মাত্র দেড়শো বছর আগেও বাংলা দেশে ঈদ অপ্রধান একটি উত্সব ছিলো। পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকরা রোজাও রাখত না। ঈদ বলে কোন উত্সবকে তারা জানতও না। এমনকি ইংরেজ আসার আগে মুঘল আমলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা দেখত মুঘলরা মাঠে নামাজ পড়ছে, কামান দাগছে, আর হাতিতে চড়ে এই গরীব কৃষক কাঙালদের মাঝে পয়সা ছিটাচ্ছে। মুঘলদের ছিটানো পয়সা নিতে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। এদেশের স্থানীয়দের কাছে ঈদ ছিলো এরকমই বিদেশী অজানা এক উত্সব।
স্থানীয় মুসলমানরা মূলত এদেশের নানা রকম লোকজ পার্বন, ভাদ্রমাসের ভাসান, সন পয়লার মেলা, নানা রকম ব্রত পালন করত। এই উপলক্ষ্যে গান বাজনা চলত। হিন্দুদের সঙ্গে তাদের লোকজ সংস্কৃতির কোন তফাত ছিলো না। আশ্চর্য যে ইংরেজ আমলে এসেও বহু গ্রামে ঈদের নামাজ ঠিক কি করে পড়তে হয় সেটাও কেউ জানত না। ঠিক এই রকম সময় শরীয়তুল্লাহ হজ করতে মক্কা যান। তিনি ফিরে আসেন ‘প্রকৃত ইসলাম’ কি সেটা জেনে। তিনি সেখানে ওহাবী আলেমদের কাছে ইসলামী দীক্ষা নেন। তারপর দেশে ফিরে এসে আন্দোলন শুরু করেন। তিনিই পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের আরবীতে নাম রাখাকে বাধ্যতামূলক করেন। হিন্দুদের থেকে পৃথক করতে মুসলমানদের পোশাক আলাদা করেন। সেকালে পূর্ববঙ্গে মসজিদ ছিলো হাতে গোণা। শরীতুল্লাহ মসজিদ গড়ে তুলেন। ঈদ উদযাপন সূচনা হয় শরীতুল্লাহর হাত ধরে। শরীতুল্লাহর মাধ্যমে এদেশের মুসলমানদের হাতেখড়ি ঘটে হিন্দুদের সঙ্গে উঠবস, তাদের অনুসরণ মুসলমানদের জন্য নয়। মুসলমানদের বাধ্যতামূলক দাড়ি রাখা, নামাজ পড়া, হালাল খাওয়া শেখানো হয়। তারপরও ঈদ তখনো তুচ্ছ এক উত্সব ছিলো এই অঞ্চলে। ঈদ প্রথম জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়। সেটাও স্রেফ ঢাকা শহর কেন্দ্রিক। ঢাকা তখনো খুবই ছোট একটি শহর। পুরো পূর্ব পাকিস্তানের আটষট্টি হাজার গ্রামে ঈদের কোন প্রভাব ছিলো না।
ঈদ তাই এই অঞ্চলে কখনোই প্রধান উত্সব ছিলো না। দেশভাগ ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হবার পর ঈদের বাণিজ্য পরিধি বেড়ে যাওয়ায় ঈদ গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। কিন্তু এটি কখনোই বড়দিন বা দুর্জাপুজার মত সার্বজনীন হতে পারবে না। কারণ ধর্ম হিসেবে ইসলাম খুবই কট্টর ও সংক্রীর্ণ। ভিন্ন ধর্মালম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতাই এর প্রধান কারণ। কিন্তু আসল সমস্যা দেখে যাচ্ছে বিগত বছরগুলিতে অন্য দিক দিয়ে। ইসলামের চাঁদ দেখে মাস গণনার দুর্বলতা ও গোঁড়ামীই এর জন্য দায়ী। ইসলামে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে চাঁদ দেখে রোজা শুরু ও ঈদ পালন। এই ঘোষণায় বিভ্রান্তি আরো বেড়েছে মুসলমানদের মধ্যে। সমগ্র পৃথিবীতে চাঁদ স্বচোখে দেখে ঈদ করা মানে বিভিন্ন দেশেই কেবল নয়, একই দেশে একেক সময় ঈদ হওয়ার কথা। সেটাই ঘটেছে। কিন্তু বিগত বছরগুলিতে সৌদি আরবে দেখা চাঁদকে সহি ধরে বাংলাদেশে অনেক জেলায় ঈদ হতো বাংলাদেশের সরকারীভাবে ঘোষিত ঈদের একদিন আগে। এ বছর আফগানিস্থানে ও আফ্রিকার মালিতে দেখা চাঁদকে নির্ভর করেও ঈদ পালিত হচ্ছে। চন্দ্র মাসের সমস্যাকে মানতে চায় না মুসলমানরা। কিন্তু তারাও চায় বড়দিনের মত একই দিনে ঈদ পালন করুক সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা। সেটি করতেই সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ পালনের রেওয়াজ চালু করছিলো। কিন্তু ইসলামের আফগান কিবলা সৌদি আরবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে সৌদির একদিন আগেই ঈদ উদযাপন করে। তাদের অনুসরণ করেছে বাংলাদেশের কিছু গ্রাম। আবার সৌদিকে অনুসরণ করে তো ঈদ হচ্ছেই, তারপর হবে সরকার ঘোষিত ঈদ! এমনিতেই ঈদের নামাজের ঠেলায়, মুল্লার পাপ আর আজাব আর ইহুদীনাসারাদের উপর গজবের ঠেলায় ঈদ উত্সব এখন ম্রিয়মাণ। এটা আর খুশি নয়। এটা এখন নামাজ সর্বস্ব অনুষ্ঠান। তার মধ্যে ত্রিভঙ্গ উদযাপন ঈদকে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশেই অপ্রধান করে তুলবে। পক্ষান্তরে পয়লা বৈশাখের বাণিজ্যিক পরিধি এখন আড়াই হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ জন্যই পয়লা বৈশাখের বিরুদ্ধে হুজুরদের এত ক্ষোভ!
জ্ঞান হবার পর নিজে থেকে কাউকে ঈদ মুবারক জানাইনি। একটা কট্টর রাজনৈতিক মতবাদের উপর দাঁড়ানো ধর্মের উত্সব নিয়ে কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে আমার রুচিতে বাঁধে।
-সুষুপ্ত পাঠক
02 May 2022
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................