ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মবার্ষিকী গেলো। জিসি দেব, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদাপ্রসাদ সাহা, যোগের মন্ডল লাহোর প্রস্তাব শুনেও শেরেবাংলাদের বিশ্বাস করেছিলেন। এদের মধ্যে যোগেন মন্ডল লাকি যে তিনি পশ্চিমবঙ্গ পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। আমার বলতে আর দ্বিধা নেই "ই স লা মী খি লা ফ ত" চায় "উগ্র মু স ল মা ন" তো লাহোর প্রস্তাব দিয়েছিল "সুগ্র মু স ল মা ন"।
আপনি যদি বাংলাদেশের চরিত্র সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চান তাহলে আমি আপনাদের দুটি ঘটনা সম্পর্কে বলব, একটা হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে প্রথম যিনি পার্লামেন্টে দাবী তুলেছিলেন সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যাকে একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছিলো, তার বাড়িটি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে আজো দখল। দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক জিসি দেব (গোবিন্দচন্দ্র দেব) যাকে ২৫ মার্চ প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনী টার্গেট করে হত্যা করেছিলো তার সিলেট ও ঢাকার বাড়িটিও “শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে দখল হয়ে আছে। শত্রু সম্পত্তি আইন পাকিস্তানীরা করেছিলো মানলাম, কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর তখনকার সরকার কি করে সেই আইনের নাম পরিবর্তন করে “অর্পিত আইন’ করে রেখে দিলো? বিস্ময়কর যে এই দুই বিরাট ব্যক্তিত্বকে ‘শত্রু’ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়েছে কারণ তাদের বাড়িকে এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে দখল আছে। কেন স্বাধীন বাংলাদেশ ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইনটিকে রেখে দিলো?
জিসি দেব কে সেটি বহির্বিশ্ব চিনেছিলো। তাই আমেরিকাতে তার নামে ‘জিসি দেব ফাউন্ডেশন’ গঠন হয়েছিলো। কিন্তু ‘বাংলাদেশ’ নামের স্বাধীন দেশটি জিসি দেবকে ধারণ করে না। পাকিস্তান নামের দেশটিও ধারণ করত না। পাকিস্তান সরকার জিসি দেবকে ১৯৬৫ সালে ভারতের চর’ হিসেবে গ্রেফতার করেছিলো। তাকে পাকিস্তানের মু স লি ম জাতীয়তাবাদের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে দেখা হত। জিসি দেব দেশভাগের সময় বাংলাদেশের দিনাজপুরে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটি তার জন্যই মারাত্মক ভুল ছিলো বলব না, এটি ছিলো দর্শনের ইতিহাসে একটি চরম ভুল। কারণ বিবেকানন্দের পর আমেরিকার যে মানুষটির দর্শনকে গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়েছিলো তিনি জিসি দেব। জিসি দেবের সমস্ত পান্ডুলিপির কোন হদিস নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিসি দেবের বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখায়নি। আমেরিকায় তার ছাত্র ও শিষ্যের বরংবার চিঠি দেয়ার পরও স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিসি দেব বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। (জিসি দেবকে হত্যা, প্রথম আলো, ২৫ মার্চ, ২০২১)।
লাহোর প্রস্তাবে অন্তত দু-তিনটি মুসলিম স্ট্রেট দাবী করা হয়েছিলো। কিন্তু ‘পাকিস্তান’ নামে একটি রাষ্ট্রে জন্ম হয়েছিলো। ডক্টর আকবর আলী খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইতে বাংলাদেশের জন্মকে ‘আকস্মিক’ বলেছেন। ছয় দফার কোথাও স্বাধীন বাংলাদেশের নিশানা নেই। বলা হয় তখন পাকিস্তানের কোন সুবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা মেনে নিলে কোনদিন বাংলাদেশের জন্মই হতো না। যেহেতু তারা সেটি মেনে নেয়নি এবং সশস্ত্র হামলায় চালায় তার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চলে আসে। কিন্তু সেই বেরিয়ে আসা সেই লাহোর প্রস্তাবের যে দু্টি- তিনটি মুসলিম রাজ্যের কথা ছিলো, সেটাই বাস্তবায়ন হয়েছে। এখানে জিসি দেবের স্থান কোথায়?
অধ্যাপক আবুল বারাকাত তার বই ‘অর্পিত সম্পত্তির সাথে বসবাস’-এ দেখিয়েছেন শত্রু সম্পত্তি ওরফে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ আইনের ছায়ায় হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের প্রতিযোগীতায় মু স লি ম লীগ ৩৭%, বিএনপি ৪৫%, আওয়ামী লীগ ৩১%, জামাত ৮%, জাতীয় পার্টি ৬% দেখিয়েছেন। মানে এই দলগুলোর নেতা ও তাদের সহযোগীতায় সম্পত্তি দখলের শতাংশকে বুঝানো হয়েছে। (সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার ৪৭ বছর, সোহরাব হাসান, প্রথম আলো, ২৯ জুন, ২০১৩)।
বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকজনের লেখককের নাম হঠাৎ মনে এলো যাদের পৈতৃক ভিটা এখন ‘শত্রু সম্পত্তি’ নিশ্চিত করেই। যেমন: জীবনানন্দ দাশ (বরিশাল), প্রমথনাথ বিশী (নাটোর), ঋত্বিককুমার ঘটক (ঢাকা), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (নোয়াখালী), সন্তোষকুমার ঘোষ (ফরিদপুর), মনোজ বসু (যশোর), নরেন্দ্রনাথ মিত্র (ফরিদপুর), মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য (ঢাকা), জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী (কুমিল্লা), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ফরিদপুর)… ইত্যাদি। সাহিত্যের বাইরে সংগীত, শিল্পকলা, অভিনয়সহ সাংবাদিকতা ও রাজনীতিবিদদের পূর্ববঙ্গের নিবাস সবই এখন ‘অর্পিত সম্পত্তি’। তাদের বসতভিটাগুলো এনিমি প্রোপার্টি হিসেবেই এখন দখল নয়ত সরকারী লিজে ভোগদখল হচ্ছে। ইতিহাস খন্ডন করা যায় না সত্য। তবে অতিতের লজ্জ্বা ও ভুলের সন্মানজনক প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে কুখ্যাত আইনটি বাতিল হলে অতিতের ক্ষত চিহ্ন মুছে যেত। নিজ দেশের কীর্তিমানদের প্রতি এতখানি বিমাতাসূলভ আচরণ করা হতো না। কিন্তু দেশভাগের পরও যারা বাংলাদেশের রয়ে গেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার, বাংলা ভাষার জন্য যিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভিটা কি করে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে আজো দখল হয়ে থাকে? কেন জিসি দেবকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে না? কারণ জিসি দেব এক নয়া দর্শন প্রচার শুরু করেছিলেন। অভিন্ন ধর্মমতবাদ। সে মতবাদ তো মু স লি ম ব্রাদারহুডকে পরাস্ত করবে। তাইলে কি বা ল ফেলতে দেশ স্বাধীন হইছিলো যদি জিসি দেবই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধান দার্শনিক হবে? তাহলে বাঙালী মু স ল মা ন-এর নিজস্বতা কি করে প্রকাশিত হবে?
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................