জিহাদী যুদ্ধ পদ্ধতি- রিজিয়া
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
আরবী ভাষায় ‘রিজিয়া’ নামে একটি শব্দ আছে। এটি একটি পদ্ধতি যা কি না ব্যাবহৃত হয় শুধু মাত্র একটি দেশ দখল করার জন্য এবং সেই বিজিত দেশের মানুষের, তাদের নিজষ্ব জীবন যাত্রা প্রনালী, ভাষা, আচার ব্যবহার, উপাসনা পদ্ধতি এমনকি তাদের সহজাত চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা পরিবর্তন করে এক সম্পুর্ন নতুন সমাজ ব্যবস্থা, নতুন জীবন যাত্রা প্রনালী এবং নতুন মানসিকতার প্রচলন করা যায়। এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগের পর বিজিত দেশের মানুষ জন এক নতুন মানুষে ( ভালো কি মন্দ সেটা বোঝা মুশকিল) পরিবর্তিত হয়। তারা তাদের আগের জীবন যাত্রা, আগের ভাষা, আগের সংষ্কৃতি, আগের ধর্ম সব ভুলে যায় । শধু ভুলে যায় সেটাই সব নয়, আগের সব কিছুকে ঘৃনা করতে শেখে এবং সেই ঘৃনা এক বিজাতীয় ঘৃনা (উদাহরন দুর্য্যোধন) যার মাত্রা মনুষ্যত্বের বাইরে চলে যায়।
একমাত্র আরবী ছাড়া ‘রিজিয়া’ শব্দের সমার্থক কোনো শব্দ পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষাতে আছে বলে আমার জানা নেই—এমনকি ব্রিটিশ এনসাইক্লোপিডিয়াতে ও নেই। আরব দেশেই এর সৃষ্টি। এর সফল প্রয়োগ শুরু হয় মদিনার ‘বানু কুরাইজা’ (ইহুদী) জাতির ধংস এবং তাদের পুর্বতন জীবন যাত্রা, মত ও পথ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। তারপর এই পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশে এর সফল প্রয়োগ হয়েছে। Military strategy হিসাবে এর তুলনা নেই। শুধু উপনিবেশ তৈরী করাই নয়, সম্পুর্ন ভাবে নিজের মত ও পথের সংগে একাত্ম করে নেওয়ার এক মোক্ষম উপায় এই ‘রিজিয়া’।
এই পৃথিবীর সব চেয়ে সফল ঔপনিবেশিক আলেকজান্ডার কম বেশী এর প্রয়োগ করেছেন। এক রাতে তিনি সেই সময়ের সব থেকে ধনী এবং সৌন্দর্যশালী শহর ‘পারসিপোলিশ’ (পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী) পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছিলেন। মাত্র কয়েকটা পুরানো স্তম্ভ ছাড়া আজ আর কিছু নেই। সিন্ধু নদের তীরে বসবাস কারি মালী রাজ্যের প্রায় এক লক্ষ মানুষ কে মেরে কচুকাটা করেছিলেন। তাদের অপরাধ ছিলো তারা আলেকজান্ডারের অধীনতা স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিলো। এর পর আর যার নাম করা যায়, তিনি হলেন চেংগিস খান। তিনিও আলেকজান্ডারের মতো এক বিশাল সাম্রাজ্য তৈরী করেছিলেন। মানুষের রক্তে স্নান করা আর ধংস কোনোটাতেই তার জুড়ি ছিলো না। কিন্তু এই দুই মহাপুরুষের (আমার ভাষায় দানব ) দেশ দখল ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না, আর তারা তা করেন নি। তারা তাই ধর্ম গুরু ও হতে পারে নি। এদের কোনো ধর্ম মত ছিলো না বা যা ছিলো তা চাপিয়ে দেন নাই বিজীত দেশের মানুষ গুলোর ওপরে। এদের দুই হাতে ছিলো তরবারি ,কোনো মতবাদ বা ধর্ম পুস্তক ছিলো না। লুট পাট, সম্পদ আহরন করা এবং ইতিহাসে নাম লেখানোই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো যা স্থাপিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে।
রিজিয়ার সামগ্রিক প্রয়োগ, অর্থ্যাৎ দেশ দখল এবং সেই দেশের মানুষের সব কিছুকে নিজের মতন করে নেওয়ার সফলতা একমাত্র আরবীরাই করেছে। পরে, আরবীদের কাছ থেকে এই মহান কর্তব্য নিয়ে নেয় তাদের বিজীত দেশের অধিবাসীরা, বিশেষ করে বর্তমান ‘তুর্কমেনিস্তান’ এবং উজবেকিস্তানের এর বাসিন্দারা, যারা ছিলো এই আরবীদের দাস। এদের তুর্কী দাস বলা হতো। আরবী ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে এই তুর্কী দাসেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে নেয় এবং পরিশেষে খ্রীষ্টান দের এশিয়া মাইনর দখল করে সেখানে ‘খলিফা’ নাম নিয়ে বসে যায়। এশিয়া মাইনরের নাম (যা এক সময় পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো) পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয় ‘তুরষ্ক’। রাজধানী ‘কনষ্টান্টিনোপল’ এর নাম পরিবর্তন করে নাম দেয় “ইস্তানবুল”, যে নাম আমরা জানি।
ব্রিটিশ এই ‘খলিফাতন্ত্র’ শেষ করে কামাল আতাতুর্ক কে দিয়ে গনতন্ত্রের প্রতিষ্টা করে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর। আমাদের দেশে গান্ধী সেই সময় নিদারুন ভাবে চেষ্টা করে সেই ‘খলিফাতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনবার অহিংসভাবে, কিন্তু পারেনি। অহিংসা দিয়ে উন্মত্ত হিংসা বন্ধ করা যায় না, সেই জ্ঞান তার ছিলো না। সেই গনতান্ত্রিক তুরস্ক প্রকারান্তরে আবার পুরনো ‘খলিফাতন্ত্র’ প্রতিষ্টাতে মদত দিচ্ছে আমেরিকার এবং আরো কিছু পশ্চিমী দেশের সহযোগিতায়। আর সেই ‘খলিফাতন্ত্র’ এর নবতম নাম হচ্ছে “ISIS”. এই ISIS বর্তমানে সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রায় ১৫০০ বছর আগের শুরু হওয়া “রিজিয়া” বলতে কি বোঝায়। রিজিয়া না হলে দেশ দখল করা যায় না, আর দখল করলেও চিরকাল রাখা যায় না। এই সত্য টা আলেকজান্ডার বোঝেনি,চেংগিস খান বোঝেনি, তাই তাদের বিজীত সাম্রাজ্য টেকেনি বেশিদিন। এটা বুঝেছিলেন এক মহা ঔপনিবেশিক, যে, “মানুষ কে সমস্ত দিক দিয়ে পরিবর্তন না করলে সেই মানুষ গুলোকে চিরকাল দাস করে রাখা যায় না”। তিনি আরো বুঝেছিলেন যে, মানুষ কে ভীত খরগোশ না বানালে তারা একদিন না একদিন ফনা তোলে আর সাম্রাজ্য থাকে না। এর বড়ো উদাহরন সারা বিশ্বের বিজীত বহু দেশ, যে দেশের মানুষ জন তাদের দেশ ই শধু খোয়ায় নি, খুইয়েছে তাদের মাতৃভুমি আর পিতৃ পুরুষের সংষ্কার, জীবন যাত্রা, উপাসনা পদ্ধতি, নাম,পদবী, ভাষা, খাদ্যাভাষ, পোশাক আসাক সব কিছু। আর শিখিয়েছে তাদের মাতৃ পিতৃ সংষ্কার কে চরম ঘৃনা করতে, আর প্রতিজ্ঞা করতে যে, কি ভাবে সেই মাতৃ পিতৃ বংশ জনিত সব কিছু রক্ত দিয়ে লেপে দেওয়া যায়। সারা বিশ্বে আজ চলছে সেই রক্ত দিয়ে মাত্- পিতৃ পুরুষের ঋন কে আস্বীকার করার এক ‘মারন যজ্ঞ’।
সংক্ষেপে রিজিয়া কি??? যে দেশ বা জাতিকে দখল করতে হবে, সেই দেশে নানা ছদ্ববেশে নিজের লোক ঢোকাও। সেই ছদ্ধ বেশীরা ভালো মানুষের চরম উদাহরন হবে। তারা স্থানীয় মানুষের সংগে মিলে মিশে সব খবর সরবরাহ করবে। সেই মানুষ দেশের লোক গুলোর সংগে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করবে। তারাই সেই দেশীয় মানুষের মধ্য থেকে বেছে বেছে কিছু লোভী মানুষকে উৎকোচ দিয়ে বশীভুত করবে (বিভীষন বানাবে), যাদের দিয়ে পরবর্তি কাজ গুলো, অর্থ্যাত দেশ দখল চলা কালীন এবং তার পরবর্তি পরিবর্তন করা, মস্তিষ্ক ধোলাই এর কাজ করবে। এরপর, মাঝে মাঝে কিছু সজ্জিত সৈন্যরা সেই দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়বে শুধু মাত্র লুট পাট এবং নানা সহিংস ধংস লীলা চালানোর জন্য। এই ধংস এমন হবে যে সাধারন মানুষ ভয়ে ভীত হয়ে একেবারে খরগোশ হবে যাদের আর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার মানসিকতা থাকবে না। এই দস্যু বৃত্তি, লুট পাট শুধু মাত্র সম্পত্তি লাভ নয়, ভবিষ্যত পরিকল্পনার অঙ্গ। এতে কি হয়, সার্বিক আক্রমনে দেশের মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না এবং পরে এদের যা বলা হয় তাই করে। আগ্রাসীদের খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে,তাদের ভাষা, পোশাক (ময়ুর পুচ্ছ) পরিচ্ছদ এমনকি উপাসনা পদ্ধতি প্রথমে অনুকরন এবং পরে অনুসরন করাতে কোনো অসুবিধা না হয়। সামান্য ধমক দিলেই সুড় সুড় করে যা বলা হয় তাই করে।
এই রিজিয়া ভারতে শুরু হয়েছে সেই ৭১২ সাল থেকে। এখনো সমানে চলছে। তান্ডব লীলা চলেছে, সেই সংগে চলেছে নানা আছিলা করে সার্বিক পরিবর্তন (সুফী, দরবেশ এনে এবং পরিশেষে তরবারির ডগা গলায় ঠেকিয়ে)। ১৯৪৬ সালে ৫০০০ হাজার মানুষকে মেরে যে ‘রিজিয়া’ করা হয়েছিলো তার ফল ‘লেজ গোটানো হিন্দু গুলোকে রাজি করিয়ে ভারতের এক তৃতীয়াংশ পুর্ন ভাবে দখল করা। ভারতের অভ্যন্তরে সেই সময় থেকে এবং গত ৭৫ বছরে নানা আছিলায় “ভালো মানুষ” দের ঢোকানো হয়েছে। হাজারে হাজারে দেশীয় বিভীষন তৈরী করা হয়েছে। আজকে কে যে দেশকে ভালো বাসে , আর কে যে ‘পেট্রো ডলার আর রাজনৈতিক ক্ষমতা বা ক্রিকেট সাম্রাজ্যের মহারাজ থাকতে চান বা মিডিয়া ব্যারন হতে চান, ফাউন্ডেশন তৈরী করে মুখ্য মন্ত্রী হতে চান বা পোশাক আসাক নকল করে রিজিয়া কর্মীদের প্রেমিক সাজতে চান তা বোঝা মুশকিল।
ভারতে “রিজিয়া” প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শক্ত ভিতের ওপর । পশ্চিমবংগে এর প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে প্রথমে ৩৪ বছরে আর গত ১১ বছরে সেই প্রতিষ্ঠিত ‘রিজিয়া’ শক্ত পোক্ত হয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এবারে পাশের দেশে শুরু হয়েছে বিভীষিকা, যা হতে যাচ্ছে তার নমুনা স্থাপন করা।
বাংলাদেশে এবং ভারতে হিন্দুরা ভয় পেতে শুরু করেছে, এটাই এক চরম সফলতা। এটাই চাই। জিন্না এটা খুব ভালোই জানতো ।তাই বলেছিলো—“হুনসে লিয়া পাকিস্তান লড়কে লেংগে হিন্দুস্থান”, সেই ভবিষ্যত বানী সম্বল করে ওরা এগুচ্ছে, সেই আগত মহাভারতের দ্বিতীয় পর্বে কে জিতবে, কে হারবে, কে বাচবে, কে মারা যাবে, আর তা দেখার জন্য কে থাকবে সেটাই এক বড়ো প্রশ্ন।।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................