ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে ঋগ্বেদ

ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে ঋগ্বেদ 

আমরা অনেকেই ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তালমুদ, খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কোরানের মত বেদকে একটি গ্রন্থ হিসেবে মনে করি। বেদ নিয়ে সামান্য পড়াশুনার আগে আমি নিজেও তাই মনে করতাম। কিন্তু বেদের জগতে সামান্যতম প্রবেশ করেই টের পেলাম বেদ শুধুমাত্র একটি গ্রন্থই নয়, একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থাগার।কিন্তু বেদের চর্চা না থাকার কারণে অনেকেই জানেন না যে, বেদ নামের এককগ্রন্থটি অসংখ্য গ্রন্থের সমষ্টি। একটি নামে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থাগার।
মানবজাতির জ্ঞানজগতের চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যকরণ, ছন্দ, যুদ্ধবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, সংগীত, পারিবারিক আইন, রাষ্ট্রীয় সামাজিক আইন, জ্যামিতি, বিভিন্ন বিধিব্যবস্থা, মাঙ্গলিক লোকাচার, আধ্যাত্মিক জ্ঞান, আত্মতত্ত্ব সহ প্রত্যেকটি বিষয়ের উপরে আলাদা আলাদা গ্রন্থ আছে। আকারে প্রকারে এবং বিষয়বস্তুগত বৈচিত্র্যময়তার কারণে অনেকেই বেদ বুঝতে পারেন না। আবার একাধিক গ্রন্থ হওয়ার কারণে কোথা থেকে শুরু করবেন তাও বুঝতে পারেন না। 

বেদ বুঝতে হলে অধিকারী হবে, পূর্বজন্মের সুকৃতি থাকতে হবে। আবার বৈদিক জ্ঞানটি একটি গুরুমুখী পরম্পরাগত জ্ঞান হওয়ায়, ইদানিং বাংলাদেশে সেই পরম্পরার ছেদ হয়ে যাওয়ায়, আমরা অনেকেই বেদ পড়েও বুঝতে পারি না।মানবজাতির অপরাবিদ্যা হল স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য জাগতিক বিদ্যা এবং পরাবিদ্যা হল অধ্যাত্ম এবং মুক্তি বিদ্যা। এ পরা এবং অপরা অর্থাৎ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সকল বিদ্যারই বেদে আছে। এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ১৮৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চিকাগাে ভাষণে নবম দিবসের অধিবেশনে হিন্দুধর্ম নামক প্রবন্ধে প্রায় একই কথা বলেছেন:

"বেদ শব্দধারা কোন পুস্তক-বিশেষ বুঝায় না। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে যে আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, বেদ সেই-সকলের সঞ্চিত ভাণ্ডারস্বরূপ। আবিষ্কৃত হইবার পর্বেও মাধ্যাকর্ষণের নিয়মাবলী যেমন সর্বত্রই বিদ্যমান ছিল এবং সমুদয় মনুষ্য-সমাজ ভুলিয়া গেলেও যেমন ঐগুলি বিদ্যমান থাকিবে, আধ্যাত্মিক জগতের নিয়মাবলীও সেইরূপ। আত্মার সহিত আত্মার যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, প্রত্যেক জীবাত্মার সহিত সকলের পিতাস্বরূপ পরমাত্মার যে দিব্য সম্বন্ধ, আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও সেগুলি ছিল এবং সকলে বিস্মৃত হইয়া গেলেও এগুলি থাকিবে। এই আধ্যাত্মিক সত্যগুলির আবিষ্কারগণের নাম 'ঋষি'। "
(বাণী ও রচনা, ২০১৬ : ১১-১২)

বেদের বহুমুখী সর্বজনীন সকল দিকপ্রসারী জ্ঞানময় বৈশিষ্ট্যের কারণেই বেদচর্চা ইউরােপ, আমেরিকা সহ সারা বিশ্বব্যাপী দিনেদিনে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বেদের এই বৈশ্বিকরূপের দিকে দৃষ্টি দিয়েই ২০০৭ সালে UNESCO ঋগ্বেদের বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে, বেদকে মানবজাতির প্রথম সাহিত্যক নিদর্শন বলে অভিহিত করা হয়। সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়, বেদ সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত হলেও মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন হওয়ায় ধর্মীয়গ্রন্থের পরিচয় ছাড়িয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। আর্য সংস্কৃতির অবারিত ঝর্ণাধারার উৎস হিসেবে ঋগ্বেদ চতুর্বেদের মধ্যে প্রাচীনতম। জগতের সর্বপ্রাচীন মহামূল্যবান অক্ষয় সম্পদ বেদকে ভারতবর্ষে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে, বহু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বংশ পরম্পরায়। 

"The Vedas are generally known as the scriptures of the Hindu community. However, being among the first literary documents in the history of humankind, they transcend far beyond their identity as scriptures. The Rigveda, the oldest among the four Vedas, is the fountain source of the so-called Aryan culture in all its manifestations that spread beyond the Indian subcontinent to large parts of South and South East Asia, as well as parts of Central Asia. This valuable treasure of the ancient world has been preserved in the form of manuscripts in India, and handed down over centuries from generation to generation."

বেদ সনাতন ধর্মবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেদের সামান্যতম প্রচার প্রসার বাঙালি হিন্দুর জীবনে খুব একটা দেখা যায় না। তাই প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বেদ সম্পর্কে অসংখ্য ভুল ধারণা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গানের বই, পাঁচালী, কথোপকথনের বই এবং চিঠিপত্রাদির সংকলনগ্রন্থকে যারযার ব্যক্তিগত গুরুবাদী বিশ্বাস থেকে প্রধান ধর্মীয়গ্রন্থ মনে করেন। এ বিষয়টি বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তারা নিজেরাও জানেন না যে এ কাজের মাধ্যমে ধীরেধীরে তারা অজ্ঞাতসারে অজ্ঞানতার অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।বেদবিদ্যা সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা না থাকায় তাদের সুবুদ্ধির দরজা দিনেদিনে তালাবন্ধ জড়তাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রে বিশেষ করে মহাভারতে বলা আছে, সনাতন ধর্ম দুর্জ্ঞেয় হওয়ার এ ধর্ম সম্পর্কে সহযেই জানা যায় না; আগে অধিকারী হতে হয়।তবে এ দুর্জ্ঞেয় সত্যে প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে জানতে হলে বেদই একমাত্র প্রমাণ এবং উপায়। 

দুর্জ্ঞেয়ঃ শাশ্বতো ধর্মঃ স চ সত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ।
শ্রুতিপ্রমাণো ধর্মঃ স্যাদিতি বৃদ্ধানুশাসনম্।।
(মহাভারত:বনপর্ব, ১৭৪.৬১)

"জ্ঞানীদের উপদেশ এই যে,সনাতন ধর্ম দুর্জ্ঞেয়; তা সত্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং বেদই তাঁর প্রমাণ।"

বেদের পরে রামায়ণ, মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণ এবং অষ্টাদশ উপপুরাণ আমাদের ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এগুলির একটিও প্রধান ধর্মগ্রন্থ নয়।বেদই আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এবং পুরাণগুলিকে গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। পুরাণে যেমন অনেক অসাধারণ অসাধারণ কথা আছে, তেমনি কিছু কিছু স্থানে বালখিল্য কথাবার্তাও আছে। আজ বেদ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত, এ গর্বিত হওয়ার মত বিষয়টি আমরা কয়জন জানি? সমাজে বেদের চর্চা না থাকায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও আজ বেদ নিয়ে তথ্যসন্ত্রাস করে সনাতন ধর্মাবলম্বী ছেলেমেয়েদের বিভ্রান্ত করে, পরিশেষে  ধর্মান্তরিত করছে। তাই আমাদের সকলের উচিত, ছোট থাকতেই সন্তানের মস্তিষ্কে বেদ-বেদান্তের জ্ঞানরূপ গঙ্গাজল দিয়ে পূর্ণ করে দিতে। পরবর্তীতে তারা যখন বড় হবে তখন কেউ যেন তাদের মাথায় ড্রেনের নোংরা পূতিগন্ধযুক্ত দুষিত জল ঢেলে দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে মা-বাবা আত্মীয়পরিজন থেকে দূরে ঠেলে দিতে না পারে। 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :

১.স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা (১ম খণ্ড), কলিকাতা: উদ্বোধন কার্যালয়, ৪র্থ সংস্করণ, ২০১৬ 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted