নির্বোধ বাঙালি হিন্দুর,
কবে জাতিগত চৈতন্য হবে?
বিশ্ব উদ্ধারের অলিক বাস্তবতায় হুজুগে উন্মাদ হয়ে জাতিগতভাবে বাঙালি হিন্দুরা অনেক ক্ষেত্রেই আজ নিজভূমে পরবাসী। তারা যদি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দেখানো পথে, 'ব্রহ্মচারী এবং সাপের গল্পে'র মতো ফোসফাস করতে শিখতো বা 'পাগলা হাতির গল্পের' মতো আশেপাশের পাগলা হাতিদের চিনে তাদের থেকে দূরত্বে থাকতো; তাহলে তারা জাতিগতভাবে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকতো। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কথামৃতে বলেছেন, "ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। তবে ভাল লোকের সঙ্গে মাখামাখি চলে; মন্দ লোকের কাছ থেকে তফাত থাকতে হয়। বাঘের ভিতরেও নারায়ণ আছেন; তা বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা চলে না।"
বিষয়টি আরো গভিরভাবে বুঝাতে তিনি পরপর দুটি গল্প বলেছেন। প্রথমটি 'পাগলা হাতির' এবং পরেরটি 'ব্রহ্মচারী এবং সাপের'। আমরা কথামৃত থেকে প্রথম গল্পটি উল্লেখ করছি। তাহলে সকলেই আশাকরি বুঝতে পারবেন আমাদের আশেপাশের দুর্জন পাগলা হাতিদের সম্পর্কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মনোভাব কি ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষায়:
“একটা গল্প শোন্। কোন এক বনে একটি সাধু থাকেন। তাঁর অনেকগুলি শিষ্য। তিনি একদিন শিষ্যদের উপদেশ দিলেন যে, সর্বভূতে নারায়ণ আছেন, এইটি জেনে সকলকে নমস্কার করবে। একদিন একটি শিষ্য হোমের জন্য কাঠ আনতে বনে গিছল। এমন সময়ে একটা রব উঠল, ‘কে কোথায় আছ পালাও —একটা পাগলা হাতি যাচ্ছে।’ সবাই পালিয়ে গেল, কিন্তু শিষ্যটি পালাল না! সে জানে যে, হাতিও যে নারায়ণ তবে কেন পালাব? এই বলিয়া দাঁড়িয়ে রইল। নমস্কার করে স্তবস্তুতি করতে লাগল। এদিকে মাহুত চেঁচিয়ে বলছে ‘পালাও, পালাও’; শিষ্যটি তবুও নড়ল না। শেষে হাতিটা শুঁড়ে করে তুলে নিয়ে তাকে একধারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল। শিষ্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে ও অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল।
এই সংবাদ পেয়ে গুরু ও অন্যান্য শিষ্যেরা তাকে আশ্রমে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। আর ঔষধ দিতে লাগল। খানিক্ষণ পরে চেতনা হলে ওকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি হাতি আসছে শুনেও কেন চলে গেলে না?’ সে বললে, ‘গুরুদেব আমায় বলে দিয়েছিলেন যে, নারায়ণই মানুষ, জীবজন্তু সব হয়েছেন। তাই আমি হাতি নারায়ণ আসছে দেখে সেখান থেকে সরে যাই নাই।’ গুরু তখন বললেন, ‘বাবা, হাতি নারায়ণ আসছিলেন বটে, তা সত্য; কিন্তু বাবা, মাহুত নারায়ণ তো তোমায় বারণ করেছিলেন। যদি সবই নারায়ণ তবে তার কথা বিশ্বাস করলে না কেন? মাহুত নারায়ণের কথাও শুনতে হয়।’
শাস্ত্রে আছে ‘অপো নারায়ণঃ’ জল নারায়ণ। কিন্তু কোন জল ঠাকুর সেবায় চলে; আবার কোন জলে আঁচানো, বাসনমাজা, কাপড়কাচা কেবল চলে; কিন্তু খাওয়া বা ঠাকুরসেবা চলে না। তেমনি সাধু, অসাধু, ভক্ত, অভক্ত — সকলেরই হৃদয়ে নারায়ণ আছেন।
কিন্তু অসাধু, অভক্ত, দুষ্ট লোকের সঙ্গে ব্যবহার চলে না। মাখামাখি চলে না। কারও সঙ্গে কেবল মুখের আলাপ পর্যন্ত চলে, আবার কারও সঙ্গে তাও চলে না। ওইরূপ লোকের কাছ থেকে তফাতে থাকতে হয়।”
সকল মানবকেই বুকে জড়িয়ে ধরতে যেয়ে আজ আমাদের নিজেদের বুকই ছারখার হয়ে যাচ্ছে । আমরা যতই শান্তির বাণী নিয়ে দস্যুদের কাছে যাচ্ছি, দস্যু প্রকৃতির আততায়ীরা ততই দস্যুতর-দস্যুতম হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সাধুসজ্জন এবং আততায়ীদের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধানকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা।শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়তেইই আততায়ী শব্দটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ধর্মশাস্ত্রে আততায়ী ঘৃণ্য এবং নৃশংস হওয়ার কারণে শাস্তির যোগ্য। স্মৃতি শাস্ত্রেও আততায়ীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তাদের প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে। বশিষ্ঠ সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে আততায়ী সম্পর্কে বলা হয়েছে:
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ।
ক্ষেত্রদারহরশ্চৈব ষড়েত আততায়িনঃ।।
আততায়িনমায়ান্তমপি বাদান্তপারগম্
জিঘাংসন্তং জিঘাসিয়ান্ন তেন ব্রহ্মহা ভবেৎ।।
স্বাধ্যায়িনং কুলে জাতং যো হন্যাদাততায়িনম্।
ন তেন ভ্রণহা স স্যান্মন্যুস্তন্মন্যুমৃচ্ছতি।।
(বশিষ্ঠ সংহিতা: তৃতীয় অধ্যায়)
"যে ঘরে আগুন দেয়; খাবারে বিষ প্রয়োগ করে; ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যা করতে উদ্যত হয় বা করে; অন্যের ধনসম্পদ যে জোর করে অপহরণ করে; অন্যের ক্ষেতখামার বা জমিজমা যে দখল করে এবং ঘরের স্ত্রীদের অপহরণকারী; এছয় প্রকার দুষ্কৃতিকারীকে আততায়ী বলা হয়।
এ ছয় প্রকার আততায়ী যদি বেদান্ত পারগ মহাজ্ঞানী ব্যক্তিও হয়, তবে হননেচ্ছু সেই ব্যক্তিকে বধ করবে। আততায়ীকে বধ করলেও ব্রহ্মঘাতকের পাপ তাকে স্পর্শ করবে না।
স্বাধ্যায়-সম্পন্ন সংকুলজাত ব্যক্তিও যদি আততায়ী হয়, তবে তাকেও বধ করবে। এতে ঘাতক ব্রহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হবে না। কেননা, আক্রান্তের ক্রোধাভিমানিনী দেবতা আততায়ীর ক্রোধকে নিবর্ত্তিত করে।"
আমাদের আশেপাশের নিষ্ঠুর, নৃশংস আততায়ীদের না চিনতে পেরে তাদের কাছে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় সাম্য, মৈত্রী, প্রেম বিতরণ একটি অত্যন্ত অপরিণামদর্শীতার লক্ষণ। ফলে প্রতিনিয়তই জাতিগতভাবে প্রতারিত হচ্ছে, ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে সম্প্রদায়। এ ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে মুক্তির জন্যে, জানিনা কবে কিছু নির্বোধ বাঙালি হিন্দুর জাতি গঠন এবং জাতি রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে চৈতন্য হবে? যথাযথ কাণ্ডজ্ঞান বা চৈতন্যের অভাবেই বাঙালি হিন্দুর জীবনে রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা, অদূরদর্শিতা, অপরিনামদর্শীতা আষ্ঠেপৃষ্ঠে গ্রাস করেছে। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে শিখেনি। এ কারণেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যথিত চিত্তে আআত্মসমালোচনার সুরে লিখেছেন :
"সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।"
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................