অর্মত্য সেনের আত্মজীবনী।

অর্মত্য সেনের আত্মজীবনী প্রথম আলো অংশ বিশেষ ধারাবাহিক প্রকাশ করছে। তাতে অর্মত্য সেনের বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য কাল্পনিক মনগড়া। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তিনি যা বলছেন সে বিষয়ে উনার বাস্তব কোন ধারণা নেই। তিনি বই পড়ে, গবেষকদের লেখা পড়ে সেসব লিখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার যে সুখ্যাতি করেছেন সেখানেই উনার সত্যতা ভীষণ মার খেয়েছে। কারণ বাংলাদেশের ৭২ সালের সংবিধান ও তত্পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেভাবে মুসলিম উম্মার ছায়ায় চলে যায় অর্মত্য সেন কেন সেটা দেখতে পেলেন না? এখানে স্বাধীনতার পর প্রগতিশীলদের ‘বাঙালী মুসলমান’ জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থিদের ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ হিন্দু বৌদ্ধদেরই নয় আদিবাসী পাহাড়ীদের নিজ দেশে পরবাসী করে তুলেছে। অর্মত্য সেন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে যা বলেছেন তা আজগুবি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাইরে থেকে উনারা যে চোখে দেখেছেন সেটিও সত্য নয়। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষা বা বাঙালী জাতীয়তাবোধ থেকে ঘটেনি, সেটি ঘটেছিলো চাকরি বাকরিতে নিজেদের বঞ্চিত হবার ভয় থেকে। বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন উমার নিজে ভাষা আন্দোলনকে চাকরি বাকরি হারানো ভয় থেকে দানা বাধার কথাই বলেছেন। এমনকি দেশভাগের পর রেলের হিন্দু শ্রমিকদের ভারতে চলে যাবার পর বস্তুত বাংলাদেশের বাম রাজনীতির শক্তি খর্ব হবার কথাও তিনি জানান। এখানকার মুসলিমদের অর্মত্য সেন যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ বলতে চেয়েছেন তাতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বাম রাজনীতির শক্তি খর্ব হওয়াটা মেলানো যায় না।

ব্রিটিশরাই সাম্প্রদায়িক হিংসার সূচনা করেছিলো অর্মত্য সেনের এই বক্তব্যও বিতর্কিত। ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করেছে ঠিকই কিন্তু তারা চিরকাল ধর্মের পরিচয়েই নিজেদের জাতি পরিচয় দিয়েছে। ভারতের বাঙালী গুজরাটি পাঞ্জাবী যে অঞ্চলের মুসলমানই হোক নিজেদের তারা মুসলমান জাতি পরিচয়ই দিয়েছে। হিন্দুরাও জেনে এসেছে মুসলমানরা ‘তাদের দেশ’ দখল করেছে। সেই দেশ আবার ইংরেজরা দখল করেছে। ফলে ইংরেজ শাসনের প্রখম একশ বছর হিন্দুরা ইংরেজ শাসনকে এক প্রকার আশির্বাদই মনে করেছে। রামমোহন তো বলেই গেছেন ইংরেজ শাসন আরো অধিকাল থাকার পর ভারতের স্বাধীনতার চেষ্টার কথা বলেছিলেন। এবং ইংরেজ শাসনের প্রথম একশ বছরের মধ্যে বিভিন্ন মুসলিম ধর্মীয় নেতার নেতৃত্বে যতগুলো ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন ঘটেছে তার সবগুলোই মুসলমানদের ‘কেড়ে নেয়া দেশ’ উদ্ধার চেতনা থেকে। এগুলোকে হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই সামাজিক অবস্থা বলে?

অর্মত্য সেন জামিদার প্রথার সম্পর্কে যা বলেছেন সেটি খুবই সত্য। হিন্দু জমিদার কৃষক প্রজাদের উপর যে শোষণ চালিয়েছে সেই ক্ষোভকে পরবর্তীকালে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা দেশভাগের জন্য দ্বিজাতিতত্ত্ব গড়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অর্মত্য সেন যেভাবে হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই ছিলো ইংরেজ আসার আগে সেরকম রূপকথার কোন অস্তিত্বই নেই। হিন্দু মুসলমান উভয়েই ছিলো খুবই সাম্প্রদায়িক জাতি চেতনার, ছিলো ধর্মান্তরের ইতিহাস, ছিলো জাতমারার ইতিহাস, সেকালের সাহিত্যগুলোতে সেকথাই প্রকাশ পায়। অর্মত্য সেন বামপন্থি ঐতিহাসিকদের হিন্দু মুসলমান দুই ভাইকে ইংরেজ আসিয়া ভুল বুঝাইয়া ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাধাই দিলো’ ইতিহাসগুলোই গ্রহণ করে কথা বলেছেন। মুসলিম শাসনে হিন্দুদের রাজ দরবারে চাকরি পাওয়া, সৈন্যদলে হিন্দু সৈনিক, প্রশাসনে হিন্দু প্রশাসক নিশ্চিত করে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু এটি কোনভাবেই ভারতবর্ষের সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করে না। নিজেদের ক্ষমতাকে পাকা করতে ও উত্তরাধিকারদের দুর্বল করতে স্থানীয়দের দরবারে স্থান দেয়া এবং মুঘল বা সুলতানী আমলের শাসকদের রাজনীতিতেই মনোযোগ ছিলো, তারা এখানে ধর্ম প্রচার করতে আসেননি। রাজনীতির কারণেই স্থানীয় হিন্দুদের দলে টানতে হয়েছে। একইসঙ্গে খান জাহান আলীর মত প্রশাসক কিভাবে ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তর করে ‘পীরালী বামুন’ নামে এক অভিশপ্ত ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছিলেন সে ইতিহাস তো অর্মত্য সেনের না জানার কথা নয়।

এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলমান দুটোই জঘন্ন সাম্প্রদায়িক চেতনার ছিলো সেটি ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিলো। সেকারণেই তারা ধর্মের কার্ড খেলেছিলো। বারুদ মজুদ ছিলো শুধু দেশলাইটা জ্বেলে দেয়া মানে কি দেশলাইয়ের কেবল দোষ? সিপাহী বিপ্লব গরু ও শুকোরে চর্বির মাখানো কার্তুজ দিয়ে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের সৈন্যদের “জাত মারার” ষড়যন্ত্র গুজব থেকে যে বিপ্লব ঘটে সেই দেশের জনমানসের সাম্প্রদায়িক স্পীড কি বুঝা যায় না?

স্বাভাবিকভাবেই অর্মত্য সেনের আত্মজীবনী বাংলাদেশের মডারেট মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের খুব পছন্দ হয়েছে। খুবই শ্রীঘ্রই এই বই বাংলায় অনুবাদ করে শিবির তাদের অনলাইন লাইব্রেরিতে পিডিএফ করে রেখে দিবে হয়ত।

-সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted