তুমি টিপ দিয়েছো কেন? তুমি কী হিন্দু?

লেখা : Sonam Saha

বছর চারেক আগে খুব কাছের একজনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার পরণে ছিলো শাড়ি এবং যথারীতি কপালে একটা ছোট টিপ৷ তাদের ছোট মেয়েটা, যে কীনা আমার খুব ন্যাওটা, সে আমার কপালে হাত রেখে নিষ্পাপ বিষ্ময় নিয়ে বললো, "তুমি টিপ দিয়েছো কেন? তুমি কী হিন্দু?"

আমি ওর প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গিয়ে উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই শুনলাম পাশে থেকে আমার জীবনসঙ্গী ওকে জিজ্ঞেস করছে, "কেন হিন্দু হলে কী হয়?" 

ছোট্ট বাচ্চাটা আরো মরিয়া হয়ে উত্তর দিলো, "হিন্দুরা টিপ পরে, হিন্দুরা খারাপ হয়, বাবা বলেছে!" 

আমার সঙ্গী ভদ্রলোককে দেখলাম নিজেকে সামলে নিয়ে বাচ্চা মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে টিপ সব বাঙালিই পরে, সব মানুষই ভালো; ইত্যাদি। আর এদিকে আমার কানে বাজতে লাগলো, "বাবা বলেছে!" শব্দ দুটো৷ 



সেইদিন অব্দি এই মেয়েটার বাবাকে আমি বড় ভাই জ্ঞান করতাম। মানুষটা আদতে ভালোমানুষই; সজ্জন, সদালাপী, আন্তরিক। আমার সাথে তার সম্পর্কও মধুর। আপদেবিপদে এক ডাকে দৌড়েও আসেন আমার জন্য৷ তবু এই মানুষটাই তার মেয়েকে শিখিয়েছেন "হিন্দুরা'ই' শুধু টিপ পরে! 'হিন্দু'রা খারাপ হয়!" তার ছোট্ট মেয়ে, যার জীবনের লক্ষ্য বড় হয়ে বাবার মতো ম্যাজিক দেখানো, সে এখন থেকেই শিখে গেলো তার চেয়ে ভিন্ন যারা তারা খারাপ! তারা যা যা করে সবই খারাপ! 

বছর তিনেক আগের সেই ঘটনাটা আমাকে বাংলাদেশের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির শুভংকরের ফাঁকিটা ধরিয়ে দিয়েছে। সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের সাথে মিলেমিশে চলাটা এই দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সেটা আমাদের অভ্যাসে, চর্চায় রয়ে গেছে। কিন্তু সেই সাথে আমরা ধর্মীয় শিক্ষা নিচ্ছি বাছবিচারহীন নানা রকম অনিয়ন্ত্রিত মাধ্যম থেকে, যেখানে আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে, "তুমিই শ্রেষ্ঠ আর বাকিরা সব নিকৃষ্ট"। শহর জুড়ে লাগানো হাই ভলিউম মাইক জানিয়ে দিচ্ছে এতোদিন যা যা করে এসেছো তার সবই হারাম, সব বাদ দিতে হবে। মোবাইলের স্ক্রীন মুখের উপর এসে বলে যাচ্ছে, "বাঙালিয়ানা বলে কিছু নেই। সবই হিন্দুয়ানি। এইসব কিছু বাদ দিয়ে 'সহি' হয়ে উঠতে হবে৷" যত দিন যাচ্ছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় এইজাতীয় উগ্র জ্ঞানকে ডালপালা মেলে বাড়ছে, "সহি" না হয়ে বাঙালিই থাকতে চাচ্ছে যে তার উপর খড়গ নামছে। সহিষ্ণুতার চর্চা অপসৃত হচ্ছে অসহিষ্ণুতার বয়ানে৷ গতকালও যে মানুষ প্রতিবেশীকে শুধু প্রতিবেশিই ভেবেছে, আজ সে মানুষের কাছে প্রতিবেশী মানে ভিনধর্মী, ভিনজাতি৷ ছোটবেলায় যে ভাই নিজেই বোনকে সাথে নিয়ে মেলা থেকে টিপের পাতা কিনে দিয়েছে, আজ সে তার নিজের মেয়েকে সবক দিচ্ছে, "টিপ পরলে পাপ হয়"! 

আপনারা খেয়াল করেছেন কী না জানিনা, আমার ছিদ্রান্বেষী মন অনেক দিন ধরেই দেখে এসেছে অনেক বাঙালি চর্চাই এখন আর এদেশে হচ্ছেনা, এবং সেটা শুধু মেয়েদের কপালের টিপে সীমাবদ্ধ নয়। এলাকার গানের দল,যাত্রাপালা, বৈশাখী মেলা, বাউলের আখড়া সব কিছুতেই থাবা বসেছে৷ বিয়েতে এখন আর কণেচন্দন পরা দেখাই যায়না। পাঁচ বছর আগেও যে মানুষটা হিন্দু প্রতিবেশীর পূজার নাড়ু খেতেন তিনি এখন আর তা খান না। দশ বছর আগেও ভিন্নধর্মী প্রতিবেশীর বাড়িতে ইফতার ও ঈদের দাওয়াত যেতো, এখন তা আশংকাজনক হারে কমে গেছে, আর বেড়ে গেছে নিজের দলে টেনে আনার জন্য অন্য রকম "দাওয়াত" পাঠাবার হার; সভ্য ও অসভ্য উভয় প্রকারে৷ 

পা কি স্তা নি রা বাঙালিয়ানার সকল কিছুকেই হিন্দুয়ানি ভাবতো। বাঙালির বসন, বাঙালি মেয়ের হাতের পলা- কপালের টিপ-চুলের খোপা কিংবা বাঙালির কবিতা-নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্র এবং বাঙালির ইতিহাস; সবকিছুর গায়েই "অসহি" ট্যাগ লেগেছে৷ দেশ স্বাধীন হয়েছে পঞ্চাশ বছর হয়েছে, পার্থক্য শুধু এই যে আগে পাকিস্তানিরা বাঙালিত্বকে হিন্দুয়ানি বলতো আর এখন বাঙালি নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় এর মাঝে তথাকথিত হিন্দুয়ানির অবিচ্ছিন্ন চিহ্ন নিয়ে সদা বিব্রত হয়ে থাকে, চারপাশের সবাইকে নিয়ে অধিকতর অ"বাঙালি" হয়ে উঠতে চায়! পা-কি-স্তা-ন নামের চারাগাছ এখন পঁচাত্তর বছরের মহিরূহ। একটি জাতির সাংস্কৃতিক জাতিসত্ত্বার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী নয় মাসের যুদ্ধটাকে আজকাল অর্থহীন লাগে৷ 

কিন্তু, যত যাই হোক না কেন, 

"তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর; 
এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরোনা পাখা।"

বাঙালি মেয়ের কপালে "টিপ" থাকবে।।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted