বাঙালি হিন্দু স্টোকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত
মানুষের মনজগত বড় বিচিত্র, এ মনজগতের গতিপ্রকৃতিকে আজও যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়নি এবং হয়তো কোনদিন যাবেও না। মানুষকে সূত্রবদ্ধ করা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কঠিন একটি কাজ। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, খুবই আশ্চর্যজনকভাবে যারা দিনের পরে দিন কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায় দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন ; কিছু সমিয় পরে সেই নির্যাতিত এবং তার বংশধরেরাই নির্যাতনকারীর অনুগত হয়েছেন। বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য। শতশতবছর বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পরাধীনতার অভিঘাতে এ ঘটনাটির অসংখ্য দৃষ্টান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে প্রচণ্ডভাবে দেখা যায়। বাঙালি হিন্দু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় নি। তাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে প্রতিনিয়ত করেই যায়। প্রচণ্ড নির্যাতিত হয়ে নির্যাতনকারীদের অনুগত হয়ে তাদের দলভূক্ত হয়ে যাওয়াকে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় 'স্টকহোম সিনড্রোম (Stockholm Syndrome)' নামে অভিহিত করা হয়।
এ সিনড্রোম হলো এক ধরণের বিশেষ মানসিক পরিস্থিতি যখন কোন ভুক্তভোগী ব্যক্তি অজ্ঞাত কারণে অপরাধীর প্রতি ধীরেধীরে সহানুভূতি প্রকাশ করতে শুরু করে। তাদের ভালোবাসতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ওই ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির মধ্যে এমন সব মানসিক উপসর্গ লক্ষ্য করা যায় যেটা খুবই বিরল। লাঞ্চিত ব্যক্তিটি অপরাধীর প্রতি অত্যন্ত দুর্বল এবং আবেগতাড়িত হয়ে যায়। সে অপরাধী ব্যক্তিটির অপরাধ গোপন করতে উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। এসময়ে সেই নির্যাতিত ব্যক্তি অপরাধীকে আর অপরাধী হিসেবে মনে করে না। অনেক সময়ে বিয়েও করে ফেলে সংসার শুরু করে। ১৯৭৩ সালের ২৩ অগাস্ট স্টকহোমের একটি ব্যস্ততম ব্যাংক (Kreditbanken), যে ব্যাংকটির বর্তমান নাম নরডিয়া ব্যাংক (Nordea Bank)। এ ব্যাংকে একজন অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত হামলা করে । তার নাম ছিলো Jan-Erik Olsson, তিনি একজন পেশাদার অপরাধী। বিভিন্ন অপরাধে পূর্বেও তিনি অনেকবার জেলে গিয়েছিলেন। তিনি মুখে মুখোশ পরে একটি সাব-মেশিনগান জ্যাকেটের ভেতরে নিয়ে প্রবেশ করেন। ব্যাংকে ঢুকে প্রথমেই তিনি চারজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে জিম্মি করে ফেলেন। জিম্মি এ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনজন নারী এবং একজন পুরুষ। নিমেষেই ব্যাংকের অভ্যন্তরে এক প্রচণ্ড ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সবাইকে জিম্মি করে আসামী
Jan-Erik Olsson মুক্তিপণ দাবি করে। তিনি পুলিশকে শর্তারোপ করেন যে, তার ডাকাত বন্ধু Clark Olofsson কে তার কাছে এনে দিতে হবে। এরসাথে ৩ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার; বুলেট-প্রুফ ভেস্ট; দুইটি অস্ত্র; হেলমেট; পালিয়ে যেতে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
ঘটনাটি এতদূর যায় যে, সুইডেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী Olof Palme সেই ব্যাংক ডাকাতের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাংক ডাকাত জানান, তার শর্তগুলো পূরণ না হলে তিনি ব্যাংক কর্মকর্তাদের হত্যা করবেন। এভাবে টানা ছয়দিন নাটকীয় বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। একজন নারী ব্যাংকারের সাথেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয় এবং তিনি প্রধামন্ত্রীর কাছে তাদের উদ্ধারের জন্য আসু ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ কিরেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, তারা ভালো নেই এবং ডাকাতের আচরণে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। ২৮ আগস্ট প্রায় ১৩১ ঘণ্টা পরে জিম্মি চারজন ব্যাংক কর্মকর্তা অবশেষে মুক্তি পায়। কিন্তু এরপরেই শুরু হয় তাদের অদ্ভুত আচরণ। মুক্তি পাবার পর গণমাধ্যমে দেওয়া তাদের সাক্ষাৎকারে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, জিম্মি চারজন ব্যাংক কর্মকর্তা মানসিকভাবে তাদের অপহরণকারীদের সমর্থন প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছেন।আইনরক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি তারা রহস্যময় ক্ষুব্ধ আচরণ করতে শুরু করেন।অপরাধী ডাকাত দুইবন্ধুকে জিম্মি কর্মকর্তারা কোর্টে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করতে অস্বীকার পর্যন্ত করে। ঘটনাটি আরও বহুদূরে এগিয়ে যায়। অপরাধীদের মুক্তির জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা অর্থ সংগ্রহ শুরু করে দেয়। এরমধ্যে এক নারী ব্যাংক কর্মকর্তা অপহরণকারী একজনের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর থেকেই নির্যাতিত ব্যক্তির নির্যাতনকারীদের প্রতি মানসিক দুর্বলতাকে বিশ্বে স্টকহোম সিনড্রোম নামে অভিহিত করা শুরু হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এভাবে হাজার বছর ধরে হিন্দু সম্প্রদায় ‘স্টকহোম সিন্ড্রমে’ ভূগছে। যে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে মন্দির বিধ্বস্ত হয়েছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তার সুবিশাল গ্রন্থাগার বিধ্বস্ত হয়েছে। অথচ আজ আমরা ইতিহাসে তাদেরই গুণগান করছি, বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করছি।সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারীর সঙ্গে সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা কখনো হয় না। এ সরল কথাটি এ ভূখণ্ডের মানুষেরা অধিকাংশ আজও বুঝতে পারেনি।যদি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভালোবাসা হয়েই থাকে, তবে সেই ভালোবাসাকে বলে ‘স্টক হোম সিন্ড্রোম’। যা এক ধরণের মানসিক রোগ। প্রচণ্ড ভয় এবং লোভ থেকে এ রোগ উৎপন্ন হয়। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রএমন অপরিণামদর্শীতা অদূরদর্শিতা স্বীকৃতি দেয় না। মহাভারতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে মানুষ যেমন প্রকৃতির তার সঙ্গে ঠিক তেমনভাবেই আচরণ করা উচিত।দয়ার প্রতুত্তরে দয়া দেখাতে হয়। আক্রমণের প্রত্যুত্তরে নিজেকে রক্ষার্থে আক্রমণ করলে কোন পাপ হয় না। বরং দেশ, জাতি এবং নিজেকে রক্ষা করাও ধর্ম। প্রতারকের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিলে কোন পাপ হয় না।
যস্মিন্ যথা বর্ত্ততে যো মনুষ্য-
স্তস্মিংস্তথা বর্ত্তিতব্যং স ধর্মঃ।
মায়াচারো মায়য়া বর্ত্তিতব্যঃ
সাধ্বাচারঃ সাধুনা প্রত্যুপেয়ঃ।।
(মহাভারত:উদ্যোগপর্ব, ৩৭.৭)
"যে মানুষ অন্যান্য মানুষের সঙ্গে যেমনভাবে চলে, সেই মানুষের সাথে ঠিক তেমনভাবেই চলা উচিত, এটাই ধর্মের নিয়ম। সাধুর সাথে সাধুতাই যেমন একমাত্র অবলম্বন; পক্ষান্তরে তেমনি মায়ার আশ্রয় নেয়া কপট ব্যক্তির সাথে কপট ব্যবহার করাই একান্ত কর্তব্য।"
নিজস্ব স্বকীয়তা তথা সংস্কৃতিকে ধারণ, পোষণ এবং চর্চা করার অনীহার কারণে বর্তমানে অন্যান্য বৈদেশিক সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতিতে গ্রাস করার প্রচেষ্টা করছে। নিজেদের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস না জানায়, বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও স্টোকহোম সিনড্রোম নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে কোন এক অজানা কারণে নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। মহাভারতে একটি অত্যন্ত সুন্দর নির্দেশনা রয়েছে , মানুষ যা হতে নিবৃত হতে পারে, তিনি শুধু তা থেকেই মুক্ত হতে পারেন। শাস্ত্রীয় এ নির্দেশনাটি স্টোকহোম সিনড্রোম নামক মানসিক রোগের উপশমে অত্যন্ত কার্যকর। অর্থাৎ মানসিক সিনড্রোম আগে কাটিয়ে উঠতে হবে, তবেই আমরা এর ভয়ংকরী জাল থেকে মুক্ত হতে পারবো।
যতাে যতাে নিবর্ততে ততস্ততাে বিমুচ্যতে।
নিবর্তনাদ্ধি সর্বতাে ন বেত্তি দুঃখমণ্বপি।।
(মহাভারত: উদ্যোগ পর্ব, ৩৬.১৪)
"মানুষ যা হতে নিবৃত হয়, তা থেকেই মুক্ত হতে পারে। সমস্ত বিষয় হতে নিবৃত হতে পারলেই একমাত্র দুঃখলেশ অনুভব করে না।"
প্রতিনিয়ত মন্দির ধ্বংস হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হচ্ছে। আবার সেই সাম্প্রদায়িক আক্রমণকারীদের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদের সাথে প্রেমের সম্পর্কের জালে জড়িয়ে মোহান্ধ হয়ে যাচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তি বা তার উত্তর পুরুষেরা। একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। ১৯৭১ সালে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের দ্বারা ব্যাপকভাবে গণহত্যা সংগঠিত হয়।জোর করে অসংখ্য নারীদের ধর্ষণ করা হয়, অঙ্গহানি করা হয়, ধর্মান্তরিত করা হয় এবং হত্যা করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে রাজাকারদের দেশ-জাতি বিরুদ্ধ ঘৃণ্য বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের বর্তমান প্রজন্মের প্রতি অনেক নির্যাতিত পরিবারের সদস্যরাই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে সেই রাজাকার পরিবারে বিয়ে করে তাদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ভুলে যাচ্ছে ১৯৭১ সালে তাদের পরিবারের সাথে ঘটা অন্যায়ের ইতিহাস। রাজাকারের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে যারা সুযোগ বুঝে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বসতভিটা ব্যাপকভাবে আক্রমণ করেছে; একটু খুঁজলেই সেই ব্যক্তিদের পরিবারে আক্রান্তদের পরিবারে জন্ম নেয়া কাউকে পাওয়া যায়। অনেক কুখ্যাত রাজাকারের পরিবারে আজও অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মান্তরিত নারীকে পাওয়া যায়। যাদের দ্বারা পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, দিনশেষে সেই পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া বিষয়টি অত্যন্ত লজ্জার। রাজাকার বংশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া এ বিষয়টি কোন ধর্মের দৃষ্টিতে না দেখে, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আত্মসম্মানবোধের দৃষ্টিতে দেখি; তবেও বিষয়টি নিন্দনীয়। অপমান, দুর্ব্যবহার কালের পরিক্রমায় ক্ষমা করে দিলেও সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ভুলে গেলে ঘটনাগুলোর একই পুনরাবৃত্তি পরবর্তী প্রজন্মের সাথেও বারবার হয়।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................