#সুষুপ্ত_পাঠক
7 April 2022
বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডল ও তার ছাত্রদের মধ্যে কথপোকথন শুনে দশম শ্রেণীর এই ছাত্রদের ‘কোমলমতি’ বলার কোন কারণ নেই। যারা গোপনে শিক্ষকের কথা রেকর্ড করে ছড়িয়ে দেয় তারা তাদের হুজুরদের মতই ধড়িবাজ!
আজ থেকে বহু বছর আগে আমার দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান ক্লাশে শিক্ষক আমাদের প্রথমেই বলতেন, বিজ্ঞান যা বলছে তা শুধু পরীক্ষায় নাম্বার পাওয়ার জন্য লিখবে কিন্তু বিশ্বাস করবে না। কারণ আমরা মুসলমানরা কুরআন ছাড়া অন্য কিছু মানি না।
স্কুল থেকেই আমি দেখেছি হিন্দু শিক্ষককে সালামালাইকুম না বলে শুধু আদাব বলা, মুসলিম শিক্ষক হিন্দু ছাত্রদের সালাম না দিয়ে আদাব দিতে বলা শেখানো। নেপথ্য কারণটি ছিলো সালামালাইকুম বলার অর্থ হচ্ছে আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, জবাবেও সেটাই বলতে হবে। কিন্তু একজন অমুসলিমের উপর শান্তি বর্ষণ হোক এরকম শুভ কামনা করা ইসলাম এলাউ করে না। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের বাংলাদেশে যদি এরকম কট্টর ধার্মিকতা স্কুলগুলিতে থাকে তাহলে এখন হৃদয় মন্ডলকে তার ছাত্রদের জুতা মারতে চাওয়াটা খুব বেশি খারাপ হয়েছে বলে মনে হয় না।
বিজ্ঞানের সমস্ত আবিস্কার কুরআন থেকে রিসার্চ করেই করা হয়েছে- এই তাকিয়া শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সঙ্গে যখন তর্ক করতে গিয়ে তারা পারে না তখন কিন্তু তারা কুরআনকে রেফারেন্স টানে না। ৩০ বছর আগে মিশর, তুরস্ক, সৌদি আরব, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত সর্বত্র তর্কে না পেরে পরামর্শ দেওয়া হতো ‘আপনি ডাক্তার বুকাইলির বই পড়েন সব জানতে পারবেন’। উইলিয়াম ক্যাম্পেল মুসলিম বিশ্বের যেখানেই গেছেন তাকে সকলেই খ্রিস্টান ধর্ম যে মিথ্যা, ইসলাম যে বিজ্ঞানময় ধর্ম এটি প্রমাণ করতে এই বইটির কথা তাকে বলা হতো। আমি নিজে যখন আমার শহরে তর্ক করতাম অনেক মানুষের সঙ্গে তখন তারাও দিশেহারা হয়ে এই বইটির কথা বলত। বলাই বাহুল্য যারা পরামর্শ দিতো তারা জীবনেও এই বই পড়েনি। সেই বইটি পরে আমি ফুটপাথ থেকে কিনি। একইসঙ্গে উইলিয়াম ক্যাম্বেলের বইটি যেটি বুকাইলির বইয়ের লাইন টু লাইন ভুল মিথ্যাচার, বাটপারী ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটিও কিনে ফেলি।
বুকাইলির ভাত মারা যাবার পর মার্কেটে আসে জাকির নায়েক। একইভাবে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমাকে শুনতে হয়েছে আপনি জাকির নায়েকের লেকচার শুনুন আপনার সব জ্ঞিজ্ঞাসা মিটে যাবে...। জাকির নায়েককে যখন আমরা ব্লগে প্রতিনিয়ত তার শঠতা মিথ্যাচার ধরিয়ে দিতে লাগলাম তখনই ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলাম রক্ষার আন্দোলন শুরু হলো। নাস্তিক ব্লগারদের হত্যা করতে না পারলে তারা ইসলামকে অযৌক্তিক প্রমাণ করে ছাড়বে। মেজর জিয়ার মত জঙ্গিরা ব্লগার কিলিং করার প্লাণ করার কারণ জাকির নায়েকদের মত লেকচারারসহ ওয়াজী হুজুরদের ব্লগাররা দিনদুপুরে নেংটা করে দিচ্ছিল। যখন ব্লগার কিলিংয়ের সময় ব্লগারদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সকলের দাঁড়ানোর কথা ছিলো তখন দেশের লেখক বুদ্ধিজীবী সেলিব্রেটি সকলেই ইসলাম প্রেমে ব্লগারদের বিরুদ্ধে গিয়েছিলো এবং তাদের হত্যার জন্য তাদের লেখাকেই দায়ী করেছিলো। ফলে ব্লগারদের লেখালেখি বই আকারে বাংলাদেশে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। খালি মাঠে তখন গোল করে ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’। হৃদয় মন্ডলের ছাত্ররা তাকে এই বই পড়তে পরামর্শ দিচ্ছিল যে বইতে দেখানো হয়েছে ইসলাম ও বিজ্ঞান একই জিনিস। ইসলাম পড়েই সব কিছু আবিস্কার করা হয়েছে। জাকির নায়েক থেকে কপি করে যে বইটি লেখা হয়েছে সেই বইয়ের লাইন টু লাইন জবাব দেওয়া যে বইগুলি আমরা লিখেছি সেগুলি কিন্তু একুশে বইমেলায় ছাপানোর কোন সুযোগ নেই। হৃদয় মন্ডলের ছাত্ররা তাকে জানিয়েছে তাদের ইসলাম যে বিজ্ঞানময় একটি ধর্ম এটি জানার সোর্স এই বইয়ের মত আরেকটি বড় সোর্স ওয়াজী হুজুররা। ফেইসবুকে ইউটিউবে অবাধে ওয়াজ শোনা যায়। এদিকে যতগুলি মুক্তচিন্তা সম্পর্কিত ব্লগ ছিলো সেগুলি সরকার বাহাদুর ব্লক করে রেখেছে বাংলাদেশ থেকে। ফলে ওয়াজী হুজুররাও খালি মাঠে গোল দিচ্ছে। হৃদয় মন্ডলের ছাত্ররা তো ব্লগ পড়ার সুযোগ পায়নি। তারা ফেইসবুকে আমাদের লেখা যাতে না পায় তার জন্য মাইনে করা লোক রেখে আমাদের আইডি পেইজ রিপোর্ট মেরে উড়িয়ে দিতে...।
বাংলাদেশের মফস্বলের একটি স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাশে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে এই তর্ক এবং বিজ্ঞানের পক্ষে কথা বলে, প্রমাণ ও যুক্তিকে বিশ্বাসের উপর রাখার কথা বলে ছাত্রদের হাতে জুতার বাড়ি খাওয়ার মত পরিস্থিতি হওয়া, কারাগারে আটক হওয়ার জন্য দায়ী ঐ সমস্ত বুদ্ধিজীবী লেখক সমাজের বড় বড় মানুষরা যারা অনলাইনে মুক্তচিন্তা চর্চা করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছিলো তাদের লেখালেখিকেই জাস্টিফাই করেছিলো হত্যার কারণ হিসেবে। সেদিন দেখলাম প্রথম আলোর কিশোরদের পত্রিকা ‘কিশোর আলো’-তে একটি লেখা বেরিয়েছে ‘ঘূর্ণিঝড় কেন হয়?’ এরকম লেখায় বৈজ্ঞানিক যেসব কারণ দেওয়া হবে দুদিন পর এসব পড়ে যখন ‘কোমলমতিদের’ অনুভূতি ফেটে যাবে? ঝড়-বৃষ্টি কেন হয় এই বিষয়ে ইসলাম বলেছে মিকাইল ফেরেস্তা আল্লার নির্দেশে ঝড়-বৃষ্টি দিয়ে থাকে। বিষয়টা কি একটু বাড়িয়ে বলছি বলে কি আপনাদের কাছে মনে হচ্ছে? তাহলে হৃদয় মন্ডল ও তার ছাত্রদের মধ্যে তর্কের কিছু অংশ তুলে দিলেই বুঝবেন ওয়াজ শুনে শুনে একটা জেনারেশন কোথায় চলে যাচ্ছে!
ছাত্র: আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) বহু বিজ্ঞানের সকল উৎস দিয়ে গেছেন। সাড়ে চার হাজার বছর আগে আমাদের হযরত মোহাম্মদ (স:) এসব বিজ্ঞানের কথা বলে গেছেন।
হৃদয় মন্ডল: সাড়ে চার হাজার বছর আগে কীভাবে? হযরত মোহাম্মদ তো ছিলেন সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে। বিজ্ঞানীরা আবিস্কার শুরু করেছেন বহু আগে থেকে। মানে হযরত মোহাম্মদের আমল থেকেই বিজ্ঞান শুরু হয়েছে এমনটা তো নয়।
ছাত্র: হ্যাঁ স্যার, হযরত মোহাম্মদ (স:) এর পূর্বে যারা বলে গিয়েছেন তাদেরটায় কোন যুক্তি পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) যা বলে গেছেন তা সব যুক্তিপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছে৷
হৃদয় মন্ডল: হযরত মোহাম্মদ এমন কী বলে গেছেন যার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা তার কাছ থেকেই পেয়েছেন? এমন কোন আবিস্কার ছিলো যা বিজ্ঞানীরা আগে করতে পারেননি?
এটা বিজ্ঞানের ক্লাস, ধর্মের ক্লাস নয়। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। আর ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস।
ছাত্র: স্যার আছে, অনেক প্রমাণ আছে যে ধর্মই বিজ্ঞানসম্মত।
হৃদয় মন্ডল: ধর্মের কোন প্রমাণ নেই। শেষমেশ ধর্মের ব্যখ্যা কোথায় যায় জানো? শেষমেশ ওই ঈশ্বর দেখে, ঈশ্বর সমাধান দেবেন, পরকালে বিচার হবে। এসব বিশ্বাসের বিষয়। কোন প্রমাণ নেই৷
...
ছাত্র: স্যার, ধর্মের প্রমাণ আছে।
হৃদয় মন্ডল: ধর্মের কী প্রমাণ আছে আমাকে দেখাও।
ছাত্র: কী যে বলেন স্যার! সারা বিশ্বে মুসলিমদের নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সবাই দেখে ইসলামই সত্য। এটাই সত্য ধর্ম আর বাকি সব মিথ্যা। এটা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছে।
হৃদয় মন্ডল: কোরআন যদি বিজ্ঞানের উৎস হয়ে থাকে তবে দেখাও কোরআন পড়ে কতজন বিজ্ঞানী হয়েছেন? পৃথিবীর ৯০% বিজ্ঞানী খ্রিষ্টান বা খ্রিষ্টান পরিবার থেকে আসা।
ছাত্র: স্যার আমরা যেটাকে ধর্ম বলছি, এটাকে যদি আমরা [বিজ্ঞানের] দিকে নিয়ে যাই তবে সেটাই বিজ্ঞান। আর যদি বিজ্ঞানকে ধর্মের দিকে নিয়ে যাই তবে ওটাই বিজ্ঞান। মূল কথা হচ্ছে দুটোই এক জিনিস।
হৃদয় মন্ডল: এই যে খ্রিষ্টানরা এতোকিছু আবিস্কার করে, তাদের ধর্মের নিয়ম সেভাবে কেউই মানে না। তারা কি ধর্ম ব্যবসা করতে পারে না? অবশ্যই পারে। তারা ধর্ম ব্যবসা করছে কি? তারা ধর্মের ধারেকাছেও নেই। তারা আছে আবিস্কার নিয়ে৷ এই মুসলমানরা এগিয়ে যেতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকতে হবে৷ ধর্মান্ধতা বাড়লে সেটা সম্ভব নয়৷ এই চৌদ্দ শত বছর আগে ইসলাম এসেছে। বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ বছরে৷ তাহলে এতোদিন হুজুররা কী করেছেন? কী আবিস্কার করেছেন তারা?
...
ছাত্র: এরা আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন।
হৃদয় মন্ডল: নৈতিক জ্ঞান হয়ত। ধর্ম মানুষকে জীবনযাপন এর কিছু নিয়ম বলে দেয়। মানুষ সেটা পালন করে। এর বাহিরে কি কিছু নেই? অবশ্যই ধর্ম পুস্তকের বাহিরে অনেক কিছুই আছে৷ ধর্ম এসেছেই মানুষকে শৃঙ্খলায় রাখার জন্য। আর কোন কিছুর জন্য নয়। এই যে স্রষ্টা আছে বলা হয়, আমরাতো দেখিনি। যে জিনিস দেখিনি সে জিনিস নিয়ে মারামারি কাটাকাটির কোন মানে আছে? তোমার বিশ্বাস তোমার বিশ্বাসের জায়গাতেই রাখো। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণ সাপেক্ষ। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়৷ আর ধর্মে অন্ধ হলে যা হয়, এই গরমে জোব্বা পরে থাকে। এটাতো বিজ্ঞানসম্মত নয়৷ এই যে তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাস হয়ে বাতি জ্বলে এটা বিজ্ঞান। এই যে A+B হোলস্কয়ারের সূত্র, এগুলো হিসেব করে মেলানো। এটাই বিজ্ঞান যা প্রমাণ সাপেক্ষ। এগুলো কি ধর্মগ্রন্থে আছে? আমরা অনেক সময় বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে মিলাই যা ঠিক নয়। হ্যাঁ ধর্ম মানুষকে সুশৃঙ্খল রাখে। বিজ্ঞান আলাদা কথা। বিজ্ঞান বিজ্ঞানই।
ছাত্র: ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’ বইটা পইড়েন স্যার। গুগল প্লে স্টোরে পাবেন।
....
এই কথা বলে যদি কোন বিজ্ঞানের শিক্ষককে জেলে যেতে হয় সেই দেশে বিজ্ঞান পড়ানোই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বিজ্ঞানের শিক্ষক তো যুক্তি প্রমাণের কথাই বলবে। তাবলীগে যাওয়া কেমিস্ট্রির প্রফেসর নয়, হৃদয় মন্ডলের মত বিজ্ঞান শিক্ষক ছাড়া আজহারী মাজাইরী জেনারেশনকে কেউ পথে আনতে পারবে না। তাই হৃদয় মন্ডলের পক্ষে সমস্ত মুক্তচিন্তার মানুষ দাঁড়ান। ফেইসবুক ইউটিউবে এই শিক্ষকের মুক্তির জন্য ও তার বৈজ্ঞানিক মত প্রকাশের পক্ষে কথা বলুন।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................