সনাতন ধর্ম কেন বলছে সকল মানুষ সমান?.

সকল মানুষ সমান

নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, জাত-পাত, ভাষা, দেশ, সংস্কৃতি, সমস্ত বিভেদ পরিত্যাগ করে ঋগ্বেদের সংজ্ঞান সুক্তে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে-
‘হে মানব, তোমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলে আলোচনা কর, তোমাদের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হোক। পূর্বকালীন জ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ কর্তব্য সম্পাদন করেছেন তোমরাও সেইরূপ কর। তোমাদের সকলের মত এক হোক, মিলনভূমি এক হোক, মন এক হোক, সকলের চিত্ত সম্মিলিত হোক, তোমাদের সকলকে আমি একই মন্ত্রে অভিষিক্ত করেছি এবং তোমাদের সকলের খাদ্য ও পানীয় একই প্রকারের দিয়েছি। তোমাদের সকলের লক্ষ্য এক হোক, তোমাদের হৃদয় এক হোক, তোমাদের মন এক হোক। তোমরা সর্ব অংশে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ হও। এবং এইভাবেই তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হোক। (ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২-৪)

‘ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কেউই বড় নয়, কেউই ছোট নয়, সবাই সমান। ঈশ্বরের আশীর্বাদ সবারই জন্যে।’ (ঋগ্বেদ ৫.৬০.৫)

“ভ্রাতৃসঙ্ঘে সকল মানুষ সমান। কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়।” (যজুর্বেদ ১৬:১৫)

বিশ্বজনীন মমতার স্বাদ যে পেয়েছে, সে সকল প্রাণের মাঝেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। যে নিজেকে পরমাত্মার অংশ মনে করে, সে কখনো অন্যের দিকে অবজ্ঞাভরে তাকায় না। সে কখনো কাউকে ঘৃণা করে না। তাই ঘৃণা দুঃখ বেদনাও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। (যজুর্বেদ : ৪০:৬)

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের তের নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে:
“চাতুবর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।।” (শ্রীগীতা ৪/১৩)
“প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানবসমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এর প্রথম স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।” উপরের শ্লোক অনুসারে বর্ণবিভাগ যে জন্মানুসারে নয়, বরং কর্মানুসারে তা শতভাগ নিশ্চিত।

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের পরিচয়:
কেউ যদি শাস্ত্র অধ্যয়ন তথা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে পারদর্শী হন এবং সেভাবে জীবিকা অবলম্বন করে তবে সে ব্রাহ্মণ, পরিচালনায় দক্ষ হলে ক্ষত্রিয়, ব্যবসা বাণিজ্যে জীবিকা নির্বাহ করলে বৈশ্য এ সকল পেশার লোকদের সেবাকারীর কোনো বৃত্তি হলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবে।

ব্রাহ্মণ: ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম হলো—অন্তরিন্দ্রিয়ের অর্থাৎ মন-বুদ্ধি-অহংকার-এর সংযম(শম), বহিরিন্দ্রিয় অর্থাৎ পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়ের সংযম (দম), ধর্মপালনের জন্য কষ্ট স্বীকার করা (তপ), অন্তরে ও বাইরে পবিত্রতা (শৌচ), অপরের অপরাধ ক্ষমা করা, কায়মনোবাক্যে সরল থাকা, বেদ, শাস্ত্র, ঈশ্বর ও পরলোকে শ্রদ্ধা রাখা (আস্তিক্য), বেদাদি গ্রন্থের অধ্যয়ন-অধ্যাপন করা (জ্ঞান) এবং পরমাত্মতত্ত্ব অনুভব করা (বিজ্ঞান)। [এই নয়টি কর্ম যিনি করেন তিনিই ব্রাহ্মণ] (শ্রীগীতা ১৮/৪২)

ক্ষত্রিয়: শৌর্য বা পরাক্রমশীলতা, তেজ, ধৈর্য, দক্ষতা, যুদ্ধ হতে পলায়ন না করা, দান করা এবং শাসন ক্ষমতা—এগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম। (শ্রীগীতা ১৮/৪৩)

বৈশ্য: কৃষিকাজ, গবাদিপশু পালন ও বাণিজ্য যিনি করেন তিনি বৈশ্য। (শ্রীগীতা ১৮/৪৪)

শূদ্র: যিনি সকলের পরিচর্যা বা সেবাপ্রদানমূলক কর্ম করেন তিনিই শূদ্র। (১৮/৪৪)

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের আঠারোতম শ্লোক বলছে, “ব্রহ্মজ্ঞানিগণ বিদ্যা ও বিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণে ও চণ্ডালে এবং গোরু, হাতি ও কুকুরেও সমদর্শী হন। (জ্ঞানী ব্যক্তি উঁচু-নিচু, শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্ট কোন বৈষম্য দেখেন না। প্রকৃতপক্ষে সবাই সমান।)”

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের বত্রিশতম শ্লোকে বলছে, “হে অর্জুন, যিনি সর্বত্র সমদর্শী হয়ে সকল জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখ বলে অনুভব করেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।”

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৫তম শ্লোক বলছে, ‘হে অর্জুন, এই জ্ঞান প্রাপ্ত হলে তুমি আর মোহগ্রস্থ হবে না। এই জ্ঞানের দ্বারা তুমি সমস্ত ভূতকে প্রথমে নিজের মধ্যে এবং পরে পরমাত্মারূপী আমার মাঝে সর্বজীবকে অভিন্ন দেখতে পাবে।’

অর্থাৎ সমস্ত জীবের মধ্যে ভগবান রয়েছে। সকল মানুষ বা সকল জীবই সমান। কেউ বড় নয় কেউ ছোট নয়।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted