ইরানের মত সমৃদ্ধ সংস্কৃতিও সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে রিলেজিয়নের কাছে।

সুপ্রিয় বন্ধুগণ, অনুগ্রহপূর্বক আর্টিকেলটি পড়বার সবিশেষ অনুরোধ রইলো।

এই অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম আসার আগে, তারও আগে ইসলাম ধর্ম আসার আগে, তারও আগে বৌদ্ধধর্ম জন্ম নেয়ার আগে তো প্রায় সব বাঙালিই হিন্দু ছিল। তারা একই সাথে বাঙালি এবং হিন্দু। সংস্কৃতি তো একই। এই সংস্কৃতিকে আপনি বাঙালি বলবেন নাকি হিন্দুয়ানি বলবেন সেটা আপনার বিবেচনার ব্যাপার।

আমি বাঙালি ও হিন্দুয়ানি দুইটাই বলতে পারি। আমার বিবেচনায় হিন্দুয়ানিও কালচার, রিলিজিয়ন না। হিন্দুধর্ম নামে সমাজে যা আছে সেটা বহু নদীর পানি এসে মেশা একটা সমুদ্র।

আর্যদের যজ্ঞনির্ভর ধর্মাচার আর বহু বহু লৌকিক অলৌকিক বিশ্বাস আর জীবনাচার মিলে হিন্দু ধর্মের রূপ নিয়েছে। হিন্দু ধর্ম একেবারেই রেজিমেন্টেড ধর্ম না। উদাহরণ দেই- 
বাংলায় সবচেয়ে বেশি ভক্ত ও ভক্তি পাওয়া দেবীর নাম দুর্গা। অথচ জয় শ্রীরামের রমরমা বাজারেও ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যের মানুষের দেবী দুর্গারে নিয়ে মাথাব্যথা নাই।

আমার মামা বাড়ি হাওরাঞ্চলে। সাপের উপদ্রব। মনসা দেবী তাই খুবই প্রতাপশালী। উজানে যেখানে সাপ কম, মনসার কদরও কম।

পঞ্চাশ বছর আগে বসন্ত রোগের দেবী শীতলার হেভি পাত্তা ছিল, এখন বসন্ত কম। শীতলারও আর সেই দিন নাই। 

একটা রেজিমেন্টেড ধর্মের এই বৈচিত্র‍্য থাকে না। 
আবার ধরেন কৃষ্ণ, মহাভারতের চরিত্র। ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত এই মহাকাব্যে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। কিন্তু মহাভারতে রাধা নাই। 
রাধা আছেন এই দেশের মানুষের মনে। ভগবানকে মানুষ আপন করে গোপাল করে নিয়েছে, গোপাল ননী চুরি করে, মাঠে গরু রাখতে যায়, বাঁশি বাজায়, রাধার সাথে পিরিতি করে; এই ভগবানকে নিয়ে তাই বলা যায়, কদম ডালে বইসা আছে কানু হারামজাদা। 
হিন্দু ভাই ও বোনরা, মাইরেন না। হিন্দু ধর্ম বলতে যা চলে তার অন্তত পনেরো আনা কালচার, সংস্কৃতি। 
হিন্দু কাদের বলা হত? যারা যজ্ঞ করে? মূর্তিপূজা করে? এইসব? না তো, একটা নির্দিষ্ট এলাকার মানুষকে হিন্দু বলা হত। এর সাথে ভূখণ্ডের সম্পর্ক আছে। সংস্কৃতির সম্পর্ক আছে। ধর্মের বিশেষ নাই। এই কারণে মূর্তিবর্জিত হোম-যজ্ঞও হিন্দুয়ানি আবার প্রতিমা পূজাও হিন্দুয়ানি।

এইভাবে বাঙালি সংস্কৃতিও বাংলা ভাষায় কথা বলাদের সংস্কৃতি বলে মনে করি না। বাঙালি সংস্কৃতি বাংলায় বাস করা মানুষের সংস্কৃতি। এর ভিতরে হিন্দুয়ানি ছিল, পরে বৌদ্ধ-আনি, খ্রিস্টান-আনি, মুসলমানি ইত্যাদি ছোট বড় হাজার আনা আনি মিলে আজকের জায়গায় এসেছে। ধর্ম মানুষের জীবনে যেসব পরিবর্তন আনে সেগুলা একসময় সংস্কৃতিতে মিশে যায়, বাঙালি সংস্কৃতি সমুদ্র হলে ধর্ম গুলা নদী। কোনোটা উত্তাল যমুনা, কোনোটা ক্ষীণধারা শীতলক্ষ্যা, এই আরকি।

আমেরিকান কালচার মানে আমেরিকায় বাস করা মানুষের কালচার, বাঙালি কালচারও বাংলায় বাস করা মানুষের কালচার এইভাবে ভাবতে আগ্রহী।
_________________________
সঞ্জীবন সজীব

ধর্ম আর রিলেজিয়নের পার্থক্যের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। যতীন সরকার মনে করেন আগুনের ধর্ম হয়, বায়ুর ধর্ম হয়, জলের ধর্ম হয় আবার মানুষেরও ধর্ম হয় কিন্তু মানুষের রিলেজিয়ন হয় না। যতীন সরকারের ভাষায় রিলেজিয়ন হয় হিন্দুর, মুসলিমের, খ্রিস্টানের।

এই ভূখণ্ডের ধর্মের (ওয়ে অফ লাইফ) নাম অনেকে মনে করে হিন্দু। মহাভারতে কিংবা গীতায় যে ধর্মের কথা বলা আছে সেটা ন্যায় কে ধর্ম আর অন্যায় কে অধর্ম বলেছে।

এই ভূখণ্ডে রিলেজিয়ন ছিলো না। তবে ধর্ম ছিলো, একটা জীবন পদ্ধতি ছিলো। কোন ঈশ্বরে ভক্তি থাকা কিংবা ঈশ্বরে বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর এই ধর্ম নির্ভর করতো না। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর একেশ্বর বাদের যুক্তি এবং গুছানো কাঠামোর চ্যালেঞ্জ হিন্দু ধর্মকে অনেকটা রিলেজিয়নে রূপ দিয়েছে।

স্ট্রাকচারাল রিলেজিয়নের সাথে সংস্কৃতির সংঘর্ষ সবসময়। এভাবে পৃথিবী থেকে অসংখ্য সভ্যতা সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। ইরানের মত সমৃদ্ধ সংস্কৃতিও সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে রিলেজিয়নের কাছে। অনেক পরিবর্তন বিরোধের মাঝেও বাংলাদেশে বাঙালি কিংবা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি যতটুকু টিকে আছে সেটা সম্ভবত পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে সংঘর্ষের কারণে।

(সংগৃহীত, Shadat Shamim এর পেইজ থেকে)

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted