সকল ভাবই সনাতন ধর্মে রয়েছে

সকল ভাবই সনাতন ধর্মে রয়েছে 

প্রতিমা পূজারী পৃথিবীর বহু ধর্মাবলম্বীরা পৃথিবী থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে অথবা তাদের জোরজবরদস্তি করে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু হাজার অত্যাচারের পরেও প্রতিমা পূজারী হিন্দুদের কেউ বিনাশ করতে পারেনি।পৃথিবীতে আজও শতকোটির উপরে সনাতন ধর্মাবলম্বী। ভারত, নেপাল এবং মরিশাস এ তিনটি দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইউরোপ, আমেরিকার, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ সনাতন ধর্ম গ্রহণ করছে। আজ পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষাতেই শ্রীমদ্ভগবদগীতার চর্চা হচ্ছে অনূদিত হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সচেতনভাবে কোন রাজশক্তির কোটি কোটি টাকার প্রচারণা নেই এর পেছনে। শুধুই আছে, এক শাশ্বত সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন পুণ্যপীযুষধারার ঐতিহ্য। 

পৃথিবীর কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদীরা যে দেশে প্রবেশ করেছে, প্রায় শতবছরের মধ্যে সেদেশের প্রায় অধিকাংশ মানুষকেই তাদের ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে বা করতে বাধ্য করেছে। জোর করে সেদেশের প্রাচীন ভাষা মুছে দিয়ে, তাদের নিজস্ব ভাষা প্রবর্তন করেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে এ সাম্রাজ্যবাদীরা সম্পূর্ণ সফল হয়নি।কারণ, এ ভূখণ্ডের  সংস্কৃতি অন্য অনেক বর্বর নৃশংস সাম্রাজ্যবাদীদের সংস্কৃতি থেকে ছিল  উন্নত এবং মহত্তম। তাই যখন বিদেশি আক্রমণ হয়েছে, তখন সাময়িক তাদের বেতগাছের নুয়ে যাওয়ার মত বেতসবৃত্তি অবলম্বন করতে হয়েছে। বেতগাছের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঝড়ঝাপটা আসলে সাময়িক নুয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। ঝড়ঝাপটা চলে গেলে পরক্ষণেই আবার মাথা উঁচু করে নিজ অস্তিত্বকে জানিয়ে দেয়।এদেশীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের দৃষ্টিতে ছিল বহু ঈশ্বরবাদী ধর্ম। তাদের ভাষায় এদেশীয়রা, মূর্তিপূজারী, সয়তানের পূজারী, পশুপাখির পূজারী, গাছ-লতা -পাতা-মাটি পাথর-জল সহ জগতের সকল কিছুর পূজারী। তাই তাদের ভাষায়, এদেশীয়রা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঘৃণ্য। 

এদেশীয় বিশ্বাসের ভাব এবং দর্শন আরব, তুর্কি, ইউরোপীয় বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা কেউ কখনো বুঝতে পারেনি। অবশ্য ইউরোপীয়দের মধ্যে কদাচিৎ কয়েজন বোঝা বা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছে। হয়ত সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেনি। কিন্তু তাদের কিছু মানুষের প্রচেষ্টা ছিল। পক্ষান্তরে অন্য সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষ করে আরবীয়, তুর্কি, পাঠান সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা অধিকাংশই বোঝার নূন্যতম চেষ্টাও করেনি। এদের মধ্যে বিরল ব্যতিক্রমী হিসেবে যারা কিছুটা এদেশীয় ভাব দর্শনের বোঝার চেষ্টা করে এবং সংরক্ষণের চেষ্টা করেছে, তারা একেবারেই হাতেগোনা বিরল ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বেদসহ শ্রীমদ্ভগবদগীতা বলছে, সমত্ববুদ্ধি অবলম্বন করে সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করে প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে, প্রত্যেকটি বস্তুর মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন এবং উপলব্ধি করে তাঁর ভজনা করতে। তাই সনাতন শাস্ত্রে বারংবার প্রত্যেকটি জীবের প্রতি সমদর্শী হতে বলা হয়েছে।

সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি ৷
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ ৷
সর্বথা বর্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ততে ॥
(গীতা:৬. ২৯-৩১)

"প্রকৃত যোগী সমদর্শী হয়ে সর্বভূতে আত্মাকে দর্শন করেন এবং নিজ আত্মাতেই সর্বভূতকে দর্শন করেন ৷ 
যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূতের অবস্থিত দেখেন, আমি তাঁর অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার অদৃশ্য হন না।
যে যোগী সমত্ববুদ্ধি অবলম্বন করে সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করে সর্বভূতস্থিত পরমাত্মারূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতে আমাতেই অবস্থান করেন"

সনাতন ধর্মে সমদর্শী হয়ে জগতের সকল জীবকে ভালবাসতে বলা হয়েছে। সনাতন ধর্ম হল বিশ্বের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাংগঠনিক মতগুলোর বিরুদ্ধে টিকে থাকা, একমাত্র  প্রকৃতি উপাসক, Pagan (মূর্তিপূজক), Animist (সর্বপ্রাণবাদী), Polytheistic , (বহু ঈশ্বরবাদী) মতের প্রতিনিধি। Pagan, Animist, Polytheistic -এ সংজ্ঞাগুলো অবশ্য পশ্চিমাদের দেয়া। শব্দগুলো অনেক সময়ে আমাদের প্রতি নিন্দার্থে তারা ব্যবহার করলেও, আমাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা বা দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। সনাতন ধর্ম একেশ্বরবাদী। বেদে বলা আছে 'একমেবাদ্বিতীয়্' ; অর্থাৎ ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, সেই ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। জগতের ভাল মন্দ সকল ভাবই তাঁর থেকেই উদ্ভূত। সনাতন ধর্ম যেমন একেশ্বরবাদী, তেমনি বহু ঈশ্বরবাদী, প্রকৃতিপূজারী, সর্বপ্রাণবাদী, মূর্তিপূজারী ইত্যাদি বিবিধ প্রকারের বিশ্বাস এবং ভাব এ ধর্মের মধ্যে রয়েছে।জগতের সকল ভাবই সনাতন ধর্মে পাওয়া যায়। এ ধর্ম কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবর্তিত এককেন্দ্রিক সাংগঠনিক ধর্ম নয়। যে প্রবর্তক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে দিলে, ধর্ম অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায়।একেশ্বরবাদের নামে, অন্যদের  বিশেষ করে মূর্তিপূজকদের উপাস্য দেবদেবীর মূর্তিগুলো ভাঙতে সরাসরি নির্দেশনা দেয়া আছে পৃথিবীর কয়েকটি ধর্মগ্রন্থে। প্রতিমাপূজা নিষিদ্ধ যে সকল ধর্মগ্রন্থে, সে গ্রন্থগুলো থেকে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। সে সকল ধর্মগ্রন্থে, মূর্তিপূজা যে সকল জাতিগোষ্ঠীরা করে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তীব্রতর বিদ্বেষ দেখা যায়। 

"তোমরা তাদের দেবদেবীদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলবে এবং তাদের পূজার পাথরগুলি টুকরো টুকরো করে ফেলবে।"
(পবিত্র বাইবেল: যাত্রাপুস্তক, ২৩. ২৪)

খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য, এই একবিংশ শতাব্দীতেও কিছু মানুষ ;অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য বিগ্রহাদি ধ্বংস করাকে তাদের ধর্মের অঙ্গ মনে করে। কিন্তু সনাতন ধর্ম সমদর্শী হয়ে জগতের প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুসন্ধান সৃষ্টির শুরু থেকে আজও করে চলছে। সৃষ্টিকে দেখেই স্রষ্টার উপলব্ধি হয়। জগতের স্রষ্টা কোন হিংসুটে নন, তিনি সমদর্শী, জগতের সকলেই তাঁর সন্তান। তিনি প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই জীবাত্মা রূপে বিরাজমান। প্রত্যেকটি জীবকে ভালবাসাই,  প্রকারান্তরে সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসা।বেদে পঞ্চমহাযজ্ঞের মাধ্যমে প্রত্যকটি মানুষ, পশুপাখি প্রাণীকুলকে অন্নদান সহ তাদের পাশে থেকে তাদের মধ্যে ঈশ্বরকে দর্শন করতে বলা হয়েছে। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted