাউতলা রোডের বাড়ি বিক্রি করার জন্য কোলকাতায় অবস্থান করছিলো। হিন্দুদের উপর মার এবং লুঠপাট তো শুরু করতে হবে, কিন্তু এর জন্য তো একটা ইস্যু দরকার। বরিশাল শহরে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হলো যে, কলকাতায় হক সাহেবকে হিন্দুরা খুন করে ফেলেছে!
যে মুসলমানরা রং মাখানো কাপড়কে স্তন কাটা রক্ত ধরে নিয়ে ঢাকা এবং তার আশে পাশের শহরে হাজার হাজার হিন্দুকে খুন করতে পারে, তাদের সম্পত্তি লুঠ করতে পারে, বাড়ি-ঘর দোকানে আগুন দিতে পারে, মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারে, সেই মুসলমানদের কাছে হক সাহেব বেঁচে আছে, না সত্যিই মারা গেছে, তার সঠিক তথ্যের তো কোনো দরকার পরে কি? তাই শুরু হয়ে গেলো বর্তমানের বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালি ও পিরোজপুর, বরগুনা জেলায় খুন-ধর্ষণ-অগ্নি সংযোগ এবং এর সাথে লুঠপাট। এই চার জেলায় খুন করা হলো প্রায় ৭ হাজার হিন্দুকে। এর সাথে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুঠপাটের বিষয়টি স্বাভাবিক ধারায় চললো!
বরিশালের সাথে সাথে তা আবারও সম্প্রসারিত হলো কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালি, সিলেট, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর জেলায়। এই সবগুলো জেলা মিলিয়ে ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারি মাসেই খুন করা হলো হাজার হাজার হিন্দুকে!
বাড়ি বিক্রি করা বন্ধ রেখে ফজলুল হক, তড়ি ঘড়ি করে বরিশাল ফিরে এবং শহরে ও তার আশে পাশে ১৬ টি জায়গায় জনসভা করে বললো: "তোমরা দেইখ্যা যাও, আমি মরি নাই। কিন্তু তোমরা এইটা কী করলা?" কিন্তু কে শোনে কার কথা? জিহাদের সময় মুসলমানদের কাছে কোরান পোড়ানোও ফরজ!! ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় কোরান পোড়ানোর সময় এই যুক্তিই দিয়েছিলো!!
ফজলুল হকের কথা শুনে এ্যাকশন বন্ধ করা দূরের থাক, হিন্দুদের মেরে লুঠের মাল হস্তগত করা মুসলমানদের কাছে বেশি জরুরী হয়ে পরলো !! ফজলুল হক স্বশরীরে বরিশালে উপস্থিত হয়েও হিন্দুদেরকে হত্যা করা থেকে মুসলমানদের নিরস্তর করতে পারে নি! এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, হক ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির একজন একনিষ্ঠ সমর্থক, যে পাকিস্তানের জন্যই হিন্দুদের এত রক্ত ঝরিয়েছিলো মুসলমানরা!! ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ফজলুল হকই প্রথম পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলে এবং সে ছিলো ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর, একজন নীরব সমর্থক ! ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির ঘটনায় যে দু' চারজন মুসলমানকে এ্যারেস্ট করা হয়েছিলো, ফজলুল হক তাদেরকে ছেড়ে দেবার সুপারিশ পর্যন্ত করেছিলো!!
বরিশালের এই সংবাদ পেয়ে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ঢাকা থেকে বরিশাল গেলো । সেখানাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তার লেখা:
"ইং ২০ ফেব্রুয়ারি, (১৯৫০) আমি বরিশাল পৌঁছলাম এবং সেখানকার দাঙ্গার ঘটনাবলী শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই জেলার শহরে প্রচুর হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক হিন্দুকে খুন করা হয়েছে। এই জেলার প্রত্যেকটা দাঙ্গা-বিধস্ত এলাকা আমি পরিদর্শন করি। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, কী করে জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল পরিধির মধ্যে মোটর রাস্তা দ্বারা কাশীপুর মাধব পাশা এবং লাখুটিয়ার মতো স্থানেও মুসলিম দাঙ্গাবাজরা বিভৎস তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারে। মাধব পাশার জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা ও ৪০ জনকে আহত করা হয়। মুলাদী নামক একটি স্থানে নরকের বিভীষিকা নামিয়ে আনা হয়। একমাত্র মুলাদীতেই ৩০০ জনের বেশি লোককে খুন করা হয়েছে। মুলাদী গ্রাম পরিদর্শন কালে আমি স্থানে স্থানে মৃত ব্যাক্তিদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। দেখলাম নদীর ধারে কুকুর-শকুনেরা মৃতদেহগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমি জানতে পারলাম, সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে পাইকারি হারে খুন করার পর- সব যুবতী নারীকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। রাজাপুর থানার অন্তর্গত কৈবর্তখালি গ্রামে ৬৩ জনকে একদিনে হত্যা করা হয়। ঐ থানা অফিসের কাছেই অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলি লুট করে জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে কেটে ফেলা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সমস্ত হিন্দুর দোকান প্রথমে লুঠ করে পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিস্তারিত বিবরণ যা এসেছে, তা থেকে খুব কম করে ধরলেও একমাত্র বরিশাল জেলাতেই খুন করা হয়েছে ১০ হাজার হিন্দুকে। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের দাঙ্গার বলির সংখ্যা মোট ৫০ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। গভীর দুঃখে আমি কাতর হয়ে পড়লাম। প্রিয়-পরিজন হারানো, স্বজন হারানো নারী-পুরুষ ও শিশুদের সব হারানো কান্না-বেদনা-বিলাপে আমার ভগ্ন হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, "ইসলামের নামে কী আসছে পাকিস্তানে?"
(চলবে....................)
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................